আমেরিকান-কানাডিয়ান অভিনেতা, ডোয়েইন দ্য রক’ জনসন নামের সাথে আপনারা সকলেই কমবেশি পরিচিত। বিশ্বের বাঘা বাঘা অভিনেতাদের পেছনে ফেলে, তালিকার শীর্ষস্থানটি দখল করে রেখেছেন এই অভিনেতা, যিনি অভিনয়ের দিক থেকে না হলেও, শারীরিকভাবে নিঃসন্দেহে অত্যন্ত বলিষ্ঠ।
ডোয়েইন জনসনের জীবনের একাধিক সত্ত্বার মাঝে, প্রধানতম দুটি সত্ত্বা হলো অভিনেতা এবং রেসলারের। অন্যান্য অধিকাংশ তারকা অভিনেতার মতো সরাসরি অভিনেতা হিসেবেই খ্যাতি লাভ করেননি তিনি। বরং হলিউডে পা রাখার আগে থেকেই তিনি ছিলেন বিশ্বব্যাপী সমাদৃত এক নাম। কেননা ইতোমধ্যেই WWE-তে পেশাদার রেসলার ‘দ্য রক’ হিসেবে তিনি ছিলেন দারুণ সফল।
রেসলার হিসেবে সেই নিশ্চিত ক্যারিয়ার ফেলে হলিউডে অভিনেতা হিসেবে যাত্রা খুব একটা সহজ ছিল না তার জন্য। পাড়ি দিতে হয়েছে বহু চড়াই-উৎরাই। বাস্তবজীবনেও সম্মুখীন হতে হয়েছে কঠিন পরীক্ষার, চরম বিষণœতার। কিন্তু সেই সকল প্রতিবন্ধকতাকে পেছনে ফেলে তিনি এসে পৌঁছেছেন আজকের অবস্থানে।
চলুন, আপাতত বরং জেনে নেয়া যাক, এখন পর্যন্ত তার ক্যারিয়ারের নানা উত্থান-পতনের আখ্যান।
১৯৭২ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার হেওয়ার্ডে জন্ম হয় ডোয়েইন ডগলাস জনসনের। তার দাদা পিটার মাইভিয়া এবং বাবা রকি জনসন, দুজনেই ছিলেন সাবেক পেশাদার রেসলার। তাই পারিবারিকভাবেই পেশাদার রেসলিংয়ের আবহে বেড়ে উঠেছেন তিনি, চোখের সামনে দেখেছেন বাবাকে শরীরচর্চা করতে, রিংয়ে পারফর্ম করতে। তার নিজেরও পেশাদার রেসলার হওয়াটা যেন নিয়তিই ছিল।
তবে শুরুতে সেই নিয়তিকে মেনে নিতে রাজি ছিলেন না জনসন। বরং নিজের দীর্ঘকায় শরীর ও অ্যাথলেটিসিজমকে কাজে লাগিয়ে তিনি চেয়েছিলেন আমেরিকান ফুটবল তারকা হতে। এ খেলায় নিজের দক্ষতা ও সামর্থ্যের প্রমাণ দিয়ে অর্জন করে নেন ইউনিভার্সিটি অব মায়ামিতে ডিভিশন ওয়ানে খেলার স্কলারশিপ। যদিও মাত্র একটি ম্যাচেই শুরু থেকে মাঠে নামার সুযোগ হয়েছিল তার, তবু ১৯৯১ সালের চ্যাম্পিয়নশিপ দলের সদস্য ছিলেন তিনি, এবং কলেজ ক্যারিয়ারে মোট ৩৯টি ম্যাচ খেলেছিলেন।
অনেকেই মনে করেন, ন্যাশনাল ফুটবল লিগে (এনএফএল) বেশ সফল একটি ক্যারিয়ার গড়তে পারতেন জনসন, যদি না মায়ামি হারিকেন্সের হয়ে খেলার সময় তিনি গুরুতর আঘাত পেতেন কাঁধ ও পিঠে। তাই এনএফএলে চেষ্টা না করে, তিনি কানাডিয়ান ফুটবল লিগের (সিএফএল) দল কালগ্যারি স্ট্যাম্পেডার্সে নাম লেখান।
কিন্তু ওই সময়টাকে জনসন স্মরণ করেন তার জীবনের সবচেয়ে খারাপ সময় হিসেবে। কেননা সিএফএলে খেলে সপ্তাহে মাত্র ২৫০ ডলার আয় করতেন তিনি। বিগত ইনজুরির কারণে এনএফএলে খেলার আশাও আর ছিল না। অন্যদিকে প্রথম যৌবনের প্রেমে ব্যর্থ হয়ে তার হৃদয়ও ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিল।
