বড়দিন খ্রীষ্ট ধর্মাবলম্বীদের জন্য বড় একটি উৎসব। এই দিনে পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ঘটনা সংগঠিত হয়েছে। ঈশ্বর নিরাকার হওয়া সত্ত্বেও তিনি সাকার হলেন। তিনি এই ধরায় নেমে এলেন। মানুষ এবং ঈশ্বরের মধ্যে মিলন ঘটালেন। ঈশ্বর মানুষ হলেন কারণ মানুষ যেন তাকে আরও ভালোভাবে জানতে পারে, উপলব্দি করতে পারে। তাই তাঁর পরিকল্পনা অনুসারে মানুষকে পরিত্রাণ দেওয়ার জন্য তিনি মানুষ হয়ে জন্ম নিলেন। আথানাসিউস বলেছেন—‘ঈশ্বর মানুষ হলেন, যেন মানুষ ঈশ্বর হতে পারে।’ ঈশ্বর হওয়ার জন্যে ঈশ্বরের বৈশিষ্ট্য মানুষের মধ্যে প্রকাশিত হতে হয়। যীশু খ্রীষ্ট শিশু হয়ে ক্ষুদ্র গোসালায় জন্ম গ্রহণ করেছেন, তিনি আবার আসবেন আমার অন্তর গোসালায় আসবেন। যেন আমি নতুন চেতনার মানুষ হয়ে উঠতে পারি। যীশুর জন্ম বারতার শান্তি মানুষের কাছে প্রকাশ করতে পারি।
ইতিহাসে যুগ যুগ ধরে প্রবক্তাগণ যীশুর আগমন বার্তা প্রচার করেছেন। মানব জাতি চিন্তা করেছিল বিশেষ করে ইস্রায়েল জাতি তাদের জন্যে এক রাজা জন্মগ্রহণ করবেন তিনি তাদের মুক্ত করবেন। তারা তাদের বাহ্যিক মুক্তির কথা চিন্তা করেছেন কারণ তারা পরাধীন ছিলেন। যীশু আসলেন মুক্তি দিতে ঠিকই, কিন্তু এই মুক্তি হলো আধ্যাত্মিক মুক্তি চিন্তা চেতনার নব জাগরণের মুক্তি। পূণ্যপিতা পোপমহোদয় এই সময়ে একটি পালকীয় পত্র লিখেছেন—‘ Fratelli Tutti’ যার মধ্যে দিয়ে সবাইকে মানব পরিবারের সদস্য-সদস্যা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যুদ্ধকে পরিহার করে মানুষ যেন ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়। সাধু ফ্রান্সিস জেভিয়ার সবাইকে ‘ভাইবোন’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এই পত্রের মধ্যে আরও উল্লেখ করা হয়েছে অন্ধকার মেঘ আমাদের ঢেকে রেখেছে। এই মেঘ হলো আমাদের পাপপ্রবণ স্বভাব সেই সাথে অন্যায্যতা, সংঘাত, নারী নির্যাতন, আসক্তি, রাজনৈতিক অপব্যবহার, অপচয় ইত্যাদি। এইগুলোকে পরিহার করে ধরিত্রীকে আমাদের সুন্দর করে গড়ে তুলতে হবে। সবার সহযোগিতার মধ্য দিয়ে শান্তিপূর্ণ আদর্শ পৃথিবী গড়তে হবে। আমাদের চিন্তা চেতনার পরিবর্তন করতে হবে। এই দু হাজার বিশ সাল মানুষের জীবনের অনেক বিপর্যয় এসেছে। এর প্রধান কারণ হলো আমরা মানুষেরা আমরা নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থকে অতি মাত্রায় প্রাধান্য দেওয়ার কারণে প্রকৃতির অনেক ক্ষতি করছি। তাই পরিবেশ দূষণ, প্রকৃতির বিপর্যয়ের জন্য আমরা নিজেরাই দায়ী। একটি কথা আছে- মানুষ মানুষকে ক্ষমা করে কিন্তু প্রকৃতি মানুষকে ক্ষমা করে