একুশ শতক চমক দেখানোর যুগ। বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়। পিছিয়ে নেই চমক দেখানোর দৌড়ে। প্রধান নির্বাহী থেকে শুরু করে নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন নারীরা। এ-নিয়ে গৌরবের শেষ নেই আমাদেরও। কিন্তু আমরা মনে রাখি না, তাঁদের অনেকে নিজ নিজ মেধা ও পরিশ্রমের জোরে উঁচু পদ পেলেও অনেক মেধাহীন অযোগ্য পুরুষের মতো, অনেক অযোগ্য নারীও আঁকড়ে বসে আছেন ভারী-ভারী পদে।
রাজনীতিতে নাম লেখানোর অর্থ এখন আর জনকল্যাণে নিবেদিত হওয়া নয়, বরং জনকল্যাণের নাটক করা। ক্ষমতাবানদের জীবনযাপনের একটা ছক থাকে। সেই ছকের ভেতর প্রবেশ করলে নারী আর নারী থাকেন না, তিনিও হয়ে ওঠেন পুরুষতন্ত্রের প্রতিভু।
ইতিহাস ছাড়িয়ে অনেক এগিয়ে গিয়েছি আমরা। অবাক ব্যাপার, প্রতিযোগিতামূলক কোনো পরীক্ষায় নারী প্রথম স্থান অর্জন করলে আজও চোখ কপালে উঠে যায় সমাজের। পুরুষ প্রতিযোগীদের মায়েরাও তিরস্কার করেন পুত্রকে-একটা মেয়ের কাছে হেরে গেলি! আবার দুর্বল ব্যক্তিত্বের পুরুষকে সমাজ ধিক্কার দেয় এই বলে তুমি তো নারীরও অধম। তার মানে এই, নারী কোন অধম প্রাণী বা বস্তু! শক্তিহীন পুরুষমাত্রই নারীর সমকক্ষ কিংবা তার চেয়ে অধম।
বিশ্ব দেখেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেই সাদা বাড়িতে কালো রাষ্ট্রপতি পরিবার পরিজন নিয়ে টানা আটবছর বসবাস করেছিলেন। মানবতার জয়, সমতা প্রতিষ্ঠা, বর্ণপ্রথার অবসান কত কথার ফুলঝুরি বিশ্ব গণমাধ্যমে! সত্যি কি কালোদের সুদিন এসেছে মার্কিন মুলুকে? সন্ত্রাস দমনের অজুহাতে ইরাক ও আফগানিস্তানের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধে মানবতা জিতেছিল কি হেরে গিয়েছিল, সেই প্রশ্নের জবাব মিলে গেলেও ওবামা তাঁর পূর্বসূরী সাদা রাষ্ট্রপতিদের নীতিই বহাল রেখেছিলেন পররাষ্ট্র বিষয়ে। ক্ষমতার প্রশ্নে এক চুলও ছাড় দেননি বিশ্বজুড়ে মানবতাবাদী হিসেবে খ্যাত, শান্তিতে নোবেলজয়ী বারাক ওবামা। প্রকৃতই ক্ষমতার স্বাভাবিক ধর্ম হচ্ছে- ক্ষমতা ক্ষমতাবান ও ক্ষমতাহীনের মাঝে একটা দেয়াল তুলে দেয়, যে দেয়াল কখনও ভাঙা যায় না, টপকানো যায় না।
ক্ষমতার সঙ্গে মানবিকতার বৈপরীত্যই বেশি দৃশ্যমান। বর্মী জাতীয়তাবাদী নেতা, গণতন্ত্রের মানসকন্যা নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী অং সান সুচি মুক্ত জীবনে ক্ষমতার স্বাদ পাওয়ার পরপরই যা দেখালেন তাতে বিস্মিত হলেও এমনটাই আসলে হওয়ার কথা ছিল। নারী বলে ক্ষমতার অপব্যবহার করবেন না, অমানবিক হবেন না, বিশেষত নারীর প্রতি নির্বিচার সহিংসতায় সায় দেবেন না, এমনটা ভাবার অবকাশ নেই।
তথাপিও উপমহাদেশে নারীর ক্ষমতায়নের পরিসংখ্যান দেখে উদ্বেলিত পৃথিবী। পিঠ চাপড়ে দেয় বিশ্বমোড়লেরা। ওদের বাহবা পেয়ে আত্মতৃপ্তিতে বুঁদ হয়ে থাকে ভারতবাসী, বঙ্গবাসী সকলে। তবে উপমহাদেশে নারীর ক্ষমতায়নের উৎসমূলে রয়েছে পুরুষতান্ত্রিকতা ও রাজনীতির খেলা, যা বোঝার জন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বা দার্শনিক হতে হয় না।
এবারে আমাদের সমাজে প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া কিছু অনুগল্পে চোখ ফেরানো যাক।
এক বড়ো দপ্তরে চাকুরির জন্য আবেদন করেছেন অনেক প্রার্থী। নারী চাকুরিদাতার চোখে যাকে সবচেয়ে যোগ্য মনে হয়েছে, তিনি একজন পুরুষ এবং তিনি তাঁকেই নিয়োগ দেন। তথাকথিত নারীবাদীরা ধিক্কার দেন নারী চাকুরিদাতাকে-একজন নারী হয়ে নারী প্রার্থীকে বাদ দিয়ে কেন পুরুষকে বেছে নিলেন!
