স্বামী শব্দের আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে মালিক। যেমন ভ‚স্বামী মানে ভ‚মির মালিক। স্বামীত্বের ধারণা হচ্ছে, মূলগতভাবে, মালিকানার ধারণা। ব্রিটিশ সমাজতাত্তি¡ক অ্যান্থনি গিডেন্স মনে করেন, আজ থেকে প্রায় ৫০ হাজার বছর আগে, মানুষের শিকারি-সংগ্রাহক জীবনের সূচনা হয়েছিল। আজকের দুনিয়ায় এসে বতসোয়ানার সান বুশম্যানদের মতো অল্প কিছু গোষ্ঠীর ক্ষেত্রেই এই শিকারি-সংগ্রাহক সমাজের অস্তিত্ব চোখে পড়ে। প্রকৃতির সাথে শিকারি-সংগ্রাহকদের সম্পর্ক ছিল সহজ, সাবলীল। জৈবিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য নিজেদের মধ্যে মাঝেমধ্যে রক্তক্ষয়ী দ্ব›েদ্ব লিপ্ত হলেও খোদ প্রকৃতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ লিপ্ত হয়নি আমাদের পূর্বমানুষেরা। স্বামীত্বের কোনো ধারণা সেই সময়ে ছিল না। তার মানে এই নয়, তখন মানুষ কথিত আদিম সাম্যবাদী জীবনযাপন করত, ডেভিড গ্রেইবারের মতো নৃবিজ্ঞানীরা এই আদিম সাম্যবাদের পক্ষে কোনো প্রত্নতত্ত্বীয়-নৃবিজ্ঞানীয় প্রমাণ খুঁজে পাননি। তার মানে স্রেফ এটাই যে, মানুষ তখন প্রকৃতির বন্ধু ছিল, স্বামী ছিল না। পৃথিবীর প্রথম স্বামীরা দেখা দেয় আজ থেকে ১২,০০০ বছর আগে; যখন বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষি সভ্যতার সূত্রপাত ঘটে। মানুষ আস্তে আস্তে বসতি গড়া শুরু করে, শিকারি-সংগ্রাহক সমাজগুলোর অধিকাংশই বিলুপ্ত হয়ে যায়, ইতিহাসের জাদুঘরে চলে যায়। যদিও মঙ্গোলিয়ার মতো কোথাও কোথাও পশুপালক সমাজকেও আবির্ভূত হতে দেখা যায় এই সময়, যারা কৃষি সমাজের মতো অতটা সেটেলড ছিল না, তাই তাদেরকে নিন্দার্থে যাযাবর বলা হয়েছে।
এই স্বামীত্বের ধারণা একটা সুনির্দিষ্ট গড়ন পায় আজ থেকে প্রায় ৮,০০০ বছর আগে। প্রাচীন মধ্যপ্রাচ্যে, উর্বর চন্দ্রিকায়, দজলা ফোরাতের তীরে। মিশরে, ভারতে, চীনে তৈরি হতে থাকে সভ্যতা। এগুলো অবশ্য শিল্প সভ্যতা নয়, ঐতিহ্যগত সভ্যতা। কৃষি ছিল এইসব ঐতিহ্যগত সভ্যতার অর্থনৈতিক ভিত্তি। সভ্যতা মানুষকে শিল্প-সাহিত্য-সংগীত-ক্রীড়া-স্থাপত্য-দর্শন-বিজ্ঞান দিয়েছে, এটা অনস্বীকার্য সত্য। কিন্তু আরেকটা জিনিসও দিয়েছে, সেটা হচ্ছে দাসত্ব। সভ্যতার ইতিহাস প্রকৃতির ও নারীর দাসত্বের ইতিহাস। দুনিয়াজোড়া স্বামীত্বের ইতিহাস। দখলদারিত্ব, আগ্রাসন, আর লুণ্ঠনের এক রক্তাক্ত ইতিহাস। কিন্তু ঐতিহ্যগত সভ্যতাগুলোর ধ্বংস ক্ষমতার একটা সীমা ছিল। গ্রেইবার তাঁর ‘ডেবট: ফার্স্ট ফাইভ থাউজ্যান্ড ইয়ার্স’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন, সেই সীমা কখনো ওপর থেকে সম্রাটের দিক থেকে আরোপিত হত, কখনো আরোপিত হত নিচ থেকে সমাজের দিক থেকে। কৃষি সভ্যতার সমবয়সী একেশ্বরবাদী ধর্মগুলোতে খোদা সীমা লঙ্ঘনকারীদেরকে পছন্দ করেন না এরকম একটি কথা ঘুরে ফিরে আসে, যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে, এই সীমা আরোপের আকাক্সক্ষা ঐতিহ্যগত সভ্যতাগুলোর ধ্বংসক্ষমতাকে সীমিত করার আকাক্সক্ষার সাথে সম্পৃক্ত। কিন্তু মানুষ এই সীমা লঙ্ঘন করা শুরু করে আজ থেকে ২০০ বছর আগে। শুরু হয় শিল্পায়ন। সভ্যতা প্রবেশ করে সীমাহীনতার এক নতুন যুগে।