না। তাই প্রকৃতি তার স্বরূপে ফিরে আসার জন্য এই প্রতিশোধ নিচ্ছে আর সবদিক দিয়ে মানুষের অনেক কষ্ট হচ্ছে। এই বড়দিনে আমরা আমাদের নতুন চিন্তা চেতনায় নিজেদের সজ্জিত করতে পারি। ব্যক্তি স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে মানবের কল্যাণ সাধনের জন্য ব্রতী হতে পারি। সেই সাথে প্রকৃতির যত্নে আরও সচেতন হতে পারি। আমি যেখানেই থাকি না কেন, পরিবার, সমাজ, দেশ-বিদেশ, আমার ধ্যান-জ্ঞান যেন হয় মানুষের সামগ্রিক কল্যাণ। আর আমি যখন এই কল্যাণের কথা চিন্তা করব তখন আকাশের কালো মেঘ দূরীভূত হবে। সেখানে দেখা যাবে নতুন সূর্য। আমরা যদি বড়দিনের নতুন চেতনায় নিজেরা উদ্বুদ্ধ হই তাহলে আমারা আমাদের নতুন সূর্য যীশুখ্রীষ্ট তার আলোতে আলোকিত হব অন্যদেরও সেই আলোতে আলোকিত করতে পারব।
নতুন চেতনা হরো জীবনের নতুন জাগরণ। পৃথিবীর সবকিছু পরিবর্তনশীল। প্রতিনিয়ত সবকিছুর পরিবর্তন ঘটছে। এই পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের পথ চলতে হয়। যখন পরিবর্তনের সাথে ব্যক্তির ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটে তখন ব্যক্তির জীবনে উন্নতি হয়। পরিবর্তন মানুষ সহজে গ্রহণ করতে চায় না। পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়াতে সময় লাগে। এই পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়াতে গিয়ে মানুষের মধ্যে দ্বন্দ্ব হয়। দ্বন্দ্ব হলেও মানুষ যেন আবার নম্র হয়ে ক্ষমা দিয়ে ক্ষমা নিয়ে একত্রে আসতে পারে। কারণ এই উৎসব হল নম্র নওয়ার উৎসব যীশু নম্র হয়ে এই ধরায় এসেছেন, গোসাল ঘরে জন্ম গ্রহণ করেছেন। গোসাল ঘরে প্রবেশ করতে হলে সবাইকে মাথা নত করে নম্র হয়ে নতুন চেতনা নিয়ে প্রবেশ করতে হয়। অন্তরের যত অহংকার আছে তাকে চূর্ণ করতে হয়। তাহলেই যীশু খ্রীষ্ট অন্তরে আসেন। আমার হৃদয় গোসালায় জন্মগ্রহণ করেন।
বড়দিন হলো মিলন উৎসব। যীশু মানুষের সাথে মিলন ঘটানোর জন্যে এসেছেন। আমরাও যেন ভেদাভেদের উর্ধ্বে উঠে, জাতি, ধর্ম-বর্ণ নিবিশেষে মিলন ঘটাতে পারি। মিলনে যে আনন্দ রয়েছে তা উপলব্দি করতে পারি। বর্তমানে সমাজে স্বামী, স্ত্রী, ভাই-বোনদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা লক্ষ করা যায়। এই বড়দিনে তারা পরস্পর পরস্পরকে ক্ষমা দিয়ে কাছে টানতে পারে। যারা দীর্ঘদিন ধরে কথা বলে না, যারা একে অন্যকে ক্ষমা করতে পারে না। এই উৎসবে তারা নতুন আঙ্গিকে সংলাপ করতে পারে। পরস্পর পরস্পরের কাছে আসতে পারে। ক্ষমা দিয়ে ক্ষমা নিয়ে নতুন মানুষে রূপান্তরিত হতে পারে। নতুন চেতনায় জাগ্রত হয়ে মিলনের মধ্য দিয়ে জীবনযাপন