বাংলাদেশ চা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ১৬৭টি নিবন্ধিত চা বাগান রয়েছে। এর বড়ো অংশটি সিলেট, হবিগঞ্জ এবং মৌলভীবাজার এলাকায় অবস্থিত। ১৬৭ টি নিবন্ধিত চা বাগানে এক লাখ ৪০ হাজার চা শ্রমিক প্রতিদিন মাত্র ১২০ টাকা মজুরিতে কাজ করছেন বা করতে বাধ্য হচ্ছেন।
চা বাগানগুলোতে এ , বি এবং সি এই তিন ভাগে ভাগ করা হয়। এ শ্রেণির চা বাগানেই দিনে সর্বোচ্চ মজুরি ১২০ টাকা। শ্রমিকেরা এখন দিনে ৩০০ টাকা মজুরি চাচ্ছেন। প্রতি দুই বছর পর পর তাদের মজুরি বাড়ানোর কথা থাকলেও ২০১৮ সালের পর আর মজুরি বাড়ানো হয়নি। মজুরির বাইরে শ্রমিকেরা সপ্তাহে তিন কেজি আটা পান, দুই টাকা কেজি দরে। এছাড়া তাদের চিকিৎসা ও আবাসন সুবিধা দেয়ার কথা। একই সঙ্গে সন্তানদের শিক্ষা সুবিধা থাকার কথা।
এমন পরিস্থিতিতে গত ৯ আগস্ট মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে চা শ্রমিকরা ধর্মঘট শুরু করে। এবং বেশ কয়েকদিন চা বাগানে অচলাবস্থা চলে। আশার কথা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে চা শ্রমিকের মজুরি ১৭০ টাকা নির্ধারণের পর শ্রমিকরা আবারও বাগানে কাজে ফিরেছে। তবে এই মজুরি দুর্মূল্যের এই বাজারে শ্রমিকের জীবন-মান উন্নয়নে কতটা প্রভাব রাখবে সেটা প্রশ্নস্বাপেক্ষ।
কেমন আছেন চা শ্রমিকরা
বাগান থেকে প্রতিদিন যে রেশন পাই সেটা চাহিদার তুলনায় কিছুই না
বাণী বাড়ৈ, চা শ্রমিক
যে চা বাগানে আমার জন্ম হয়েছে, সেখানেই এখন মায়ের সঙ্গে কাজ করি। একসময় ৭০ টাকা বেতন পেতাম। সেখান থেকে হয়েছে ১২০ টাকা। বাড়িতে ছয়জন মানুষ। দুই কেজি চাল কিনতেই এই টাকা শেষ হয়ে যায়। অন্য কিছু কেনার কথা তো ভাবতেও পারি না।
এর সঙ্গে বাগান থেকে প্রতিদিন আধা কেজি হারে চাল বা আটা রেশন পাই। কিন্তু সেটা আমার পরিবারের চাহিদার তুলনায় কিছুই না।
শ্রী রাম মুন্ডা, শ্রীমঙ্গলের একজন চা শ্রমিক
বাজারে সব কিছুর দাম বেড়েছে। আগের টাকাতে কোনভাবেই আমাদের জীবন চালানো যায় না। মাত্র ২৫ টাকা বাড়ালে আমাদের কি হবে? দরকার নাই আমাদের।
যে টাকা আয় হয় তাতে জীবনযাপন করাই কঠিন হয়ে পড়েছে
রাজকুমার দাস, মাধবপুরের চা বাগানে পাহারাদার
আমার স্ত্রী এবং মা চা বাগানে কাজ করে। আমি নিজে একটি বাগানে পাহারাদারের কাজ করি। তিন সন্তান নিয়ে পরিবারে মোট ছয়জন। যে টাকা আয় হয় তাতে জীবনযাপন করাই কঠিন হয়ে পড়েছে।
সকালে চা জ্বাল দিয়ে খেয়েছি। দুপুরে খাবেন রুটির সাথে চা পাতার ভর্তা। রাতে হয়ত ডাল ভাত আর আশেপাশের ক্ষেতখামার বা জঙ্গল থেকে সংগ্রহ করা কচু শাক। এভাবেই দিনের পর দিন তাদের খাওয়া চলে। কখনো মাসে একদিন, কখনো দুই মাসে একদিন মাছ বা মাংস রান্না হয়।
চা শ্রমিকরা সড়ক ছাড়লেও আন্দোলন চলবে
শ্রমিকরা জানিয়েছেন, সর্বশেষ ২০২০ সালে যখন চা শ্রমিক ইউনিয়ন এবং বাগান মালিকদের সংগঠন চা সংসদ মজুরি নিয়ে চুক্তি করেছিল, সেসময় মজুরি বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল। সে প্রতিশ্রুতি ১৯ মাসেও বাস্তবায়ন হয়নি।