এক নারী গবেষকের রচনা প্রকাশের অনুপোযোগী বিবেচিত হওয়ায় নারী সম্পাদককে তোপের মুখে পড়তে হয়; নারী হয়ে কেমন করে নারীর লেখা বাতিলের ঝুড়িতে ফেলে দিতে পারলেন? এ কেমন কথা! নারী বলেই কি অযোগ্য নারীর প্রতি পক্ষপাতিত্ব করতে হবে? (পক্ষপাতিত্ব করতে চাননি বলেই কি নারী বিচারক অভিজাত ধর্ষকদের রক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে ভুক্তভোগীর বিচার চাওয়ার পথে সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন?)
একজন কর্মজীবী নারীকে জীবন দিয়ে হলেও প্রমাণ করতে হয় যে ‘আমি পারি’ কিংবা ‘আমাকে পারতেই হবে’। সমগ্র নারীজাতির ওপর চিরস্থায়ীভাবে প্রোথিত কলঙ্কতিলক অপসারণের দায়ভার যেন একা তার। তবে শেষরক্ষা শেষ পর্যন্ত অনেকের বেলায়ই হয় না। অপবাদের বোঝা নিয়েই এগিয়ে চলে নারীর পরম্পরা।
কর্মজীবী নারী পারিবারিক কোন সমস্যা বা সন্তানের অসুস্থতার কারণে ছুটির আবেদন করলে শতকথা ওঠে তার কর্মদক্ষতা নিয়ে, কাজের প্রতি বিশ্বস্ততা নিয়ে, যা একজন পুরুষের বেলায় হয় না বললেই চলে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী শিক্ষক নিয়োগের বেলায় স্বয়ং নিয়োগকর্তাগণ শঙ্কা প্রকাশ করেন কিংবা উপহাস করেন এই বলে যে মাতৃত্বকালীন ছুটি দিতে দিতেই তো বিশ্ববিদ্যালয়ের বছর ফুরিয়ে যাবে, ঠিক যেন ‘মা’ ছাড়া তাঁরা পৃথিবীতে এসেছেন, কিংবা মা হওয়া একটা অপরাধ। তাঁরাই আবার সভা সমিতিতে নেপোলিয়নের ‘আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও’ উক্তির উদ্ধৃতি দিয়ে নারীশিক্ষার পক্ষে জোরালো ভাষণ দিয়ে থাকেন।
প্রাচীন পৃথিবীতে মাতৃতান্ত্রিক পরিবারপ্রথা প্রচলিত থাকলেও পেশিশক্তির উত্থানের মাধ্যমে সমাজের চেয়ে রাষ্ট্র যখন শক্তিশালী সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে তখন থেকে ইতিহাস হয়ে পড়ে নারীবিবর্জিত। বিশ্বখ্যাত বীরযোদ্ধাদের তালিকায় তাই নারীর দেখা মেলে না। সভ্যতার অগ্রগতির ইতিহাসে নারীর ভূমিকা বা অবদান চোখে পড়ে না। মার্কিন লেখক ও গবেষক মায়রা পোলাক সাদকের বলেন, যখনই একজন মেয়ে কোন বই খোলে এবং দেখে যে ইতিহাসে কোনো মেয়ের গল্প নেই, তখন সে বুঝে নেয় সে কত মূল্যহীন। মূল্যহীন নারীরা ক্রমান্বয়ে সৌন্দর্য দিয়েই জগতকে বশ করার মন্ত্রে দীক্ষিত হয়। কবিতায় পুরুষের বীরত্বগাথা রচিত হলেও নারীর কেবল রূপের বন্দনা চলে, জ্ঞান বা শক্তির