করতে পারে। মিলন সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারে। শিশু যীশুকে প্রণতি জানাতে মাঠের রাখালেরা মেষ নিয়ে এসছিল, পণ্ডিতেরা তাদের রতœপেটিকা, ধূপ-ধূনো, গন্ধ নির্যাস দিয়ে প্রণতি জানাতে এসেছে। তারা তাদের সামর্থ দিয়ে যীশুকে সম্মান জানিয়েছে। আমরাও আমাদের নিজেদের প্রস্তুত করে উপযুক্ত অন্তরে যীশুকে প্রণাম জানাতে পারি। গোসাল ঘরের মধ্যে পশুরা বিদ্যমান ছিল। এর মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায় যীশু শুধু ধনী-দরিদ্র নয়, জ্ঞানী-মূর্খ নয়, তিনি প্রকৃতির সঙ্গেও মিলন ঘটিয়েছেন। আমরাও যেন এই চেতনা নিয়ে প্রকৃতি, সকল মানুষ মোট কথা গোটা বিশ্বের সঙ্গে মিলন ঘটাতে পারি। একই পরিবারের সদস্য-সদস্যা হয়ে উঠতে পারি।
বড়দিন হলো হৃদয়ে বড় হওয়ার উৎসব। আমরা যেন অন্তর আত্মায় বড় হতে পারি। শুধুমাত্র বড়দিনে আমি ভালো থাকব, ভালো খাব, ভালো পরব এই চিন্তা না করে দরিদ্রদের কথাও চিন্তা করতে পারি। তাদের জন্য কিছু অংশ দান করতে পারি। তাহলে আমার বড়দিন নতুন চেতনার বড়দিন হবে, আমার আনন্দ দ্বিগুণ হবে। যখন আনন্দ সহভাগিতা করা হয় তখন তা দ্বিগুণ হয়। বড়দিনের আনন্দকে দ্বিগুণ করতে হলে আমার আশে পাশে যে দরিদ্র ভাইবোনেরা রয়েছে আমি যেন তাদের দিকে নজর দেই। তাদের সাহায্য করি। আমার অন্তর যদি বড় হয় তাহলে আমার অল্প থাকলেও আমি অন্যকে সাহায্য করতে পারব। আমি যদি উদার না হই পৃথিবীটা আমার থাকলেও আমি খুশি থাকব না। অন্যকে কিছু দান করব না। আমি তবুও বলব আমার আরও অনেক কিছু দরকার। বড়দিন হলো উপহার দেয়া-নেওয়ার উৎসব। সেই সাথে অন্যের কাছে উপহার হয়ে উঠার উৎসব। আমি যেন এই বড়দিনে নতুন মন-মানসিকতা নিয়ে জীবনযাপন করতে পারি। সবার কাছে উপহার হয়ে উঠতে পারি।
বড়দিন হলো আনন্দের উৎসব, মিলনের উৎসব, ক্ষমা দেয়া-নেওয়ার উৎসব, নতুন মনমানসিকতায় রূপান্তরিত হওয়ার উৎসব, অহংকার চূর্ণ করার উৎসব ও উপহার হয়ে উঠার উৎসব। এই বড়দিনে আমি যেন নতুন মানুষ হয়ে উঠি, মলিন চিন্তা চেতনার পরিবর্তন করি, মানুষের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করি। আমরা প্রত্যেকে যে ভাই-বোন গোটা মানবপরিবারের সদস্য-সদস্যা এই চেতনাকে যেন সর্বদা জাগ্রত রাখি, প্রকৃতির যতœ করি। যীশু আমার জন্য জন্মগ্রহণ করেছেন, আবার আমার অন্তরে আসবেন। আমি যেন আমরা জীবনের অমানিসার অন্ধকার দূর করে আমার অন্তর আত্মাকে সুন্দর করে সাজাতে পারি। যীশু যেন আমার অন্তরে জন্মগ্রহণ করেন। আমি যেন সেই নব চেতনা নিয়ে যীশুকে অনুসরণ করি। যীশুর জন্মের শান্তির বারতা অন্যের কাছে প্রকাশ করি।