মাস দুয়েক ফুটবলার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার শেষ চেষ্টা করেও যখন নিজের মনকে প্রবোধ দিতে পারলেন না, তখন জনসনের মাথায় এলো পেশাদার রেসলার হওয়ার সম্ভাবনা। বর্তমানের WWE তখন ছিল WWE . সেখানেই ‘মানডে নাইট র’-তে বাবা ও দাদার নামের সমন্বয়ে সৃষ্ট ‘রকি মাইভিয়া’ হিসেবে তার অভিষেক ঘটে ১৯৯৬ সালে।
পূর্বের তেমন কোনো অভিজ্ঞতা না থাকলেও, দ্রুতই দর্শকদের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকেন তিনি। এক্ষেত্রে কোম্পানির পক্ষ থেকে তাকে শক্তিশালী রূপে উপস্থাপনেরও একটা বড়ো ভূমিকা ছিল। WWE -এর ইতিহাসে ‘প্রথম তৃতীয় প্রজন্মের রেসলার’ আখ্যা দেয়া হয় তাকে, এবং ‘সারভাইভার সিরিজ’-এ নিজের অভিষেকেই ৮ জনের এলিমিনেশন ট্যাগ ম্যাচে প্রতিপক্ষ দলের শেষ দুই সদস্য ক্রাশ ও গোল্ডডাস্টকে এলিমিনেট করে সোল সারভাইভার হন তিনি।
১৯৯৮ সালে জনসন মেভিয়া নাম মুছে ফেলে নিজেকে ‘দ্য রক’ হিসেবে পরিচয় দিতে শুরু করেন, এবং নেশন অব ডমিনেশন’-এ যোগ দিয়ে এক পর্যায়ে সেটির দলনেতাও বনে যান। প্রথম দিকে ধারাভাষ্যকাররা তার নামের সাথে ‘মেভিয়া’ জুড়ে দিতে থাকলেও, ‘দ্য রক’ নামটিকেই সাধারণ দর্শক-ভক্তরা আপন করে নেয়। ওই বছরই ‘সারভাইভর সিরিজ’-এ ম্যানকাইন্ডকে হারিয়ে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ WWE চ্যাম্পিয়ন হন তিনি।
পরবর্তী সময়ে দ্য রক ‘দ্য করপোরেশন’ নামের আরেকটি এলিট রেসলারদের দলেও যোগ দেন, এবং সেখানে স্টোন কোল্ড স্টিভ অস্টিনের সাথে তার প্রতিদ্বন্দ্বিতা রেসলিং ইতিহাসের কিংবদন্তীতুল্য মর্যাদা লাভ করে। একাধারে যেমন নিজে হয়ে ওঠেন ‘দ্য পিপল’স চ্যাম্প’, তেমনই লোকের মুখে মুখে ঘুরতে থাকে তার সিগনেচার মুভ ‘দ্য রক বটম’ এবং ‘দ্য পিপল’স এলবো’-র নাম। তবে ২০০৪ সালে হলিউডে ক্যারিয়ার গড়ার লক্ষ্যে WWE থেকে অবসর গ্রহণ করেন তিনি, যদিও এরপর বিভিন্ন সময়ই ফিরে এসেছেন তিনি, ম্যাচ খেলেছেন, এমনকি চ্যাম্পিয়নশিপও জিতেছেন। WWF /E (৮) ও WCW (২)-তে সব মিলিয়ে তিনি ১০টি ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ জেতেন।
WWE -র সক্রিয় রেসলার থাকাকালীনই ২০০০ সালে দ্য রক কিংবা জনসন উপস্থাপনা করেন ‘স্যাটারডে নাইট লাইভ’-এ, যা তাকে রেসলিং দুনিয়ার পাশাপাশি মূলধারার বিনোদন জগতে পরিচিতি এনে দেয়। তিনি নজর কাড়েন হলিউডের নির্মাতাদেরও। ফলে পরের বছরই ‘দ্য মামি রিটার্নস’ ছবিতে স্করপিয়ন কিং চরিত্রের মাধ্যমে হলিউডে অভিষেক হয়ে যায় তার। সেই ছবির ব্যাপক বাণিজ্যিক সফলতা জনসনকে পুনরায় ফিরিয়ে আনে বড় পর্দায়, ২০০২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘দ্য স্করপিয়ন কিং’ ছবিতে।