নয়। কালে কালে যুগে যুগে শিক্ষা প্রসারের সূত্রে অনেক কিছু বদলে গেলেও নারীদের রূপ দিয়ে বিশ্ব জয় করার ‘ট্রেন্ড’ তাই আজও চলছে এবং সৌন্দর্য বর্ধনকারী হিসেবে নারীজীবনের সার্থকতা খুঁজে পাওয়া নারীর সংখ্যা আজও অগণিত। পশ্চিম উদারতা ও প্রগতির ধারক ও বাহক হয়েও এই ধারা থেকে মুক্ত হতে পারেনি। আমরা পূর্ববাসীতো ধ্যানেজ্ঞানে পশ্চিমকেই প্রাণে ধরে গৌরব বোধ করি। অতএব সৌন্দর্যচর্চা এগিয়ে থাকে জ্ঞানচর্চাকে পেছনে ফেলে।
একদিকে নারীর ক্ষমতায়নের সংগ্রাম, অন্যদিকে সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা ও বিজ্ঞাপনের নামে নারীর সম্মানহানির চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। বিশ্বমঞ্চে আলো ছড়ানো নারীগণ এই ধাঁধার ভেতর ঘুরপাক খেয়ে যান ক্রমাগত। তাঁরা ভুলে যান ‘নারীকে দেওয়া উপহারের মধ্যে সবচেয়ে দামি উপহার হলো সম্মান, যদিও সেই দামি উপহার দেওয়ার ক্ষমতা সকল পুরুষের থাকে না’। আমরা জানিই না কেবল ভালোবাসা নয়, নারীর চাই পরিবারে, সমাজে একটা মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা। মঞ্চ কাঁপিয়ে বক্তৃতা করা নারী নিজের ঘরে শান্তি বজায় রাখার স্বার্থে মুখে কুলুপ এঁটে থাকেন। অনেক নারী আবার মানবাধিকার কর্মী হিসেবে নাম কামিয়ে ঘরে এসে গৃহকর্মী নির্যাতন করেন অবলীলায়। একটুও হাত কাঁপে না, প্রাণ কাঁপে না তাঁদের। ক্ষমতা তখন পরিণত হয় এক অন্তঃসারশূন্য মোড়কে।
নারীর ক্ষমতায়নের অর্থ উঁচু উঁচু কিছু চেয়ারে গুটিকয় নারীকে বসিয়ে দিয়ে লিঙ্গসমতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মনে করে আত্মপ্রসাদ লাভ করা নয়। নীতিনির্ধারকগণের ঔদার্যের সাক্ষ্য দিতে গিয়ে অযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও বিশেষ কোন কারণে বিশেষ কোন নারীকে বিশেষ কোনো চেয়ারে অধিষ্ঠিত করা নারীমুক্তির সংগ্রামের সঙ্গে প্রতারণা ছাড়া আর কিছু নয়। সাদাদের দেশে দু-চারজন কালো ব্যক্তিকে মন্ত্রীসভায় অন্তর্ভুক্ত করে উদারতার পতাকা ওড়ায় অনেক সদাশয় সরকার, ঠিক যেমন করে সংখ্যালঘুর কোটায় মাঝে মাঝে সুবিধাবঞ্চিতরা স্থান পেয়ে যায়। আমাদের সমাজে নারীর ক্ষমতায়ন অনেকটা এই ধারায় বর্তায়। ‘কি চমৎকার দেখা গেল’ নামের এই ভোজবাজি বন্ধ না হলে নারীর ক্ষমতায়ন কেবল বিজ্ঞাপনেই শোভা পাবে, নারীর ভবিষ্যত কপাল ফিরবে না, সমাজের অন্ধকারও ঘুচবে না।