ছোটোবেলায় যখন স্কুলে পড়তাম তখন ছিল পাকিস্তানি আমল। আমাদের শহরে যদি কোনো রাষ্ট্রীয় নেতা আসতেন তখন আমাদের স্কুলের সবাইকে রাস্তার দু’পাশে দাঁড় করিয়ে হাতে একটি করে কাগজের তৈরি পাকিস্তানি পতাকা ধরিয়ে দেওয়া হতো। আমরা কাঠ ফাটা রোদের মধ্যে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতাম। অবশেষে যখন সেই রাষ্ট্রীয় নেতা আসতেন আমরা তখন সেই পতাকা উড়িয়ে “পাকিস্তান জিন্দাবাদ, পাকিস্তান জিন্দাবাদ” বলে শ্লোগান দিতাম।
কিন্তু আমি যখন যীশুর যিরুশালেমে প্রবেশের বিষয়টা পড়ছিলাম তখন আমার সেই ছোটোবেলার ঘটনার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। তবে আমাদের ছোটোবেলার ঘটনা থেকে পবিত্র বাইবেলে বর্ণিত যীশুর যিরুশালেমে প্রবেশের ঘটনাটির পার্থক্য রয়েছে। সে সময়ে আমাদের দিয়ে করানো হতো আর যীশুর জন্য যারা নিজেদের শরীরের বস্ত্র পথে পেতে দিয়েছিল, আর খেজুর পাতা উড়িয়ে “হোশান্না,হোশান্না” বলে শ্লোগান দিয়েছিল, তাঁরা তা স্বেচ্ছায় করেছিল।
আমরা আর কয়েকদিন পরে যীশুর ক্রুশীয় মৃত্যুবরণকে স্মরণ করতে যাচ্ছি। যদিও এই সময়ে অনেক খ্রীষ্টভক্ত যীশুর দুঃখভোগকে স্মরণ করে কৃচ্ছ্বতা অর্থাৎ প্রার্থনা, উপবাস হত্যাদি পালন করে থাকেন। যদি আমরা করতে হয় বলে করি তবে তা অত্যন্ত দুঃখজনক। কিন্তু যদি সত্যিকারভাবে যীশু আমাদের জন্য যে ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন, সেই কথা হৃদয়ে উপলব্দি করে আত্ম-শুদ্ধির চেষ্টা করি, তবে এর চেয়ে অধিক ভালো আর কি হতে পারে।
১ম বিষয়: পাম সান্ডে/তালপত্র রবিবার-এর ইতিহাস = পুনরুত্থানের এক সপ্তাহ পূর্বে যীশুর যিরুশালেমে প্রবেশের কথা স্মরণ করে পাম সান্ডে/তালপত্র রবিবার পালন করা হয়। পৃথিবীর অনেক খ্রীষ্টিয় মণ্ডলী এই দিনে খেজুর পাতা ক্রুশের মত তৈরি করে মণ্ডলীতে আগত ভক্তদের মাঝে বিতরণ করেন। আজকে আমরা যা করছি। সুসমাচার অনুসারে যীশু যিরুশালেমে প্রবেশের আগের দিন বৈথনিয়া-বৈৎফগী গ্রামের লাসার, যাকে যীশু মৃত্যু থেকে জীবিত করেছিলেন, সেখানে ছিলেন। সেখান থেকে দু’জন শিষ্য পাঠিয়ে গ্রাম থেকে গাধা/গর্দভ এনেছিলেন। শিষ্যেরা গাধার পিঠে নিজেদের কাপড় বিছিয়ে দিলে তিনি তার উপরে বসে যিরুশালেমের দিকে যাত্রা করেছিলেন। তার যাত্রা পথে শিষ্যরা ও অন্যান্য লোকেরা নিজেদের কাপড় রাস্তায় বিছিয়ে দিয়েছিল আর খেজুর পাতা উড়িয়ে “ হোশান্না দায়ুদ সন্তান, ধন্য যিনি প্রভুর নামে আসিতেছেন; উর্দ্ধলোকে হোশান্না” বলে চিৎকার করে শ্লোগান দিয়েছিল। মথি ২১:৯ পদ।
