ব্রিটিশদের দুইশ’ বছরের শাসন-শোষণ থেকে মুক্ত হতে ভারতবর্ষের মানুষের সাহস ও মনোবলের কাছে শেষ পর্যন্ত ইংরেজরা পরাভূত হলো। ইংরেজরা বুঝেছিল যে, জোর করে এদেশ শাসনের দিন তাদের ফুরিয়ে এসেছে। বিদায়কালে তারা এ উপমহাদেশকে ভেঙে দু-ভাগ করে দিয়ে যায়। ১৯৪৭ সালের চৌদ্দ ও পনের আগস্ট ইংরেজশাসিত অখণ্ড ভারত ভেঙে পাকিস্তান ও ভারত নামের দুটি পৃথক রাষ্ট্রের জন্ম হয়। এ ভাঙনের ফলে বৃহত্তর বাংলাও দুভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। পূর্ব বাংলা যুক্ত হয় ভৌগলিকভাবে ১২ শ’ মাইলের দূরে অবস্থিত বিভক্ত পাঞ্জাব, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্দু ও বেলুচিস্তানকে নিয়ে গঠিত পাকিস্তানের সঙ্গে। আর পশ্চিমবঙ্গ যুক্ত হয় বৃহত্তর ভারতের সাথে। এ অভাবনীয় পরিবর্তন, বিভাজন, দেশ ও প্রদেশ ভাগের বিষয়গুলো সাতচল্লিশ-পূর্ববর্তী মাত্র কয়েক বছরের উত্তেজনাকর সাম্প্রদায়িক ঘটনাবলীর মধ্য দিয়ে ঘটে গেছে।
জাতিগতভাবেই পাকিস্তানের শাসনভার পেল মুসলিম লীগ। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ হলেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট। প্রধানমন্ত্রী হলেন লিয়াকত আলী খান। পাকিস্তান জন্মের শুরুতেই পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ আশাহত হলো। জিন্নাহ পাকিস্তানের একনায়ক হিসাবে আবির্র্ভূত হলেন। রাষ্ট্রীয়ক্ষমতা পুরোপুরি চলে গেল পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যুরোক্রেটদের অধীনে। দেশ বিভাগের পরেও বাংলার মানুষ অবলোকন করল পাকিস্তানীদের ক্ষমতা কুক্ষিগতকরণের খেলা। তারা বুঝতে পারল বাঙালিরা ব্রিটিশদের শাসন-শোষণের যাতাকল থেকে মুক্ত হয়ে পাকিস্তানী শাসকদের যাতাকলের নিচে পিষ্ট হতে চলেছে।
১৯৪৭ সালের ৩ জুন এই উপমহাদেশ ভারত ও পাকিস্তান এই দুই ডোমিনিয়নে বিভক্ত ঘোষণার পর পূর্ব পাকিস্তানের মাটিতে সত্যিকার স্বাধীনতার জন্য এবং ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরাজ প্রতিভূ মাউন্টব্যাটনের পরিকল্পিত কাঠামোর মধ্য দিয়ে যে স্বাধীনতা পাওয়া গিয়েছিল বাংলার মানুষ সে স্বাধীনতাকে সত্যিকারের স্বাধীনতা বলে মনে করতেন না।
পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্য ছিল প্রকট। মোট জাতীয় বাজেটের সিংহভাগ বরাদ্দ থাকত পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য। পাকিস্তানের মূল শাসকগোষ্ঠী ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের। পশ্চিমা শাসকেরা পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি একচোখা আচরণ করতে থাকে। পূর্ব পাকিস্তান চরম অর্থনৈতিক বঞ্চনার শিকার হয়। এ কারণে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ পাকিস্তান সম্পর্কে হতাশ হয়ে পড়ে এবং মানুষের মনে ক্ষোভ দানা বাঁধতে শুরু করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ একদিনে শুরু হয়নি। ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলন, ৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন তথা প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন তথা ঐতিহাসিক ৬ দফা আন্দোলন ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলন এবং ৭০-এর নির্বাচন এর মাধ্যমে বাঙালিরা পাকিস্তানী শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে নির্বাচনে বিজয়ী হলেও পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী নির্বাচনে বিজয়ী সংখ্যাগড়িষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান ও তাঁর দল আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর ও পাকিস্তানী রাষ্ট্র শাসনের সুযোগ দিতে অস্বীকৃতি জানালে ১৯৭১-এর মার্চ মাস থেকে শুরু হয় সর্বাত্মক আন্দোলন। মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলের মাধ্যমে শুরু হলো পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাঙালিদের প্রকাশ্য বিদ্রোহ। এ বিদ্রোহের মাধ্যমেই শুরু হয় বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র গঠনের চূড়ান্ত আন্দোলন। বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলন বিশ্বের ইতিহাসে একটি বিরল ও নজিরবিহীন ঘটনা। মহাত্মা গান্ধী ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন করলেও তা সফল হয়নি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসহযোগ আন্দোলন কেবল সফলই হয়নি; এ অসহযোগ আন্দোলনের সিড়ি বেয়েই বাঙালিরা স্বাধীনতা সংগ্রামের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করেছিল।