মাছ, মুরগি, ডিম, সবজি, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের লাগামহীন মূলবৃদ্ধিতে দিশেহারা পরিস্থিতির মধ্যে খাবি খাচ্ছে দেশের মধ্যবিত্ত, নিম্ন বিত্ত ও দরিদ্র পর্যায়ের মানুষ। সাম্প্রতিক সময়ে সবরকম জ্বালানী তেলের মূল্য বৃদ্ধিতে এই নাজুক পরিস্থিতি আরও দুর্বিষহ করে তুলেছে। এমন অবস্থায় বিরোধীদল বিএনপি সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এই পরিস্থিতির জন্য সরকারকে দায়ী করলেও অবস্থা উত্তরণে যতটা গণমুখি দাবি তোলা সম্ভব ততটা কার্যকরী ভূমিকা নিতে পারছে না।
এমন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের পাশাপাশি আমরা সাধারণ নিম্ন আয়ের মানুষদের সঙ্গে কথা বলেছি, জানতে চেয়েছি তাদের বর্তমান পরিস্থিতি। সেই আলোকেই আজকের প্রচ্ছদ প্রতিবেদন।
বিএনপি নেতারা অভিযোগ করেছেন, ভোজ্য তেল, চাল-ডালসহ নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির অস্বাভাবিক পরিস্থিতিকে সরকার স্বীকার করছে না এবং সে কারণে সংকট বাড়ছে।
কমিউনিস্ট পার্টিসহ বামপন্থী কয়েকটি দলের একটি জোট আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে ‘পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার’ অভিযোগ করছে।
তবে সরকার ব্যর্থতার এ অভিযোগ মানতে রাজি নয়।
নিত্য-প্রয়োজনীয় পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষের মধ্যে যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে, সেই প্রেক্ষাপটে বিরোধীদল বিএনপি মাঠে কর্মসূচি দেয়া অব্যাহত রেখেছে।
ব্যবসায়ীদের যারা বাজারে কৃত্রিম সংকট র্সষ্টি করছে, তাদের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মহাসচিব, বিএনপি।
ভোজ্যতেলসহ নিত্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেলেও রাজনৈতিক চিন্তা থেকে সরকার পরিস্থিতিটাকে স্বীকার করছে না। সংকটটাকে স্বীকার না করা এটা বড়ো সমস্যা। ব্যবসায়ীদের যারা বাজারে কৃত্রিম সংকট র্সষ্টি করছে, তাদের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই।
বাজারে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট তৎপরতা চালাচ্ছে। এই সিন্ডিকেটগুলোর সাথে ক্ষমতাসীন দলের লোকজন জড়িত রয়েছে।
জবাবদিহিতা না থাকায় পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে। বিএনপির পাশাপাশি অন্যান্য রাজনৈতিক দলও এখন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ইস্যুতে সোচ্চার হয়েছে। বামপন্থী দলগুলো বিক্ষোভ বা বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছে।
পরিস্থিতিকে গুরুত্ব না দিয়ে সরকারের মন্ত্রীদের অনেকে এনিয়ে উপহাস করছেন
রুহিন হোসেন প্রিন্স, সাধারণ সম্পাদক, কমিউনিস্ট পার্টি।
পরিস্থিতিটাকে গুরুত্ব না দিয়ে সরকারের মন্ত্রীদের অনেকে এনিয়ে উপহাস করছেন। মন্ত্রীদের কেউ বলছেন, জিনিসপত্রের দাম বাড়লে কী হবে, মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে। আবার কেউ বলছেন, মানুষ না খেয়ে নাই। এ ধরনের উপহাস মন্ত্রীরা করছেন। আমাদের বামপন্থী জোট দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কিছু কারণ চিহ্নিত করেছে।
ব্যর্থতার অভিযোগ—
১. নিত্যপণ্যের চালসহ যে অংশ দেশে উৎপাদিত হয়, এগুলো চাতাল ব্যবসায়ী বা চালকল মালিক বা সিন্ডিকেটের খপ্পরে পড়ে যায়। এরসাথে পরিবহনে চাঁদাবাজিসহ নানা অব্যবস্থাপনার কারণে পণ্য এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়ার সময় দাম বৃদ্ধি পায়।
সরকার এটি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে।
২. কিছু পণ্যের বাজারে এক শ্রেণির আমদানিকারকের নিয়ন্ত্রণকে। আমদানি নির্ভর তেল, চিনির রাজত্বের মধ্যে আমরা আছি। এক্ষেত্রে কয়েকজন খাদ্য বিধাতা আছেন। তারা যেভাবে বলেন, সেভাবেই দাম নিয়ন্ত্রণ হয়।