প্রাচীন কালে অনেক দেশে নিয়ম ছিল যে, যদি কোনো উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন লোক পথ দিয়ে যেতেন তখন তার পথ ঢেকে দেওয়া হত- ২ রাজা ৯:১৩ পদে দেখা যায়, যিহোশাফটের ছেলে যেহু যখন ইস্রায়েল রাজা হন, তখন ইস্রালিয়রা এভাবেই তার পথ নিজেদের গায়ের কাপড় বিছিয়ে ঢেকে দিয়েছিল।
যিহুদী রীতিতে তালপত্র বা খেজুর পাতা উড়ানো ছিল বিজয়ের প্রতিক। আমরা লেবীয় ২৩:৪০, প্রকাশিত বাক্য ৭:৯ পদে দেখতে পাই। লোকেরা যীশুর পথ নিজেদের গায়ের কাপড় দিয়ে ঢেকে দিয়েছিল আর খেজুর পাতা উড়িয়েছিল, সেজন্য এই দিনের নাম হয়েছে পাম সান্ডে বা তালপত্র রবিবার।
ভবিষ্যদ্বাণী: মথি তার বিবরণে যীশুর যিরুশালেমে প্রবেশের ভবিষ্যদ্বাণী তুলে ধরতে গিয়ে সখরিয় ৯:৯,১০ পদের উদ্ধৃতি দিয়েছেন, তোমরা সিয়োন কন্যাকে বল, দেখ, তোমার রাজা তোমার কাছে আসছে, তিনি মৃদুশীল, ও গর্দভের উপরে উপবিষ্ঠ। পরবর্তিতে মথি গীত ১১৮;২৫,২৬ পদের উল্লেখ করে বলেছেন, যে কথা বলে লোকেরা চিৎকার করেছিল, “ হোশান্না দায়ুদ সন্তান, ধন্য যিনি প্রভুর নামে আসছেন; ঊর্দ্ধলোকে হোশান্না”। হিব্রু ভাষায় বাইবেলে “হোসিয়ানা” শব্দটি গ্রিক অনুবাদে হোশান্না (প্রভুর আরাধনা) হয়েছে। এখানে যীশুর আত্ম বলিদান ও তাঁর বিজয়ি বেশে যিরুশালেমে প্রবেশের কথা বলে।
যে লোকেরা যীশুর যিরুশালেমে প্রবেশে “হোশান্না” বলে চিৎকার করেছিল সেই লোকদেরই আমরা দেখি মাত্র কয়েকদিন পরেই “ওকে ক্রুশে দাও, ওকে ক্রুশে দাও” বলে চিৎকার করতে। কিন্তু কেন এই লোকদের আচরণ এভাবে পাল্টে গিয়েছিল? তার কারণ ছিল, সে সময়ে যিহুদীদের সবচেয়ে বড়ো শত্রু ছিল রোমীয়রা, যিহুদীরা আশা করতো তাদের জন্য একজন মসীহ আসবেন, যিনি তাদেরকে রোমীয়দের হাত থেকে উদ্ধার করবেন। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা দেবেন। যীশু যেদিন যিরুশালেমে প্রবেশ করেছিলেন, সেদিন তারা সেই আশাই করেছিল, কিন্তু তাদের সেই ভুল
ভাঙতে দেরি হয়নি, যখনই তারা বুঝতে পেরেছিল যে যীশু তাদের রোমীয়দের হাত থেকে মুক্তি দিতে আসেননি, তখনই তারা যীশুর বিপক্ষতা করতে দেরি করেনি। আমাদের জীবনের সঙ্গেও এর একটা মিল আছে, আমরা সব সময়ই চাই যীশু আমাদের জন্য এটা করবেন,ওটা করবেন, কিন্তু যীশু আমাদের কাছে যা চান তা আমরা করি না, তাই যখনই আমরা আমাদের ইচ্ছামতো সব কিছু পাই না/হয় না, তখনই আমরা হতাশ হয়ে পড়ি আর বলি ঈশ্বর আমাদের প্রার্থনা শোনেন না।
