দেশের ওপর দিয়ে বইছে মহামারি করোনাভাইরাসের তৃতীয় ঢেউ। সংক্রমণ মোকাবিলায় ১১ দফার পর নতুন করে ৫ দফা নির্দেশনা দিয়ে বিধিনিষেধ কার্যকর করেছে সরকার। নতুন এই বিধিনিষেধের আওতায় দ্বিতীয় দফা ২ সপ্তাহের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকা অনুসারে শনাক্তের হার ৫ শতাংশের বেশি ১৪ দিন অব্যাহত থাকলে যেখানে মহামারি হিসেবে গণ্য করার কথা বলা হয়েছে সেখানে এখন সংক্রমণের হার অনেকটাই বেশি। পরিস্থিতি যে দিকে যাচ্ছে তাতে সংক্রমণের হার নিশ্চিতভাবেই আরও বাড়বে।
গত বছর জুনে ডেল্টা ধরনে শনাক্তের হার ৩০ শতাংশ ছাড়ালেও ডিসেম্বরেই শনাক্তের হার নেমে এসেছিল দেড় শতাংশের নিচে। তবে এযাবৎকালে করোনার সবচেয়ে ছোঁয়াচে ধরন ওমিক্রন শনাক্ত হওয়ার পর থেকে হু-হু করে বাড়ছে সংক্রমণের হার। নতুন এই ধরনটি আফ্রিকার দেশ বতসোয়ানায় উদ্ভব হয়ে ইউরোপ আমেরিকা দাপিয়ে এখন ঝাঁপিয়ে পড়েছে দক্ষিণ এশিয়ায়, বিশেষত ভারত-বাংলাদেশে। এখন যে মাত্রায় সংক্রমণ ছড়াচ্ছে এমন মাত্রায় সংক্রমণ দেখা দেওয়ার পর গত বছরের জুলাইয়ে দেশে লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছিল। ফলে নতুন এই ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে উদ্বেগের পরিপ্রেক্ষিতে সবচেয়ে বড়ো যে প্রশ্নটি সামনে আসছে তা হলো-আবারও লকডাউন দেয়া হবে কিনা?
গত দুই বছরে কয়েক ধাপের লকডাউন দেখে মানুষের এই বিশ্বাস জন্মেছে যে, লকডাউন নামের পদ্ধতিটি শ্রমজীবী ও বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের ভোগান্তি কয়েক ধাপ বাড়িয়ে দেওয়ার একটা প্রহসন। তাছাড়া, আরেকটি মজার ব্যাপার হচ্ছে এদেশের সর্বাত্মক লকডাউনও অন্যান্য দেশের মতো নয়। ঢিলেঢালাভাবে ছুটির আমেজ নিয়ে চলে। তাছাড়া আমাদের এটাও বুঝতে হবে এদেশের মানুষ ইউরোপ-আমেরিকার মতো শিক্ষিত, সচেতন বা বিত্তশালী নয়। এদেরকে কাজ করে খেতে হয়, কাজের জন্য বাইরে যেতে হয়। অন্যদিকে সরকার যে ত্রাণের ব্যবস্থা করে নানা ঘাট পার হয়ে সেটার যতটুকু নিম্নবিত্তের হাতে পৌঁছায় তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। ফলে লকডাউনের যে উদ্দেশ্য-জনগণকে ঘরের মধ্যে রাখা, গণজমায়েত থেকে বিরত রাখা, এটার পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন এখানে সম্ভব হয় না।
অন্যদিকে, লকডাউনের কারণে কল-কারখানা অফিস আদালত এবং বিভিন্ন অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলে কোটি কোটি মানুষের জীবনে অন্ধকার নেমে আসে। তাছাড়া প্রতিবার লকডাউন ঘোষণার পরপরই লাখ লাখ মানুষের ঢাকাশহর ত্যাগের যে চিত্র আমরা দেখেছি-সংক্রমণ আরও বেশি ছড়ানোতে ভূমিকা রেখেছে সেটি। লকডাউন ঘোষণা দিয়ে গণপরিবহণ, ট্রেন, লঞ্চ ও দূরপাল্লার বাস বন্ধ করে দেওয়া হলেও ঝোলাঝুলি করে, হেঁটে, পিকআপ ভ্যান, ট্রাক ও ট্রাকের ড্রামে করে কিংবা ভ্যানগাড়িতে চেপে যেভাবেই হোক লাখ লাখ মানুষ গ্রামে ফিরেছে। আবার লকডাউন খুলে দেওয়ার পর একইভাবে ফিরেও এসেছে তারা।
লকডাউনের বিরুদ্ধে অবস্থান শক্ত হওয়ার আরেকটি কারণ হলো, এই ভাইরাসটি সম্পূর্ণ চলে যাবে না, বরং এটা স্থানীয় রোগে পরিণত হবে বলে মনে করছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডঐঙ)। ভাইরাসটি এখন যে চেহারা পেয়েছে, তাতে একে আর প্যানডেমিক বা মহামারি হিসেবে না দেখে এনডেমিক বা ফ্লুর মতো একটি সাধারণ রোগ হিসেবে বিবেচনা করার আহ্বান জানিয়েছে স্পেন। তারা বলছে, কোভিডকে সঙ্গে নিয়েই মানুষকে বসবাস করতে হবে, এটা মেনে নেওয়ার সময় এসেছে। এই ধারণাটি ইউরোপের সর্বত্র ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।