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পূর্ব পকিস্তানের মানুষ বুঝতে পারে তারা বৃটিশ উপনিবেশ থেকে মুক্ত হয়ে পাকিস্তান নামক নব্য উপনিবেশের অধিনে পদপিষ্ট হতে যাচ্ছে। সেই ভাবনা থেকেই এ অঞ্চলের মানুষের একটি রাজনৈতিক দল গঠনের প্রয়োজনীতা অনুভব করে। যে পাকিস্তান আন্দোলনে পূর্ব বাংলার মানুষের অবদান ছিল উল্লেখযোগ্য কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যে এ অঞ্চলের মানুষ আশাহতের বেদনায় ডুবে যেতে থাকে। তারা আরো বুঝতে পারে দ্বিজাতি তত্ত্বের নামে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়ে পূর্ব বাংলার মানুষকে নতুন এক সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পের অন্ধকারে ঢেকে দিতে অপতৎপরতা শুরু করেছে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী। ধীরে ধীরে মানুষের মনে নতুন চেতনা জাগ্রত হয় যে ধর্মীয় বিবেচনায় দ্বিজাতি তত্ত্বের স্লোগান তুলে মুসলিম অধ্যুষিত পূর্ব ও পশ্চিম দুইটি অংশে ভাগ হয়ে পাকিস্তান সৃষ্টি হলেও নৃতত্ত্ব, ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস ঐতিহ্যসহ সামগ্রিক বিষয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষের সাথে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মিল ছিল না। অধিকন্তু তাদের মধ্যে একটি বিমাতাসুলভ মনোভাব পরিলক্ষ হতে থাকে শুরু থেইে।
পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই ধর্মন্ধতার বাতাবরনে ঢেকে যেতে থাকে পাকিস্তানের রাজনীতি। সেখানে রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতায় ধর্মীয় লেবাসে মৌলবাদের বিস্তার শুরু হয়। সামন্ত জমিদার ভূস্বামী, সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে লুটেরা শাসক ও শোসকগোষ্ঠী। তারা প্রায় একচেটিয়াভাবে সামরিক, বেসামরিক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো দখল করতে থাকে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য মুসলিম লীগের বিকল্প শক্তি হিসাবে ২৩ জুন ১৯৪৯ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়। এই দলের সভাপতি নির্বাচিত হন মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন শামসুল হক। আর অন্যতম সহসভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ের মানুষ আওয়ামী মুসলিম লীগের পতাকা তলে সমবেত হতে লাগল। পাকিস্তানের রাজনীতি তখন কোন্দলের ভারে টালমাটাল অবস্থা। তাই সব শ্রেণি-পেশার মানুষ দলে দলে যোগদান করতে লাগলেন নবগঠিত এই দলে।
জিন্নাহ্ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার পর ১৯৫০ সালে আবার উর্দুকে রাষ্ট্রভাষার ঘোষণা দেন পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। পরে ১৯৪৮ সালে ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সাথে স্বাক্ষরিত চুক্তির কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি উর্দুকেই আবার রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেন। খাজা নাজিমুদ্দিনের এই ঘোষণায় যেন বারুদের গোলায় আগুন লাগে। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রতিহতের বিষ্ফোরণে জ্বলে ওঠে সারা পূর্ব পাকিস্তান। মায়ের ভাষা বাংলা ভাষাকে আপন মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে বাংলার বীর সন্তানেরা ৫২ সালের সারা ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে হরতাল ধর্মঘটসহ নানা ধরনের কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে ভাষার দাবি সুপ্রতিষ্ঠিত করার দীপ্ত শপথে রাজপথে নেমে আসে এবং একের পর এক কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে দেশব্যাপী গড়ে তুলে অগ্নিঝরা আন্দোলন। বাঙালিদের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শুরুতে ভাষা আন্দোলনের আদলে থাকলেও পরবর্তীতে সে আন্দোলনের মধ্য দিয়েই বাঙালি জাতিকে তাদের অধিকারের প্রতি সচেতন করে তুলেছিল। মহান ভাষা আন্দোলনই স্বাধীনতার বীজ অঙ্কুরিত করেছিল বাঙালিদের মনে।
শেখ মুজিবুর রহমানের দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামের ফসল ৬ দফা। আওয়ামী লীগের ১১-দফার মধ্যে নিহিত ছিল ৬ দফা। ১৯৬৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী দলের জাতীয় কনফারেন্সে বাঙালিদের মুক্তির দাবি পেশ করবেন বলেই বঙ্গবন্ধু সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সেই অনুযায়ী ৬ দফা প্রণয়ন করেছিলেন। ১৯৬৬ সালের ১৩ মার্চ আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিঠির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেদিনের বৈঠকে ৬ দফা অনুমোদিত হয়। তবে সিদ্ধান্ত হয় ১৮, ১৯, ও ২০ মার্চ অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনে অনুমোদন নিতে হবে। অবশেষে ১৮ মার্চ মতিঝিল ইডেন হোটেলে আওয়ামী লীগ কাউন্সিল অধিবেশনে ৬ দফা গৃহীত হয়।
