আমাদের সমাজে নিজের অজান্তেই এমন এক রোগ চলে এসেছে যা কোনোভাবেই কোনো চিকিৎসা দ্বারা বন্ধ করা যাচ্ছে না। এমন এক রোগ, যেই রোগের কোনো প্রতিষেধক এখন পর্যন্ত আবিস্কৃত হয়নি, যার কারণে সেই রোগে যারা একবার আক্রান্ত হয়েছেন তারা কোনোভাবেই আর রোগমুক্ত হচ্ছেন না। এই রোগের নাম পরকীয়া। বিশ বছর আগেও বাংলাদেশে এই পরকীয়া রোগের খুব একটি অস্তিত্ব ছিল না, কিন্তু ভারতীয় বাংলা ও হিন্দি জনপ্রিয় সিরিয়ালগুলো থেকে আমাদের দেশের একশ্রেণির মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়ে গেছেন। যেখান থেকে ফিরে আসা অনেকটাই কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে যাচ্ছে।
আমাদের আশে-পাশের দেশগুলোতে এই পরকীয়া রোগ বিস্তৃতি লাভ করলেও আমাদের দেশের ধর্মীয় বিধি-বিধানের কারণে কেউ এই রোগে আক্রান্ত ছিলেন না, যেটা আগেই উল্লেখ করেছি ভারতীয় বাংলা ও হিন্দি সিরিয়াল দেখে এই রোগে প্রতিদিন কিছু রোগী তৈরি হচ্ছে। ভারতীয় টিভি সিরিয়ালগুলো বা ধারাবাহিক জনপ্রিয় অনুষ্ঠানগুলোতে দেখবেন স্বামী পরস্ত্রীর প্রতি আসক্ত আবার স্ত্রী পরপুরুষের প্রতি আসক্ত। যেই শিক্ষাটা আমাদের দেশে অনেকেই গ্রহণ করেছেন, যে কারণে সামাজিক বন্ধন অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেছে। স্বামী-স্ত্রীর প্রতি যেই প্রেম-আবেগ ছিল সেটা আস্তে আস্তে কমে আসছে। পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে, তাঁর প্রধান কারণ আমাদের জীবন থেকে ধর্মীয় বিধি-বিধান যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হয় না। যার ফলে আমরা মুখে ধর্মের কথা উচ্চারণ করলেও ব্যক্তিগত জীবনে তা প্রয়োগ ঠিকমত করছি না। সামাজিক বন্ধন অনেকটাই কমে গেছে। আমাদের সমাজে যৌথ পরিবারের সংখ্যা খুবই কম, যার ফলে কেউ কারো দিকে নজর দিতে পারছেন না, বাবা-মা সন্তানদের প্রতি মনোযোগ দিতে না পারার ফলে সন্তানরা যা খুশি তাই করার সুযোগ পেয়ে যাচ্ছেন, এই সুযোগটা তাদেরকে করে দিয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক। আমাদের দেশে ফেসবুক আসার আগে এতটা অশ্লীলতা ছিল না, যেটা এখন অনেকটাই প্রকাশ্যরূপ নিয়েছে। সামাজিক ও মনোরোগ বিশেজ্ঞরা এই জন্য পরিবারের অভিভাবকদের দায়ী করছেন। সন্তান কোথায় যাচ্ছে, কার সাথে চলা ফেরা করছে এটা নজরদারী আর হচ্ছে না। একজন বিবাহিত নারী স্বামীর চোখ ফাঁকি দিয়ে একজন অবিবাহিত পুরুষ বা বিবাহিত পুরুষের সাথে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ছেন, একই কথা পুরুষদের জন্যও প্রযোজ্য। মূলত স্বামী স্ত্রীর মধ্যে শারীরিক ও মানসিক দূরত্ব যখন তৈরি হয়, আর্থিক টানাপোড়ন যখন সংসারে চলে আসে তখন সংগত কারণেই পরিবারে মনোমালিন্যের তৈরি হয়। বিবাহিত নারী যখন দেখতে পান তার স্বামীর চাইতে অনেকগুণ বেশি আর্থিকভাবে স্বচ্ছল একপুরুষ তার প্রতি দুর্বল তখন তিনি নিজের অজান্তেই অথবা লোভের বশবর্তী হয়ে ঐ দুষ্ট পুরুষের ফাঁদে পা দিয়ে দেন। তিনি মনে করেন তার এই নতুন প্রেমিক তার জীবনের জন্য আলো হয়ে এসেছেন, কিন্তু তার জানা নেই স্বামীকে ফেলে যার সাথে তিনি পরকীয়া করছেন তিনি ক্ষণিকের অতিথি। বেশিদিন থাকার জন্য তিনি তার জীবনে আসেননি, আবার অনেক সময় এটাও দেখা যায় স্বামী-সন্তানকে ফেলে রেখে তিনি আরেক পুরুষের সাথে বেরিয়ে পড়েছেন। নতুন জীবন শুরু করেছেন, কিন্তু হায় এই জায়গায় এসেও তিনি আর আগের মতো সুখ খুঁজে পান না, কারণ যাকে তিনি নতুন জীবন সঙ্গী