জ্বালানি হিসেবে তেল-গ্যাসের গুরুত্ব পরাশক্তিগুলোর কাছে বরাবরই রয়েছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন ও ক্রমবর্ধমান পরিবেশ দূষণের ফলে এর বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিচ্ছে সুপেয় পানি।
অনেক বিশেষজ্ঞদেরই ধারণা, কখনও তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হলে, তা হবে জলাধারের দখল নিয়ে। ১৯৭৯ সালে মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত বলেছিলেন, অন্য কোনো ইস্যুতে যুদ্ধে না জড়ালেও কেবল পানির জন্য ‘যুদ্ধেও যেতে পারে মিশর’।
নীল নদের অববাহিকা দীর্ঘদিন ধরেই বেশ ঝঞ্ঝাটপূর্ণ। বুরুন্ডি, মিশর, ইরিত্রিয়া, ইথিওপিয়া, কেনিয়া, রুয়ান্ডা, সুদান, টানজানিয়া, উগান্ডা এবং ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অফ কঙ্গোÑএই ১০টি দেশের ওপর দিয়ে বসে চলেছে নীল নদ। এখন পর্যন্ত এই দেশগুলো মিলে কেবল ২৫ কোটি মানুষ হলেও সে সংখ্যা বেড়ে চলেছে দ্রæতই।
এত কম জনবসতিতেই যদি মিশর যুদ্ধে যাওয়ার কথা চিন্তা করতে পারে, বাংলাদেশ বা এশিয়ার অন্য ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোর অবস্থা কী হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। সমুদ্রের সমস্যা ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সহজেই মেটানো সম্ভব হলেও, নদীর পানির অবস্থা তথৈবচ।
দীর্ঘদিন ধরে ভারতের সঙ্গে যৌথ নদীর পানিবণ্টন নিয়ে চলছে তিক্ততা। এর সবশেষ উদাহরণ তিস্তা। শুধু আন্তর্জাতিক রাজনীতি নয়, অভ্যন্তরীণ রাজনীতিও এই টানাপড়েনের আগুনে ঢালছে ঘি। বিজেপির নরেন্দ্র মোদীকে আটকাতে পশ্চিমবঙ্গে মমতা ব্যানার্জির জন্য বড়ো ধরনের অস্ত্রের নামÑতিস্তা। বিজেপি সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি করতে চাইলেও, মমতার দাবি, তাঁর রাজ্যেই ঠিকমতো তিস্তার পানি মিলছে না, ভাটির দেশে বেশি পানি ছেড়ে দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
তবে ভারতের পানি নিয়ে টানাটানি শুধু অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বললেও ভুল হবে, অনেকক্ষেত্রে সত্যিকার অর্থেই পানির সংকট ব্যাপক প্রবল হয়ে দেখা দিচ্ছে।
কাবেরী নদীর উৎস কর্ণাটক রাজ্যে হলেও তা তামিলনাড়ুর মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সাগরে মিশেছে। কাবেরী নদীর পানিবণ্টন নিয়ে ভারতের প্রতিবেশী দুই রাজ্য কর্ণাটক ও তামিল নাড়–র বিবাদ কয়েক দশকের। দুই রাজ্যই বলছে কৃষিতে সেচের জন্য এই পানি দরকার।
শেষ পর্যন্ত এ বিবাদ গড়িয়েছে আদালত পর্যন্তও। ২০১৬ সালে দেশটির সুপ্রিম কোর্ট কর্ণাটক রাজ্যকে প্রতিবেশী তামিলনাড়–তে আরো বেশি পানি সরবরাহ করার নির্দেশ দিয়ে এক রায় দেয়। রায়ের প্রতিবাদে কর্ণাটকের রাজধানী বেঙ্গালুরুতে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়, পুলিশের গুলিতে নিহত হয় একজন।
আসি বাংলাদেশের কথায়। ছোটবেলা থেকে পড়ে আসছি, বাংলাদেশ দেশ। শত শত নদীর পলিতে গড়ে ওঠা বিশ্বের বৃহত্তম এই বদ্বীপে পানি নিয়ে কখনও চিন্তা করতে হবে, ভাবা যায়?