সরকার চাইলেই টিসিবির পরিধিও আরও বাড়াতে পারে, কিন্তু সেটাও তারা করছে না
গোলাম রহমান
সভাপতি, কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব)
সবার পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। যারা বাজারে গিয়ে নিজেদের অসহায় মনে করে, তাদের সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। নতুবা সরকার শুনবে না। আমরা তো প্রতিদিনই এগুলো নিয়ে চিৎকার করছি, কিন্তু কেউ আমাদের কথা শুনছে না। জিনিসপত্রের দাম বাড়ার কয়দিন পর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দাবি তুলবেন তাদের বেতন-ভাতা বাড়ানোর জন্য। সরকার হয়ত তাই-ই করবে। সাধারণ মানুষের তো আয় বাড়ছে না। কষ্টটা তাদেরই বেশি হবে। সে জন্য নিত্যপণ্যের বাজারে এখনই লাগাম টানতে হবে। সরকার চাইলেই টিসিবির পরিধিও আরও বাড়াতে পারে, কিন্তু সেটাও তারা করছে না।
বাজার পরিস্থিতির কারণে দরিদ্র, নিম্ন আয়ের এবং এমনকি মধ্যবিত্তরা যখন অসহায় অবস্থায় রয়েছেন, তখন ন্যায্যমূল্যে পণ্য সরবরাহের সরকারি পদক্ষেপ নিয়েও নানা অভিযোগ রয়েছে।
সরকার টিসিবির মাধ্যমে ট্রাকে করে ভোজ্যতেলসহ যে সব পণ্য বিক্রি করছে, সেই ট্রাকগুলোকে ঘিরে অসহায় মানুষের লাইন দীর্ঘ হচ্ছে।
কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, এসব ট্রাক থেকে পর্যাপ্ত পণ্য পাওয়া যাচ্ছে না।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, পরিস্থিতি যে অবস্থায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে, তাতে এই বাজার সংকট দেশের রাজনীতিতে একটি বড়ো ইস্যু হয়েছে।
জোবায়দা নাসরিন, শিক্ষক, ঢাবি
যেহেতু সাধারণ মানুষ ভূক্তভোগী এবং সমাজে দাপটে মধ্যবিত্তকেও আঘাত করছে। সেকারণে এটি বড়ো আকারে রাজনৈতিক ইস্যু হতে পারে। যদি সরকার এখনই নজর না দেয়।
এদিকে, সরকারের মন্ত্রীদেরও অনেকেই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ইস্যু নিয়ে রাজনৈতিক বক্তব্য দিচ্ছেন। তাদের কেউ এমন অভিযোগও তুলেছেন যে, বিএনপি সমর্থক ব্যবসায়ীদের একটা চক্র নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে।
তবে সরকার এবং আওয়ামী লীগের অনেকে মনে করেন, সাধারণ মানুষের মদ্যে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ে যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে, সে বিষয়টিও বিবেচনা করা উচিত।
সরকারের বক্তব্য
ড. আব্দুর রাজ্জাক, সিনিয়র মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য
আমরা সমস্যাটিকে গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছি। আন্তর্জাতিক বাজারের দাম অনেক বেড়ে যাওয়ায়, এবার কৃষিপণ্য সার এর জন্য ২৮ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি সরকারকে দিতে হচ্ছে। এই ভর্তুকির পরিমাণ এতদিন সাত থেকে আট হাজার কোটি টাকা ছিল। সারে ভর্তূকির কারণে অনেক নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে আছে। তবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পেছনে কোনো সিন্ডিকেট নেই। সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে অল্প সময়ের মধ্যে বাজার নিয়ন্ত্রণে আসবে।
সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস দশা
কিছুদিন আগেও নাগালের মধ্যে থাকা মাছ, মুরগি, ডিমের দাম বেড়ে যাওয়ায় ব্যয় সামলাতে পুষ্টিকর বা আমিষ খাদ্যে কাটছাঁট করতে হচ্ছে মধ্য ও নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোকে।
নিম্ন আয়ের অনেকে বলেছেন, তারা এখন মাছ, মাংস এমনকি ডিম কেনা কমিয়ে দিয়ে ব্যয় নির্বাহ করতে হচ্ছে।
নিম্ন আয়ের মানুষের প্রশ্ন এখন একটাই মাছ, মাংস, ডিমের চড়া বাজার কতদিন থাকবে?