তবে মালিকদের সংগঠন বলছে, ৩০০ টাকার প্রতিশ্রুতি কখনো দেয়া হয়নি। তাদের কথা, শ্রমিকদের যেসব সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়, তা তিনশো টাকার চেয়ে বেশি।
তবে মালিকদের এই যুক্তি মানতে রাজী নন শ্রমিকরা।
শ্রমিকদের সঙ্গে সরেজমিনে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশের চা বাগান গুলোয় প্রতিদিন ১২০ টাকা দৈনিক মজুরির বাইরে সপ্তাহে সাড়ে তিন কেজি চাল বা আটা দেয়া হয়। এছাড়া বাগানের জায়গায় থাকার জন্য বাঁশ, কাঠ, টিন আর এককালীন ৪/৫ হাজার টাকা দেয়া হয়, তবে ঘর শ্রমিকদের নিজেদের তুলে নিতে হয়।
সাধারণত একজন চা শ্রমিককে প্রতিদিন অন্তত ২০ কেজি চা পাতা সংগ্রহ করতে হয়। চারা গাছ হলে অন্তত ১৬ কেজি পাতা সংগ্রহ করতে হয়। এর বেশি সংগ্রহ করতে পারলে কেজি প্রতি চার থেকে পাঁচ টাকা বাড়তি পাওয়া যায়। শ্রমিকেরা যদি চা বাগানের জমিতে ফসল বা শাক সবজির চাষ করেন তাহলে তাদের আবার রেশন দেয়া হয় না। চিকিৎসা বলতে স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে যেকোনো রোগে প্যারাসিটামল ট্যাবলেট ছাড়া আর কিছু দেয়া হয় না।
যে মজুরি সেটি দিয়ে একজন শ্রমিকের নিজের সব মৌলিক চাহিদা পূরণ হয় না
রামভজন কৈরি, বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন নেতা
এখনকার যে মজুরি সেটি দিয়ে একজন শ্রমিকের নিজের সব মৌলিক চাহিদা পূরণ হয় না।
১২০ টাকায় দুই কেজি চাল কিনতে পারবো আমি, এখন ৪-৫ জনের একটা পরিবারে দিনে দুই কেজি চাল তো মিনিমাম লাগবেই। তাহলে তারা তো আমার সবজির কথা বলে নাই, পোশাক-আশাক, সন্তান লালন-পালন, তাদের লেখাপড়ার কথা বলে নাই।
আমরা বাধ্য হয়ে পথে নেমেছি
প্রদীপ রবিদাস, চা শ্রমিক
পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে আমার বাপ-দাদারা এখানে এসেছিল ভালো থাকার আসায়। কি পেয়েছি আমরা? মানুষ কাজ করে টাকা পয়সা জমায়, সঞ্চয় করে, সম্পত্তি করে। আমাদের চা শ্রমিকদের তো জীবনই চলে না। আমাদের বাপ-দাদাদের যে অবস্থা ছিল, আমাদের কেউ তার চেয়ে ভালো নেই। সন্তানরা ফ্রি স্কুলে পড়ে, কিন্তু তাদের পরবর্তী ভালো স্কুল কলেজে পড়ানোর মতো কারও ক্ষমতা নেই। রোজকার খাওয়াটাও ঠিক মতো হয় না। বহুবার এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। তাই আমরা বাধ্য হয়ে পথে নেমেছি।
আমরা মানবেতর জীবনযাপন করছি
চন্দন কুর্মী, শ্রমিক, চা বাগান, মৌলভীবাজার।
আমার স্ত্রী দুই সন্তান ও দুই ভাইসহ ছয় সদস্যের পরিবার। সবাই আমার ওপর নির্ভরশীল। সকালের নাস্তা রেশনে পাওয়া আটা দিয়ে হয়। দুপুর ও রাতের খাবারের জন্য কমপক্ষে আড়াই কেজি চাল লাগে। আমি যা মজুরি পাই তা দিয়ে আড়াই কেজি চালই কেনা সম্ভব নয়। অন্যান্য খরচের টাকা কোথায় পাবো। আসলে আমরা এক বেলা না খেয়ে থাকার পরও সংসার চলে না। বিশ্বাস করুন আমরা না খেয়ে থাকি। আমাদের সন্তানদের পড়াশুনা করাতে পারি না। এনজিওর যে স্কুল এখানে আছে তাতে পঞ্চম শ্রেণির পর আর পড়ানো হয় না। আমাদের ঘর চালা ফুটো হয়ে পানি পড়ে। পাঁচটি টিন লাগলে দেয় একটি। আমরা মানবেতর জীবনযাপন করছি।
সন্তানদের ভবিষ্যৎ কী?