ভাইরাসটি বছরের পর বছর ধরে থেকে যাওয়ার মানে হচ্ছে প্রতি বছরই কোনো না কোনো সময়ে সংক্রমণও বৃদ্ধি পাবে। এভাবে হিসেব করলে প্রতি বছরেই নির্দিষ্ট একটা সময়ে লকডাউন দিতে হবে। কিন্তু এটা তো কোনো সমাধান হতে পারে না। গত ৯ জানুয়ারি ব্রিটিশ শিক্ষামন্ত্রী নাদিম জাহাভি বলেছেন, তার দেশও করোনাকে মহামারি থেকে স্থানীয় রোগ হিসেবে বিবেচনা করার ব্যাপারে ভাবছে। এর কারণ হচ্ছে, সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার পরও করোনার নতুন ধরন ওমিক্রনের প্রভাব হাসপাতালে তেমন পড়েনি। মানে দাঁড়াচ্ছে, গত দুই মাস ধরে ওমিক্রন নিজের যে বৈশিষ্ট্য দেখাচ্ছে, তা যদি সামনের দিনগুলোতেও চলতে থাকে, তাহলে কোভিড ভীতিতে নিশ্চিতভাবেই লাগাম পড়বে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
তাছাড়া, বিশ্বের দেশে দেশে লকডাউনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ বিক্ষোভ করছে। এ প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকারও আপাতত লকডাউন দেওয়ার মতো কোনো সিদ্ধান্তে যাচ্ছে না। তবে ভবিষ্যতে যে লকডাউন দেওয়া হবে না এমন সম্ভাবনাও তারা নাকচ করেনি। এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই লকডাউনের পরিবর্তে গণসচেতনতা তৈরির আহ্বান জানিয়েছে।
এর প্রধানতম কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে লকডাউন দেওয়া কোনো সমাধান নয়। কারণ, এখানে জনসংখ্যা এত বেশি যে তার বড়ো একটি অংশকে বসিয়ে রেখে সরকারের একার পক্ষে মৌলিক চাহিদার যোগান দেয়া সম্ভব নয়। তাই সরকার লকডাউন ঘোষণা করলেও বেশিরভাগ মানুষকে মানানো যায় না। এর পরিবর্তে স্বাস্থ্যবিধি মানা এবং টিকা কার্যক্রমে জোর দিতে হবে। মাঝখানের সময়টায় সরকারিভাবে কঠোরতা না থাকায় মাস্ক পরতে মানুষের সচেতনাবোধও শূন্যের কোঠায় চলে এসেছিল। তাই, স্বাস্থ্যবিধি মানানো বা মাস্ক পরার বিষয়ে আগের মতোই কঠোর অবস্থানে ফেরার সময় এসেছে।
আরেকটি ব্যাপার হলো, গতবছর করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলার সময়ে সরকারের নির্দেশনায় পাড়া-মহল্লায় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছিল। পুনরায় ওই কমিটিগুলো আবার সচল করা হলে মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো সম্ভব হবে। এই কাজটি শুরু করতে হবে অবিলম্বে। সরকারের উচিত এই কমিটিগুলো সচল করার ব্যাপারে অবিলম্বে প্রশাসনকে কাজে লাগানো। অন্যদিকে, এই মুহূর্তে প্রচুর ভ্যাকসিন হাতে থাকার পরও শুধু ম্যানেজমেন্ট এবং সঠিক প্রচারণার অভাবে দেশের বিরাটসংখ্যক মানুষকে টিকার আওতায় আনা যাচ্ছে না। এজন্যও যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে।
পাশাপাশি ১২-১৭ বছর বয়সী প্রায় এক কোটি স্কুলশিক্ষার্থীকে যত দ্রুত সম্ভব টিকার আওতায় নিয়ে আসতেও ত্বরিত পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় গত দু-বছরে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে শিক্ষার্থীদের। আবারও দীর্ঘ সময়ের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে রাখার মতো পদক্ষেপ নেওয়া হলে সেটা শিক্ষার্থীদের ওপর দীর্ঘস্থায়ীভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
জীবন না জীবিকা কোনটি অগ্রাধিকার পাবে, এই টানাপোড়েনে গত দুই বছরে বেশ কয়েকবারই সংকটজনক অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এতদিন জীবন বাঁচানোর প্রক্রিয়াকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হলেও এখন জীবিকা বাঁচানোর তাগিদকেও গুরুত্ব দেওয়ার সময় এসেছে। কারণ, এই ভাইরাসটি পুরোপুরি নির্মূল হবে না। তাছাড়া করোনায় সংক্রমিত হলে মৃত্যুর শঙ্কা যা, তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ বিপদাপন্ন হয় যদি জীবিকা অনিশ্চিত হয়। তাছাড়া দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির ওপরও এটা বিরূপ প্রভাব ফেলে। তাই লকডাউনের বিকল্প পদ্ধতি খোঁজা জরুরি হয়ে পড়েছে। কর্মঘণ্টা বাড়িয়ে শিফটভিত্তিক কাজ, খাত অনুযায়ী কাজের সময়ের শিডিউল, স্বাস্থ্যবিধি মানতে পর্যাপ্ত নজরদারির ব্যবস্থা এবং টিকা কার্যক্রম আরও জোরদার করা এটার ভালো বিকল্প হতে পারে।
মর্তুজা হাসান সৈকত : কলামিস্ট ও লেখক।