শুরুতে এই নতুনত্ব নিয়ে ভীষণ উল্লাস ছিল। নতুন সভ্যতার পুরোহিতরা ‘প্রগতি’, ‘আধুনিকতা’, আর ‘উন্নয়ন’-এর মতো দারুণ সব চাবিশব্দ তৈরি করেছিল। সমাজবিজ্ঞানের পাঠ্যবইগুলো সারা দুনিয়ায় শিশুদেরকে শিখিয়েছে, মানুষ প্রকৃতিকে ‘জয় করেছে’, এই ‘জয় করা’ দখল-লুঠ-রক্তাক্ত করার সুভাষণ মাত্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এই সভ্যতা একটা ধাক্কা খায়। শুধু ইউরোপেই এক কোটি মানুষের মৃত্যু হয়। জার্মান নাৎসিরা ষাট লক্ষ ইহুদিকে হত্যা করে। ব্রিটিশদের উপনিবেশিক নীতির কারণে অবিভক্ত বাংলায় চল্লিশ লাখ মানুষ না খেয়ে মারা যায়, যুদ্ধের সাথে যাদের সরাসরি কোনো সম্পর্ক ছিল না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে আনবিক বোমা ফেলে মুহূর্তের মধ্যে দুই লক্ষ মানুষকে লাশে পরিণত করে। এরপর ভিয়েতনাম থেকে ইরাক, ফিলিস্তিন থেকে কাশ্মীর, আর সিরিয়া থেকে ইয়েমেন দুনিয়ার দেশে দেশে স্বামীগিরি ফলানোর ইতিহাস। যার শিকার হয়েছে পশু ও শিশুরা, প্রকৃতি ও নারী, এবং ক্ষমতার দিক থেকে পিছিয়ে থাকা পুরুষরাও। তাতে অবশ্য নতুন স্বামীদের হুঁশ ফেরেনি। স্বামীত্বের সবচে বড়ো প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্র টিকে আছে। টিকে আছে স্বামীত্বের সহযোগী প্রতিষ্ঠান বিশ্বব্যাংক, আইএমএফও।
কী তার ফল? বৈশ্বিক উষ্ণতায় আর্কটিকের পারমাফ্রস্ট পর্যন্ত গলে যাচ্ছে! গ্রেটা থুনবার্গের মতো শিশুরা আজকে তাদের বাপ-মা’দের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে কতটা আত্মঘাতী এই কথিত সভ্যতা।
ব্রিটিশ দার্শনিক ফ্রান্সিস বেকন বলেছিলেন, প্রকৃতি এক রহস্যময়ী, যার সিক্রেট জানতে প্রয়োজনে তার ওপর টর্চার করাও গ্রহণযোগ্য। অর্থাৎ, ভালোবাসা নয়, স্বামীত্বের কেন্দ্রে আছে ধর্ষকামিতা। ভারতীয় পদার্থবিজ্ঞানী ও প্রতিবেশবিদ বন্দনা শিবা দেখিয়েছেন, আধুনিক বিজ্ঞানের খোদ দর্শনটাই স্বামীত্বের ধারণার সাথে সম্পৃক্ত, ফলে বিজ্ঞান অন্তর্নিহিতভাবে খারাপ কিছু না হলেও যা কিছু বিজ্ঞানের নামে হাজির হয় তাকেই চিন্তাহীনভাবে গ্রহণ করাটা সমস্যাজনক।
ধারণার জগতে স্বামীত্বের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে বন্ধুত্ব। জিম মরিসনের গানের ভাষায়, “বন্ধু তো সে, যে তোমাকে পেতে দেয় পূর্ণ স্বাধীনতা, যেন তুমি হয়ে ওঠো তুমিই নিজে (অনুবাদ- সেলিম রেজা নিউটন, ধর্ষণ বলপ্রয়োগ বলাৎকার, অরাজ)। স্বামীত্ব মালিকানার প্রতিশব্দ, আর বন্ধুত্ব প্রতিশব্দ স্বাধীনতার।