চা শ্রমিকদের সন্তানরা যেন চা শ্রমিক হওয়ার জন্যই বড় হয়। তাদের জীবনে আর কোনো স্বপ্ন দেখার সুযোগ নেই। যদি একজনকে পড়াশুনা করাতে হয় তাহলে অন্য সন্তানদের আর পড়ালেখা করানো যায় না।
যাদের সন্তান বেশি তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। একজনকে পড়ালে অন্য সন্তানদের পড়ানো সম্ভব হয় না। ১২০ টাকা মজুরিতে পেটই চলে না, পড়াবে কীভাবে সম্ভব সেটা সহজেই অনুমেয়।
আন্দোলন কতদিন চলবে?
মজুরি দিনে ১২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকা হলেই আমরা কাজে ফিরে যাব
নৃপেণ পাল, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক, চা শ্রমিক ইউনিয়ন।
চা বাগানগুলোতে স্থায়ী শ্রমিক আছে এক লাখ। আর অস্থায়ী আছে ৫০ হাজার। তাদের ওপর নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা প্রায় আট লাখ। আমাদের দাবি ২০টি। মূল দাবি হলো মজুরি দিনে ১২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করতে হবে। এটা পূরণ হলেই আমরা কাজে ফিরে যাব। কিন্তু বুধবার মালিকদের সঙ্গে আলোচনায় তারা আমাদের মজুরি মাত্র ২০ টাকা বাড়িয়ে ১৪০ টাকা করতে রাজি হয়েছেন। কিন্তু আমাদের ৩০০ টাকার দাবি পুরণ না হলে আমরা আন্দোলন চালয়ে যাব। আমরা আর চলতে পারছি না। দেয়ালে পিঠ থেকে গেছে।
জি এম শিবলি, চেয়ারম্যান, চা সংসদ, সিলেট ব্রাঞ্চ
আমরা এখনো কোনো বেতন বাড়াতে রাজি হয়নি। তারা যে ৩০০ টাকা মজুরি চাইছেন সুযোগ-সুবিধা মিলিয়ে তার চেয়ে বেশি দিচ্ছি। তাদের সাথে আরো আলোচনা হবে। ২০১২ সাল থেকে ১০ বছরে চায়ের নিলাম মূল্যের প্রবৃদ্ধি প্রতি বছর ০.১৬ শতাংশ হারে বাড়লেও চা-শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানো হয়েছ মোট ৯৪.২০ শতাংশ।
বাংলাদেশ বিশ্বের তিন শতাংশ চা উৎপাদন করে। ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশি চায়ের বাজারের মূল্য প্রায় ৩ হাজার পাঁচশ’ কোটি টাকা। জিডিপিতে এই শিল্পের অবদান প্রায় ১ শতাংশ। চা শ্রমিকদের ধর্মঘটের কারণে প্রতিদিন ২০ কোটি টাকারও বেশি দামের চাপাতা নষ্ট হচ্ছে বলে দাবি বাগান মালিকদের। তবে যেকোনো বিশ্লেষণেই এ্টা সহজেই প্রতীয়মান বর্তমানে নিত্যপণ্যের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতি, জীবনযাপনের আনুষঙ্গিক ব্যয় দিনে দিনে বাড়ছে। যতটুকু রেশন বা সুযোগ-সুবিধা দেয়ার কথা বলা হয় সেটুকুতে দৈনিক ১২০ টাকা মজুরিতে পরিবার-পরিজন নিয়ে স্বাভাবিক জীবন চালানো কোনোভাবেই সম্ভব নয়। চা শ্রমিক ও তাদের পরিবারের সাথে আলাপে একথা স্পষ্ট। তাই তাদের দাবির স্বপক্ষে বলা যায়, চা শ্রমিকরা বাংলাদেশেরই নাগরিক, তাদের স্বাভাবিক ও সুস্থ জীবনযাপনের পথ খুলে দিতে দেশের অন্যান্য খাতের শ্রমিকদের তুলনায় এনে মজুরি বৃদ্ধির বিকল্প নেই।
মৌলভীবাজার সংবাদদাতা প্রেরিত চা শ্রমিক ও চা শ্রমিক নেতৃবৃন্দ, মালিক সংশ্লিষ্টদের মতামাতের ভিত্তিতে প্রতিেিবদনটি তৈরি করেছেন নাজিম উদদীন, বিশেষ প্রতিবেদক।
[প্রতিবেদনটি সাপ্তাহিক সময়ের বিবর্তন বর্ষ ৬ , সংখ্যা ২৭, ৩১ আগস্ট ২০০২২ প্রকাশিত]