অ্যাকশন-ফ্যান্টাসি ঘরানার চলচ্চিত্রে নিজের যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখার পর জনসন তার কমেডি দক্ষতাও প্রদর্শনের চেষ্টা করেন ২০০৩ সালের ‘দ্য রানডাউন’ এবং পরবর্তীতে ‘দ্য গেম প্ল্যান’ (২০০৭) ও ‘গেট স্মার্ট’ (২০০৮) ছবিগুলোতে। কিন্তু এসব ছবির কমেডি রোলে তিনি পূর্বের সাফল্যের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে ব্যর্থ হন। এদিকে ২০০৭ সালে তার বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে স্ত্রী ড্যানি গার্সিয়ার সাথেও। মোটামুটি জীবনের আরো একটি কঠিন সময়ে উপনীত হন তিনি।
তবে হাল ছেড়ে দেননি জনসন। হলিউডে নিজের পায়ের তলার জমিন শক্ত করতে তিনি ছিলেন মরিয়া। যেমন ২০১০ সালে তাকে দেখা যায় ‘ড্রাইভার’ ছবিতে। তবে তার হলিউড ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট বলা যায় ২০১১ সালের ‘ফাস্ট ফাইভ’ ছবিটিকে। এ ছবির মাধ্যমেই ‘ফাস্ট অ্যান্ড ফিউরিয়াস’ সিরিজে প্রথম দেখা যায় তাকে, এবং তার উপস্থিতির ফলেই সিরিজটি নিয়ে বিশ্বব্যাপী নতুন করে উন্মাদনা সৃষ্টি হয়।
ওই সময়টায় জনসনের বৃহস্পতি ছিল তুঙ্গে। WWE-তে বহুল প্রতীক্ষিত প্রত্যাবর্তন ঘটে তার, এবং প্রথমবারের মতো ডোয়েইন জনসন ও দ্য রকের মিশেলে তিনি বনে যান ডোয়েইন ‘দ্য রক’ জনসন। ২০১১ সালের ‘রেসলম্যানিয়া’-এ ( WWE-এর বাৎসরিক সবচেয়ে বড় ইভেন্ট) তিনি হোস্টের ভূমিকা পালন করেন। আর ওই রেসলম্যানিয়া থেকেই শুরু হয় জন সিনার সাথে তার ঐতিহাসিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার, যার সূত্র ধরে ২০১২ সালের ‘রেসলম্যানিয়া’-এ ‘ওয়ান্স ইন আ লাইফটাইম’ ম্যাচে তিনি হারিয়ে দেন সিনাকে।
অবশ্য ‘ওয়ান্স ইন আ লাইফটাইম’ শেষ পর্যন্ত আর তার নামের সার্থকতা বজায় রাখতে পারেনি। ২০১৩ সালের ‘রয়্যাল রাম্বল’-এ তৎকালীন WWE চ্যাম্পিয়ন সিএম পাংককে হারিয়ে দ্য রক জিতে নেন তার অষ্টম WWE চ্যাম্পিয়নশিপ। এবং ওই বছর ‘রেসলম্যানিয়া’-এ আবারো সিনার মুখোমুখি হন তিনি, যেখানে তার পরাজয় ঘটে। এটি অবশ্য তার শেষ ম্যাচ নয়। ২০১৬ সালের ‘রেসলম্যানিয়া’-এ এরিক রোয়ানকে মাত্র নয় সেকেন্ডে হারিয়ে দেন তিনি।
এদিকে ‘ফাস্ট অ্যান্ড ফিউরিয়াস ৬’ (২০১৩) এবং ‘ফিউরিয়াস ৭’ (২০১৫) এর পাশাপাশি ২০১৪ সালে মুক্তি পায় জনসনের ‘হারকিউলিস’ ছবিটি। আর ২০১৫ সালে আসে ‘স্যান আন্দ্রেস’ ছবিটিও, যেটির মাধ্যমে জনসন একক নায়ক হিসেবেও ব্লকবাস্টার ছবি উপহার দিতে শুরু করেন। ওই একই বছর এইচবিও-তে ‘বলার্স’র মাধ্যমে ছোটো পর্দার কমেডি সিরিজে অভিষেক ঘটে তার। মোট পাঁচ সিজন ধরে চলে সিরিজটি, এবং ছয় বছরের মধ্যে এটিই এইচবিও’র সবচেয়ে বেশি দেখা কমেডি সিরিজ।