২৪০০ খ্রি. পূ নাগাদ দজলা ও ফোরাত নদীর তীরবর্তী সভ্যতায় স্থানীয় কর্মকর্তা আর ধনী বণিকরা আর্থিক সংকটে নিপতিত চাষীদেরকে সম্পত্তি বন্ধক রাখার বিনিময়ে ঋণ দেয়া শুরু করে। যারা এই ঋণ শোধ করতে ব্যর্থ হত, তাদের সব সম্পত্তি নিয়ে নেয়া হত। শুরুটা হত শস্য, পশু, আর আসবাবপত্র দিয়ে। তারপর আসতো জমিজমা আর ঘরবাড়ি বন্ধক রাখার, অথবা বিকল্প হিসেবে বা চ‚ড়ান্তভাবে, পরিবারের সদস্যদের বন্ধক রাখার পালা। সবার আগে যেত দাসদাসীরা, এরপর শিশুরা, স্ত্রীরা, আর কিছু চরম পরিস্থিতিতে, খোদ ঋণগ্রহিতা। এরা ঋণবন্দীর স্তরে নেমে যেত, যারা ঠিক দাস না হলেও, ঋণদাতার গৃহে, বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে, মন্দিরে বা প্রাসাদে বেগার খাটতে বাধ্য হতো। তত্ত¡গতভাবে, ঋণগ্রহিতা ঋণ শোধ করে দিলেই এরা মুক্ত হয়ে যেতে পারত, কিন্তু সম্পত্তি হারানো ঋণগ্রহিতাদের জন্য ঋণ শোধ করা ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠত।
এই ঋণের প্রভাব ছিল ভয়ানক, পুরো সমাজ ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়ার হুমকির সম্মুখীন হতো। একটা বাজে ফসলের বছরে একের পর এক চাষী পরিবার ঋণবন্দিত্বের জালে আটকে যেত, এতে ভেঙে পড়তো পরিবারগুলো। ঋণগ্রস্ত চাষীরা দখলদারিত্বের ভয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেত, আধা-যাযাবর বিভিন্ন দলে যোগ দিতো, যেগুলো গড়ে উঠেছিল নগরসভ্যতার প্রান্তে অবস্থান করা মরুভ‚মিতে। পুরো সমাজব্যবস্থার ভেঙে পড়ার এই আশঙ্কার সম্মুখীন হয়ে, সুমেরীয় ও পরবর্তী বাবেলনীয় রাজারা সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করতেন। তাঁরা ডিক্রি জারি করে সব ভোক্তা ঋণ মকুব করে দিতেন, বাণিজ্যিক ঋণের ওপর অবশ্য প্রভাব পড়ত না। সব জমিজমা আদি মালিকের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হতো, ঋণবন্দীদেরকে তাদের পরিবারের কাছে ফিরে যাওয়ার সুযোগ দেয়া হতো। ক্রমেই এটা একটা রেওয়াজে পরিণত হয়, যে রাজারা ক্ষমতা হাতে পাওয়া মাত্র, এমন কোনো মহৎ ঘোষণা দেবেন।
সুমেরে এই ঘোষণাগুলোকে বলা হতো ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’। নথিভুক্ত ইতিহাসে স্বাধীনতার সমার্থক প্রথম যে-শব্দটি মানুষের কোনো ভাষায় পাওয়া গেছে, তা একটি সুমেরীয় শব্দ: অসধৎমর। অসধৎমরর আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে মায়ের কাছে ফেরা, কারণ মুক্তিপ্রাপ্ত ঋণবন্দীরা আর সবকিছুর আগে, ঠিক এই কাজটিই করত।
স্বামীত্ব নয়, বন্ধুত্ব এই পৃথিবীকে রক্ষা করবে। মানুষ মুক্ত হোক। সে তার মায়ের কাছে, প্রকৃতির কাছে ফিরুক।
ইরফানুর রহমান : লেখক ও কলামিস্ট।