কয়েক বছর আগে পানি নিয়ে রিপোর্ট করতে গিয়ে বেশ কিছু নতুন তথ্য জানতে পেরেছিলাম। প্রথমত, মাটির নীচে যে পানির পকেট থাকে, যাকে একুয়াফার বলা হয়, সেখান থেকে দ্রæতই পানি নিঃশেষ হচ্ছে।
নদীর পানি পরিশোধন করে বেশিরভাগ পানির চাহিদা মেটানোর কথা কয়েক বছর আগে বলেছিলেন ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক। সরকারের নাকি যমুনা নদী থেকে পানি পরিশোধন করে ঢাকায় চাহিদা মেটানোর প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু এই কয়েক বছরেও সে বিষয়ে কোনো আপডেট নজরে আসেনি।
ঢাকার একুয়াফারে যে পরিমাণ চাপ পড়ছে, কংক্রিটের জঙ্গলে পরিণত হওয়ার কারণে বৃষ্টির পানি, এবং আমাদের ব্যবহৃত পানি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় তা পূরণ করতে পারছে না।
ঢাকার চারপাশে চার নদীÑবুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা আর বালু। তুরাগ আর বালু তো আমরা দখল করতে করতে ধীরে ধীরে মৃতপ্রায় নদীতে পরিণত করেছি। বুড়িগঙ্গা আর শীতলক্ষ্যা বেঁচে আছে ধুঁকে ধুঁকে। যে পানি আমাদের অফুরন্ত সম্পদ হতে পারত, সেটিকেই আমরা বছরের পর বছরে ধরে খুন করছি।
তবে ভ‚-গর্ভস্থ পানির অতিব্যবহার আর ভ‚-উপরিস্থ পানির দূষণ আমাদের কোন পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে, পানির অভাবে মৃত্যুর কাছাকাছি যাওয়ার আগ পর্যন্ত হয়ত আমরা চোখ বন্ধ করেই থাকব।
বিভিন্ন পরিসংখ্যানমতে, পৃথিবীর এক বিলিয়ন মানুষ, অর্থাৎ প্রতি সাত জনে একজন নিরাপদ পানি পান না। প্রতি বছর ৩৪ লাখ মানুষ পানির দূষণ, ও পানি সংক্রান্ত রোগবালাইয়ের কারণে মৃত্যুবরণ করেন। তারপরও আমাদের সেদিকে যথেষ্ট নজর নেই।
শেষ করি রাইনের গল্প দিয়ে।
রাইন নদীর নিজের কোনো মাছ নেই।
ইউরোপের ঠিক মধ্যিখানে ৬টা দেশের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে রাইন নদী। নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, লিশটেনশ্টাইন এবং সুইজারল্যান্ড।
মূলত রাইনের বড়ো অংশ পড়েছে জার্মানিতেই। আর এই নদীর তীর ঘেঁষেই গড়ে উঠেছিলো সভ্যতা। শিল্প বিপ্লবের সময় থেকে পানির প্রয়োজন, নদীপথের যাতায়াত, বর্জ্য নিষ্কাষণ সব মিলিয়ে রাইনের পাড়েই গড়ে ওঠে বড়োবড়ো সব শিল্পকারখানা। বিশ শতকের ৭০ থেকে ৮০ সালের দিকে এই দূষণ চরম আকার ধারণ করে। রাইনকে তখন বলা হতো ইউরোপের পয়ঃনিষ্কাশন প্রণালী। একসময় রাইন নদীর স্যামন ছিলো বিশ্ববিখ্যাত। স্বাদে, গন্ধে অতুলনীয়। কিন্তু পরে ধীরে ধীরে এত বিষাক্ত হয়ে ওঠে রাইন, শুধু স্যামন না, সব ধরনের মাছই এই নদী থেকে বিলুপ্ত হয় চিরতরে। মরার ওপর খাঁড়ার ঘা। ১৯৮৬ সালে সুইজারল্যান্ডের বাসেলে ঘটে বিশাল এক রাসায়নিক দুর্ঘটনা। রাইনের পানিতে বিষাক্ত রাসায়নিক মিশে কয়েকশ’ কিলোমিটার ভাটিতেও প্রায় সব প্রাণী মারা যায়। অথচ সেই বছরই যখন ডাচ পানিসম্পদ মন্ত্রী নিলি ক্রোয়েস বললেন, ‘আমি নদীতে স্যামন মাছ ফেরত চাই’, স্বভাবতই সবাই তাঁকে পাগল বলেই ধরে নিয়েছিল।
কিন্তু এই পাগলাটে মহিলা তা বাস্তবে করে দেখিয়েছিলেন। এই কাজে খরচ হয়েছিল প্রায় ২৫ বিলিয়ন ইউরো। অর্থাৎ, প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা, যা বাংলাদেশের এখনকার জাতীয় বাজেটের অর্ধেকের চেয়েও বেশি। ছয় দেশ মিলে গঠন করে আন্তর্জাতিক রাইন রক্ষা কমিশন। রাইন নদীকে মোটামুটি পরিষ্কার করা গেছে গত তিন দশকের আপ্রাণ চেষ্টায়। মাছও ধীরে ধীরে ফিরতে শুরু করেছে। ছয় দেশের রাইন নদী দূষণমুক্ত করা গেলে এক দেশের বুড়িগঙ্গা কেন হবে না! সমস্যাটা কিসে?
ব্রিটিশ কবি স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজের ‘দ্য রাইম অফ দ্য এনশিয়েন্ট মেরিনার’ কবিতার একটি পংক্তি মনে পড়ছে। ‘ওয়াটার ওয়াটার এভরিহোয়্যার, নর অ্যানি ড্রপ টু ড্রিঙ্ক’, অর্থাৎ সবদিকে পানি, কিন্তু পান করার পানি নেই। এই দীর্ঘ-কবিতায় নাবিকদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া এক অ্যালবাট্রস পাখিকে গুলি করে হত্যা করেন এক নাবিক। ফলশ্রæতিতে পথহারা নৌকার সবাইকে আটকে পড়তে হয় অ্যান্টার্কটিকার পানিতে।
আমরাও কি সেই বোকা এনশিয়েন্ট মেরিনারে পরিণত হচ্ছি দিন দিন? যে পানি আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে, সে পানিকে আমরাই ধ্বংস করছি নিজ হাতে।
এনশিয়েন্ট মেরিনার বা প্রাচীন নাবিক পাগল হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে নিজের বোকামির গল্প সবাইকে বলে বেড়াত। আমাদের বোকামির গল্প বলার জন্য হয়ত কেউ বেঁচেও থাকবে না।
অনুপম দেব কানুনজ্ঞ : লেখক ও কলামিস্ট।