২০১৬ সালে জনসন কেভিন হার্টের সাথে জুটি বাঁধেন অ্যাকশন-কমেডি ছবি ‘সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স’-এ। তিনি কণ্ঠ দেন ডিজনির হিট অ্যানিমেশন ছবি ‘মোয়ানা’-তেও। ২০১৭ সাল ছিল তার জন্য আরো ব্যস্ত একটি বছর। এ বছর তিনি ‘দ্য ফেট অব দ্য ফিউরিয়াস’, ‘বেওয়াচ’ এবং ‘জুমানজি: ওয়েলকাম টু দ্য জাঙ্গল’ ছবিতে অভিনয় করেন, এবং প্রতিটি ছবিই ব্যবসায়িক সাফল্য পায়। বিশেষত ‘দ্য ফেইট অভ দ্য ফিউরিয়াস’ এবং ‘জুমানজি’ এখন পর্যন্ত তার সর্বাধিক আয় করা দুইটি ছবি।
২০২২ সালে এসেওে অব্যহত থাকে জনসনের জয়যাত্রা। শুরুতেই বলছিলাম জনসনের বিশ্বের সর্বাধিক পারিশ্রমিক প্রাপ্ত অভিনেতা হওয়ার কথা। এ খেতাব অবশ্য তার জন্য নতুন কিছু নয়। সেই ২০১৬ সালেই ৬৪.৫ মিলিয়ন ডলার আয় করে তিনি ছিলেন ফোর্বসের মতে বছরের সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিক প্রাপ্ত অভিনেতা।
জনসনের আধিপত্য শুধু উপার্জনের তালিকাতেই সীমাবদ্ধ নয়। ২০১৬ ও ২০১৯ সালে তিনি টাইমস ম্যাগাজিনের বিশ্বসেরা ১০০ প্রভাবশালীর তালিকায়ও জায়গা পান। তাছাড়া ২০১৯ সালে যে ছয়জন ব্যক্তিকে ম্যাগাজিনটির কভারে দেখা যায়, তাদের মধ্যেও একজন ছিলেন তিনি। ২০০০ সালে প্রকাশিত হয় জনসনের ‘দ্য রক সেইজ’ নামক আত্মজীবনী, যেটি প্রথম সপ্তাহেই উঠে এসেছিল দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস বেস্ট সেলার তালিকার এক নম্বরে।
২০১৮ সালে জনসন মুখ খোলেন তার কৈশোরের সংগ্রাম ও মানসিক অস্থিতিশীলতার ব্যাপারে। তিনি জানান, তার বয়স যখন ১৪, তখন তাদেরকে হাওয়াইয়ের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়। এ ঘটনা গোটা পরিবারের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে, এবং মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে তার মা আত্মহত্যার চেষ্টা পর্যন্ত করেন। সে ঘটনার কথা অবশ্য তার মায়ের আর মনে নেই, তবে এর পর থেকে ডিপ্রেশনের সাথে লড়াই শুরু হয় জনসনের। ইনজুরির কারণে ফুটবল ক্যারিয়ারের ইতি ঘটা এবং প্রেমিকার সাথে বিচ্ছেদের ফলে সে ডিপ্রেশনের মাত্রা এক পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, যদিও শেষ পর্যন্ত সে অবস্থা থেকে উত্তরণে সক্ষম হন তিনি।
বর্তমানে ব্যক্তিজীবনে তিন সন্তানের বাবা জনসন। তার দুই মেয়ের মা, দীর্ঘদিনের প্রেমিকা লরেন হাশিয়ান; তাকে ২০১৯ সালের আগস্টে বিয়ে করেন তিনি। এছাড়া প্রথম স্ত্রী ড্যানি গার্সিয়ার সাথেও একটি মেয়ে আছে তার। বর্তমানে হলিউডে অভিনয়জীবন নিয়ে প্রচন্ড ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন জনসন।