কি দুর্ভগা জাতি আমরা। ২০ কোটি মানুষের দেশে বেশিরভাগই হলো কৃষক, শ্রমিক, তাতী, জেলে পেশাজীবী ও শ্রমজীবী। আসলে এরা কতটুকু দুর্নীতর সাথে জড়িত তা আমার বোধগম্য নয়। কিন্তু ট্রানন্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআইবি) অতীতে আমাদের দেশকে পাঁচবার বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতগ্রস্ত দেশ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। কি দোষ করেছে আমাদের আপামর জনতা যে মুষ্টিমেয় কয়জন দুর্নীতগ্রস্ত লোকের জন্য দোষের বোঝা বহন করবে। এরা তো কোনোদিন অস্ত্র ও মাদকের ব্যবসার সাথে জড়িত নেই। এরা তো নারী ও শিশু পাচারের সাথে জড়িত নেই। এরা তো কখনো মানি লন্ডারিং কি তা জানে না। এরা তো কীভাবে অর্থ পাচার করতে হয় জানে না। এরা তো এম এল এম ব্যবসার ফাঁদে ফেলে মানেেষর সাথে প্রতারণা করে অর্থের পাহাড় গড়ে না। এরা তো ক্যাসিনো কি তা জানে না। এরা চায় শুধুমাত্র সারাদিন কাজ শেষে একটু খেয়ে নিশ্চিন্তে বিশ্রামে যেতে।
আসলে দুর্নীতর সংজ্ঞাটাই আমরা জানি না। নির্দিষ্ট অবস্থানের অপব্যবারই হলো দুর্নীত। সেটা সরকারি হোক আর বেসরকারি হোক। দুর্নীত কখনো নীচ থেকে ওপরে যায় না। ওপর থেকে সবুজ সংকেত না থাকলে কি দুর্নীত থাকতে পারে?
আমাদের বাংলাদেশের উন্নতি যে ভাবে হয়েছে দুর্নীতর উৎপত্তিও হয়েছে ঠিক সেইভাবেই। বর্তমান সময়ের দুর্নীতর সামগ্রীক চিত্র খুবই ভয়াবহ ও বিপজ্জনক। এর প্রভাব শুরু হয়ে গেছে। আজ মানুষ হিংস্র হযেছে, মনুষ্যত্ব হারিয়েছে। মানবিক মূল্যবোধ নেই কারো মধ্যেই। হিংসা, বিদ্বেষ, ভ্রষ্টাচারে গোটা সমাজ আজ বর্বর যুগকেও হার মানাচ্ছে। হত্যা, খুন, ধর্ষণ যেন আজ আমাদের দৈনন্দিন কাজের মধ্যেই পড়ে। আজ প্রতিটা মানুষের মনেই আজ অস্থিরতা, ভয় কাজ করছে। মেধাশশূন্য, নেতৃত্বশূন্য এক অরাজকতার দেশ হতে যাচ্ছে আমাদের ত্রিশ লাখ শহীদের ও দুই লাখ মা বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে পাওয়া এই দেশ ।
মাদকের ভয়াল থাবা, অস্ত্রের ঝনঝনানী এ সবের জন্যে মানুষ আজ দিশেহারা। এই দুরারোগ্য ব্যাধি আমাদের দেশকে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে নিয়ে যাচ্ছে। উত্তরণের পথ এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। যতদিন দেশে কালো টাকা বলে কথা থাকবে, কালো টাকা সাদা করার ব্যবস্থা থাকবে, জবাবদিহিতা থাকবে না আমাদের কোনো কাজে ততদিন এর থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। কারণ দুর্নীতর বাম্পার ফসলই হলো এই কালো টাকা।
বর্তমানে আমরা প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে মানসিক অসুস্থ। রোগী তো অসুস্থ আছেই কিন্তু যিনি তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাচ্ছেন তিনিও অসুস্থ, আবার যে ডাক্তার রোগীর চিকিৎসা করছেন তিনি আরো বেশি অসুস্থ। একজন অন্ধ যেমন আর একজন অন্ধকে পথ দেখাতে পারে না ঠিক আমাদের অবস্থা হয়েছে তাই। সুস্থতার কোনো লক্ষণ এই মুহূর্তে দেখতে পারছি না। এত অসুস্থতার ভেতরে দুয়েকজন সুস্থ মানুষ খুঁজে পাওয়া খুবই দুরূহ ব্যাপার ।
আমরা ইতিহাস তো অস্বীকার করতে পারি না। মানুষের সভ্যতার উত্থান তখনই ঘটেছে যখন জাতীয় নেতৃত্বে ন্যায়পরায়ণ ও দুর্নীতিমুক্ত নেতার আবির্ভাব ঘটেছে। আজ এই রোগীকে কে কোন সুস্থ চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাবে। কোন মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষ কি বলে যে আমি মানসিক ভারসাম্যহীন। যে দেশে ডাক্তার একজন কিলার, কাউন্সিলর একজন মাদক ব্যবসায়ী, মন্ত্রী এমপিরা জোর দখলকারী, আইনের লোকের শরীরে বাঁধা থাকে ইয়াবার চালান, দলীয় স্বার্থে একজন সন্ত্রসী যেখানে ভালো মানুষ হয়ে যায় আবার ভালো মানুষ ও মৃত্যুর দিকে ধাবিত হয়। ঘুষ খেয়ে বিচারক যখন বিচারের মোড় ঘুরিয়ে দেয় কিন্তু তখন তো এই অবস্থা হবেই। আমরা কি সবাই সারা জীবনের জন্যে এই পৃথিবীতে এসেছি। আসন না যারা আমাদের নেতৃত্ব পর্যায়ে আছেন তারা শুধু কথা নয়, কাজ দিয়ে মানুষের মন জয় করি। কোন দল ক্ষমতায় থাকবে কি থাকবে না সেটা মুখ্য বিষয় নয়, ৯ মাস যুদ্ধ করে, লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে যে দেশটা পেয়েছি তা সুন্দর করে সাজাই। দুর্নীতিমুক্ত, ঈর্ষামুক্ত, অরাজকতা মুক্ত, সহিংসতামুক্ত, হানাহানিমুক্ত, রক্তপাতমুক্ত একটা সুন্দর দেশ আপামর জনসাধারণকে উপহার দেই ।
● অলোক মজুমদার : চিকিৎসক ও লেখক।