বাঙালিদের বাঁচা মরার দাবি ঐতিহাসিক ছয় দফা উত্থাপনের পর পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর আরো প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠে। সে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে রাজনীতি থেকে চিরতরে সরিয়ে রাখতে তাঁর বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে। কিন্তু এ মামলা দায়েরের পর শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব ও জনপ্রিয়তা আরো অনেক বেড়ে যায়। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান পূর্ব পাকিস্তানে সফরকালে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে নানা ধরনের বিভ্রান্তি ছড়াতে থাকেন। পাকিস্তান সরকার ১৯৬৮ সালের ১ জানুয়ারি একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি জারি করে। এ প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, কিছু সংখ্যক সরকারি কর্মচারীকে রাষ্ট্রদ্রোহী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে। আবার ৬ জানুয়ারি আর একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গতমাসে পূর্ব পাকিস্তানে জাতি বিরোধী এক পরিকল্পনা উদঘাটিত হয়েছিল এবং সে পরিকল্পনার সাথে যুক্ত থাকায় ২৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তালিকায় দেখা যায় এদের মধ্যে দুইজন সিএসপি অফিসার ছাড়াও পাকিস্তান সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী, পিআইএ এবং ইপিআর এর লোক ও আওয়ামী লীগের কর্মকর্তা আছেন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান একটি ঐতিহাসিক অনন্য গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। শেষ পর্যন্ত এ আন্দোলনের কাছে পাকিস্তানের লৌহমানব আইয়ুব খানের নতিস্বীকারের ফলে শেখ মজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালির স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধীকারের আন্দোলন আরো গতি লাভ করে। এই আন্দোলন সফল না হলে বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ মুজিবুর রহমানের ফাঁসির আদেশ ছিল প্রায় নির্ধারিত। ঊনসত্তরের এ আন্দোলন ব্যর্থ হলে বাঙালি জাতি হয়ত আর কোনদিনই মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারত না। বাঙালিদের হয়েত সারাজীবনই পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকতে হতো। তাই এ কথা আজ দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, ঊনসত্তরের গণ অভ্যুত্থান বাঙালির স্বাধীনতা ও আত্মনিয়ন্ত্রন অধিকার প্রতিষ্ঠার সোপানে একটি অনন্যা ঘটনা।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে জাতীয় পরিষদের পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচনী ফলাফলের আওয়ামীলীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। নির্বাচনের এই ফল বাংলদেশের স্বাধীকারের দাবি আরো জোরালো হয়। কিন্তু পাকিস্তানে সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খান ভুট্টোর পরামর্শে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে তালবাহনা শুরু করে। এবং বাঙালিদের স্বাধীনতার দাবিকে স্তব্দ করে দিতে পূর্ব পাকিস্তানে গোপনে অস্ত্রের মজুদ বাড়াতে। এর প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধুও অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়। এতে পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানের শাসন ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। এতে একটি মুক্তিযুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়ে।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতের অন্ধকারে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি নিধনে ঝাঁপিয়ে পড়লে একটি জনযুদ্ধের আদলে মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা ঘটে। পঁচিশে মার্চের কালো রাতে পাকিস্তানী সামরিক জান্তা ঢাকায় অজস্র সাধারণ নাগরিক, ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, পুলিশ হত্যা করে। গ্রেফতার করা হয় বাঙালির প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের পূর্বে ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন । পরিকল্পিতত গণহত্যার মুখে সারাদেশে শুরু হয়ে যায় প্রতিরোধযুদ্ধ; জীবন বাঁচাতে প্রায় ১ কোটি মানুষ পার্শ্ববর্তী ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে। পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর), ইস্ট পাকিস্তান পুলিশ, সামরিক বাহিনীর বাঙালি সদস্য এবং সর্বোপরি বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী সাধারণ মানুষ দেশকে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর কব্জা থেকে মুক্ত করতে কয়েক মাসের মধ্যে গড়ে তোলে মুক্তিবাহিনী।
গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ চালিয়ে মুক্তিবাহিনী সারাদেশে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে অর্থনৈতিক, সামরিক ও কূটনৈতিক সাহায্য লাভ করে। ডিসেম্বরের শুরুর দিকে যখন পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর পতন আনিবার্য হয়ে ওঠে, তখন পরিস্থিতিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। অতঃপর ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণের মুখে পর্যদুস্ত ও হতোদ্যম পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তান ৯৩,০০০ হাজার সৈন্যসহ আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। এরই মাধ্যমে নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের অবসান হয়; প্রতিষ্ঠিত হয় বাঙালির জাতির প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ।
লেখক: কবি-কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট, শিক্ষবিদ ও গবেষক।