আমিষে কাটছাঁট
ঢাকার নর্দায় বসবাস করা নিম্নআয়ের বেশ কয়েকটি পরিবারের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। সেখানে কথা হয় শিউলি রানীর সঙ্গে।
শিউলি রানী, নিম্ন আয়ের কর্মজীবী
আমি কাছেই একটি বিউটি পার্লারে কাজ করি। আমার স্বামী একটি বেসরকারি অফিসের পিয়ন। আমাদের দু-জনের আয়ে দুটি শিশু সন্তান নিয়ে চার জনের সংসার। আমাদের দুজনকেই বাড়িতে থাকা বাবা-মাকে টাকা পাঠাতে হয়।
এতদিন আমাদের সংসারে সপ্তাহে দু/তিন ডিম ডিম, একদিন ব্রয়লার মুরগির মাংস এবং তেলাপিয়া বা পাঙ্গাশ মাছ খাওয়া হতো। সপ্তাহের অন্য দিন সবজি এবং ডাল দিয়ে ভাত খেতাম। কিন্তু মাছ, মাংস এবং ডিমের দামের অস্বাভাবিক বৃদ্ধিতে নিরুপায় হয়ে এখন শুধু সন্তানদের জন্য সপ্তাহে দুদিন ডিম কিনে প্রোটিনের চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করছেন। এখন আমাদের সন্তানদের ডিম দিতে পারছি না। তেলাপিয়া এবং পাঙ্গাশ মাছ আমরা খেতাম। এখন তা কেনার সামর্থ্য নাই।
আমাদের দুজনের কারো আয় না বাড়লেও খাবার খরচ বেড়েছে, যা তাদের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। সেজন্য আমাদের আমিষ খাদ্য খাওয়া বাধ্য হয়েই কমাতে হয়েছে।
পুষ্টিবিজ্ঞানীদের অনেকে বলেছেন, এসব পণ্য দিয়েই নিম্ন আয়ের একটা বড়ো জনগোষ্ঠী এবং মধ্যবিত্তদেরও অনেকে প্রোটিনের চাহিদা মিটিয়ে থাকে।
সর্বশেষ ২০১৯ সালে সরকার এবং এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির যৌথ সমীক্ষায় দেখা যায়, বাংলাদেশের দু’কোটির বেশি মানুষের পুষ্টিকর খাবার জোগাড়ের ক্ষমতা ছিল না। এই পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হচ্ছিল গত কয়েক বছরে।
এখন চাহিদা বেশি এমন সব মাছ এবং ডিমের দাম বেড়ে যাওয়ায় একটা বৃহৎ জনগোষ্ঠী আমিষ খাদ্যে কাটছাঁট করছে।
অধ্যাপক খালেদা ইসলাম, পরিচালক, পুষ্টি বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, ঢাবি।
মাছ, ডিমসহ আমিষ পণ্যের বেশি দামের বাজার লম্বা সময় ধরে চললে প্রোটিনের অভাবে পুষ্টিহীন মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
আমাদের সবজি এবং মাছ, মাংস থেকে আমিষের চাহিদা পূরণ হচ্ছিল। এই অবস্থায় আমরা ছিলাম। এখন সবকিছু দাম বেড়ে যাওয়াতে প্রভাব পড়ছে।
তবে ডাল এবং অনেক সবজি থেকেও আমিষের চাহিদা মেটানো যায় বলে পুষ্টিবিজ্ঞানীরা যা বলছেন, সেই সবজির দামও ঊর্ধ্বমুখী।
ফলে তারা মনে করেন, নিম্ন আয়ের মানুষ বা এমনকি মধ্যবিত্তরাও প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাবেন।
সরকারের পক্ষ থেকে যদিও বারবার বলা হচ্ছে, ঊর্ধ্বমুখী বাজার অল্প সময়েই স্থির হবে। কিন্তু অবস্থার উন্নতির বাস্তব কোনো দৃষ্টান্ত না দেখা যাওয়ায় সাধারণ মানুষ তার ওপর কতটা বিশ্বাস রাখতে পারছেন, সেটা নিয়ে প্রশ্ন বারবারই উঠছে। কেবল দায়সারা বক্তব্য দিয়ে এই অবস্থা পাল্টাবে না। স্বল্প আয়ের মানুষের পিঠ ইতিমধ্যেই দেয়ালে ঠেকে গেছে, এই জটিল পরিস্থিতি থেকে উন্নতির জন্য সরকারকে কার্যকরী ভূমিকা নিতে হবে।
নাজিম উদ্দীন, বিশেষ প্রতিবেদক।
[প্রতিবেদনটি সাপ্তাহিক সময়েরর বিবর্তন বর্ষ ৬, সংখ্যা ২৪-২৫, ২৪ আগস্ট ২০২২ প্রকাশিত]