ছোটবেলাতে পড়তাম ভাব সম্প্রসারণ ‘স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে, রক্ষা করা কঠিন! ’ অনিচ্ছায় নিছক মুখস্থ করতাম, বাংলা বিরচন অংশে ভালো নাম্বার তুলার প্রয়োজনে। এখন কিন্তু এই চালসে বয়সে এসে কথাটার গুরুত্ব খুব ভালো মতোই অনুধাবন করতে বাধ্য হচ্ছি। ‘বাধ্য’ শব্দটি কেন যুক্ত করলাম। এর ব্যাখ্যাটাই হলো আমার আজকের নিবেদন।
ঠিকই তো স্বাধীন দেশের স্বাধীন চেতা নাগরিক আমরা। কোনো রাষ্ট্রীয় অমূলক সিদ্ধান্ত তো আমাদের জন্য বাধ্যতামূলক নয়। আমরা স্বাধীন, গণতান্ত্রিক দেশের মানুষ। তবু কেমন বন্দী বন্দী গুমোট একটা অবস্থা যেন আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে জাপ্টে রেখেছে। আমরা স্বাধীনতাকে সঠিক রক্ষাকবচে বাঁধতে পেরেছি কিনা এটা আসলেই ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস, সংগ্রাম ইত্যাদি বিষয়গুলোতে কেমন যেন আমরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি। এই বিষয়ক কথা বলা অর্থই শ্রোতা আর পাঠক হারানো। কিন্তু এমন কি হবার কথা ছিল! আমরা কেন এই শ্রদ্ধাবোধ হারিয়ে ফেলেছি!
কারণ সঠিক ইতিহাস, শ্রদ্ধা বিতরণ, আগ্রহ আমরা নিজেদের আর এই প্রজন্মের মাঝে তৈরি করতে পারিনি। বোর্ড বইগুলোর বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বিষয়টিতে এই দেশের স্বাধীনতা, ইতিহাস নিয়ে বিরাট অধ্যায় সংযুক্ত হবার পরও, ছাত্ররা সঠিক ইতিহাস বোধগম্য করতে পারে না। যখন মানুষ শিকড় কি তাই না জানে বা বুঝে, তখন গাছ, পাতা, ফুল ফল নিয়ে তার থেকে কি আশা করা যায়। ২৬ শে মার্চ নিয়ে বলার আগে, অনেক কিছু বলার আছে কিন্তু পাঠকদের বিরক্তির কারণ হতে চাইছি না। আমার মতে ২৬ শে মার্চ ১৯৭১ এর আগে, ২৫ শে মার্চ ১৯৭১ টা আগে ভালোমতো আত্মস্থকরণ করা প্রয়োজন।
খুব সহজে বলতে গেলে, ১৯৭১, ২৫ শে মার্চ রাতে আমরা বাংলাদেশি ছিলাম না। ছিলাম পরাধীন পূর্ব পাকিস্তানি। পাকিস্তানিরা আমাদের মতো নিরীহ নিরস্ত্র সাধারণ, অসাধারণ বিপুল মানুষকে কাপুরুষের মতো রাতের আঁধারে গুলি করে, বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে মারে।
দেওয়ালে যখন পিঠ ঠেকে যায় মানুষের, তখন বাঁচার একটাই উপায় থাকে। সেটা হলো যুদ্ধ। পাকিস্তানী নরপিশাচরা যখন আমাদের সব কেড়ে নিলো। আমাদের ভিতর যারা প্রাণে বেঁচে ছিল, তাদের মনে হলো যাক আমাদের হারানোর আর তো কিছু নেই। এবার শূন্য থেকে অর্জনের হিসাবটা শুরু হবে। সেই ভাবনা কাজ থেকে ২৬ শে মার্চ ঘোষণা হলো স্বাধীনতার।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবে না স্বাধীন করা হবেই, এই শপথে চলল নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। এর শুরুটা সেই বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে হলেও শেষ হয়েছিল ১৬ ই ডিসেম্বর ১৯৭১ এর বিজয় দিয়ে।
কিন্তু ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা, বিজয় সব কিছু দিবস হয়ে পুস্তক বন্দী হয়ে রইলো। খুব ভাবগাম্ভীর্যের সাথে আমরা এইসকল দিবসে লিখি, বক্তৃতা দিই। বড়ো বড়ো কথা বলি। কিন্তু বাস্তবে আমরা মোটেও এর কোনো সম্মান রক্ষা করতে পারিনি। আর কবে পারবো সেটাও জানা নেই।
শুধু এইটুকুই বলতে পারি। আজ আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের যে নাগরিক। যে সাহসী বীরদের দেশের যে বাসিন্দা। তাদের গুমরানো হাহাকার এখনো আকাশে বাতাসে সুর তোলে। আর আমরা সেই সুর কানে তুলি না। আমরা বধিরত্ব গ্রহণ করেছি। সম্মিলিতভাবে আমার আমাদের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য কাজ করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।
লাজ্বাতুল কাওনাইন
লেখক, শিক্ষক।