ঘোড়া হচ্ছে বীরত্বের প্রতীক, আর গাধা হচ্ছে নম্রতা ও শান্তির প্রতিক। একজন রাজা তিনি বীরের মতোই ঘোড়ায় চড়ে আসবেন, এটাই সবাই কামনা করে, কিন্তু যীশু রাজার মতোই এলেন, তবে গাধার পিঠে চড়ে। নম্রতায়, শান্তিভাবে (ফিলিপীয় ২:৫-৮) তিনি নিজেকে শূন্য করেছিলেন, দাসের রূপ ধারণ করেছিলেন, শুধুমাত্র আপনার ও আমার জন্য, যেন আমরা পরিএাণ পাই।
সুসমাচারে পড়েছি যীশু যিরুশালেমে প্রবেশ করে মন্দিরে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, আমার গৃহ প্রার্থনার গৃহ বলিয়া আখ্যাত হবে। অনেক বছর আগে ঈশ্বর একটি মাটির পুতুল তৈরি করেছিলেন। সেই মাটির পুতুলের নাকে ফুঁ দিয়ে তিনি তার মধ্যে প্রাণবায়ু প্রবেশ করিয়েছিলেন। আদি পুস্তক ২:৩১ পদ বলে,“ ইশ্বর আপনার নির্মিত বস্তু সকলের প্রতি দৃষ্টিপাত করিলেন,আর দেখ সে সকলই উত্তম”। ঈশ্বর মাটি দিয়ে এই পুতুলের কাঠামো নির্মাণ করেছিলেন তাকেই তিনি বলছেন মন্দির, যে মন্দিরে তিনি তাঁর আত্মা অর্থাৎ পবিত্র আত্মাকে থাকবার জন্য দিয়েছেন, বলেছেন তোমাদের দেহ পবিত্র আত্মার মন্দির। কিন্তু মানুষ এই মন্দিরকে নষ্ট করেছে, ঈশ্বর চান এই মন্দিরে থাকতে, মন্দির পরিষ্কার করতে। বলতে চান এই মন্দির আমার থাকবার গৃহ, আপনি, আমি কি এই মন্দিরে তাঁর থাকবার জন্য নিজেদের বস্ত্র পেতে দিয়েছি? আজকে প্রশ্নটা আমাদের নিজেদের করতে হবে, যীশুর বিজয় যাত্রায় আমি কি অংশ নিতে পারবো? আমার হৃদয় মন্দির তাঁর জন্য কতটুকু পরিষ্কার। সেখানে কি আমার ইচ্ছা, আমার গর্ব, আমার লোভ, আমার জাগতিকতা বাস করে, না, সেখানে আমি বিজয়ী বেশে যীশুর আসার জন্য বস্ত্র পেতে দিয়েছি?
আমরা জানি যীশু আবার এই পৃথিবীতে আসবেন, বাইবেলের একজন পণ্ডিত বলেছেন, যদি কেউ মনে করে যীশু আবার গাধার পিঠে চড়ে আসবেন, নম্র বেশে, তবে তিনি ভুলের স্বর্গে বাস করছেন, তিনি আসবেন, ঘোড়ায় চড়ে বিজয়ী বেশে, রাজার মত, যারা তাঁর ইচ্ছা পালন করে তাদেরকে তাঁর কাছে নিতে। এখানে আরও একটি লক্ষণীয় বিষয় এই যে, খ্রীষ্ট কেবল নম্রই ছিলেন না কিন্তু ক্রোধেরও ছিলেন। তার প্রমাণ তিনি মন্দিরে প্রবেশ করে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। তাই এখন যারা ধর্মের নামে ব্যবসা করছে, তাদের বিরুদ্ধেও খ্রীষ্ট ভবিষ্যদ্বাণী উচ্চারণ করেছেন, আমেন।
পালক কিশোর তালুকদার: খ্রীষ্টিয় ধর্মতত্ত্ববিদ।