বানিয়েছেন তিনি এধরনের ঘটনা হয়ত একাধিকবার ঘটিয়েছেন। ঐ মানুষের অনেক অর্থবিত্ত থাকার কারণে তিনি যা খুশি তাই করে বেড়ান। এই সমাজ তাকে কখনোই নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে না। তার কারণ সমাজের প্রভাবশালীদের কীভাবে নিজের অনুগত বানিয়ে রাখতে হবে এই কৌশলটা তিনি জানেন। আবার সমাজ যাদের দ্বারা পরিচালিত হয় সেই পুরুষশাসিত সমাজে অনেক খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব, বাড়িতে স্ত্রী সন্তান থাকা সত্তে¡ও পরস্ত্রীর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছেন, যার প্রতি আসক্ত হয়েছেন তারও যে স্বামী সন্তান আছে, এই বিষয়টি তিনি ভাবেননি। এর পরিণতি কী এটাও তিনি জানেন না।
পরকীয়া আসক্ত ব্যক্তি যেই ধর্মবিশ্বাসী হোন না কেন, কোনো ধর্মেই পরকীয়াকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। বরং এই পরকীয়াকে ব্যভিচারের সাথে তুলনা করা হয়েছে। কিন্তু সমাজে যখন ধর্মীয় অনুশাসন যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয় না তখন নানাধরনের ব্যাধি সমাজে ছড়িয়ে পরে, এর একটি অন্যতম ব্যাধি হচ্ছে পরকীয়া। পরিবার থেকে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থেকে যদি পরকীয়ার কুফল সম্পর্কে যথাযথ শিক্ষা দেয়া হয়, তাহলে এই পরকীয়া আমাদের সমাজ থেকে আস্তে আস্তে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কিন্তু সেই সম্ভাবনা খুবই কম, কারণ কোনো প্রতিষ্ঠান থেকেও পরকীয়ার বিরুদ্ধে কোনো শিক্ষা দেওয়া হয় না। এছাড়া যতদিন ভারতের ধারাবাহিক হিন্দি ও বাংলা সিরিয়ালগুলোতে এই পরকীয়ার ঘটনাগুলো দেখানো হবে, ততদিন পর্যন্ত একশ্রেণীর বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষ পরকীয়ার প্রতি আসক্ত হতে থাকবেন।
টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া যেখানেই গিয়েছি, সেখাইে দেখেছি সামাজিক ক্ষতস্থান। অনেক পরিবারকে দেখেছি পরকীয়ার জন্য তাদের সংসারে অশান্তির আগুন জ্বলছে। বাড়ি, গাড়ি, এসি, ফ্রিজ এবং বিলাসীতার সবকিছু আছে, নেই শুধু সুখ পাখিটা যা কেড়ে নিয়েছে পরকীয়া। আমাদের সমাজে অনেক পরিবার আছে, যেখানে মা আছেন তো বাবা নেই, বাবা আছেন তো মা নেই। সন্তানরা যখন দেখতে পায় বাড়িতে মা আছেন বাবা নেই, বাবা আছে তো মা নেই , তখন এই শূন্যতা সন্তানদেরকে মানসিকভাবে অসুস্থ করে তোলে। নতুন বাবা বা নতুন মা এটা অনেকটা নতুন পোশাকের মতো, যদি তারা বাবা-মাকে দেখতে পেত তাহলে আগামী প্রজন্ম এই পরকীয়ার ব্যাধি থেকে কিছুটা মুক্তি পেত, কিন্তু সেটা আর হচ্ছে না, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে আমাদের অনেক প্রিয় তারকারাও এই ব্যাধিতে আক্রান্ত। তাদের নাম উল্লেখ না করেই বলব, তাদের যারা অনুসারীভক্ত তারাও তাদের প্রিয় তারকার কাছ থেকে এই নোংরা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন, ঐ তারকারা সমাজের একটি ক্ষুদ্র অংশ, যাদেরকে অনুসরণ, অনুকরণ করার কোনো প্রয়োজন নেই, অনুকরণ যদি করতে হয় তাহলে প্রত্যেক ধর্মবিশ্বাসীরা তাদের নিজ নিজ ধর্মীয় গুরুর জীবনী ও ধর্মগ্রন্থ যদি ঠিকমতো পাঠ করেন এবং অনুসরণ করেন তাহলে তাদের অন্তর এমনতেই শীতল থাকবে, তারা কোনোদিনই পরস্ত্রী কিংবা পরপুরুষের প্রতি আসক্ত হবেন না। ধর্মীয় শিক্ষা তাদেরকে সমস্ত অশ্লীলতা ও পরকীয়া থেকে মুক্তি দিবে এটাই সমাজ বিজ্ঞানীরা মনে করেন।
সৈয়দ রশিদ আলম : কবি ও প্রাবন্ধিক।