দেশে ধর্ষণ, যৌন নির্যাতনের ঘটনা বর্তমানে চ‚ড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। প্রতিদিন সংবাদপত্রে অসংখ্য নারী ও শিশু ধর্ষণ, হত্যার ঘটনা চোখে পড়ে। শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত নারী ধর্ষণ ও হত্যার হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। শিশুধর্ষণ, গণধর্ষণ ও ধর্ষণশেষে হত্যার ঘটনা ক্রমশ গ্রাস করছে আমাদের সভ্যতাকে, সমাজকে। বলতে গেলে প্রতিদিনই ব্যভিচার ও ধর্ষণকামিতার ঘটনা ঘটছে।
ধর্ষণের প্রতিরোধ করতে সরকারের যে ব্যর্থতা, তা কি সকল ক্ষমতাশীন দলের ব্যর্থতার ধারাবাহিকতার ফল? তাই যদি না হয় দেশে ধর্ষণ কমছে না কেন? কোন ক্ষমতা মেয়েদের বিপদ বাড়াচ্ছে? কথা না বলার চাপ মেয়েদের ওপর। ধর্ষিত হলে শ্লীলতাহানীর শিকার হলে পরিবার থেকে বলা হয় চুপ থাকতে হবে, নইলে সম্মান যাবে। আবার মেয়েদেরও পুলিশের ওপর আস্থা থাকে না। তাই বিচারহীনতার সংস্কৃতি নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়িয়ে দিয়েছে। কঠোর আইন, প্রচার প্রচারণা ও উচ্চ আদালতের নানা ধরনের নির্দেশনার পরও নারীর প্রতি সহিংসতা কমানো যাচ্ছে না।
এ পর্যায়ে আমরা কথা বলেছি মানবাধিকার নেত্রী, সংগঠক, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। তাঁদের আলাপে আমরা জানতে চেয়েছি সামাজিক এই বিপর্যয়ের কারণ ও প্রতিরোধের বিভিন্ন দিক-নির্দেশনা।
নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে বিচারহীনতাই দায়ী
সুলতানা কামাল, মানবাধিকার নেত্রী। নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে বিচারহীনতাই দায়ী। তবে রাষ্ট্র ও সমাজে নারীর প্রতি সহিংসতার আরো অনেক উপাদান আছে। ধর্ষণসহ নারীর প্রতি সহিংসতার যেসব ঘটনা ঘটে তার একটি অংশ জানা যায় না। এ বিষয়ে কোনো মামলা হয় না। আর যেগুলোর মামলা হয় বিশেষ করে ধর্ষণের ক্ষেত্রে সেখানে শতকরা মাত্র তিন ভাগ ঘটনায় শেষ পর্যন্ত অপরাধী শাস্তি পায়। আর ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনায় শাস্তি হয় মাত্র শূন্য দশমিক তিন ভাগ। তাহলে বোঝা যাচ্ছে এ ধরনের কোনো ঘটনায় বিচার হয় না।
তবে এর বাইরেও আরো অনেক বিষয় আছে। যারা ধর্ষক তারা ধর্ষণের শিকার নারীর চেয়ে শক্তিশালী। অন্যদিক বাদ দিলেও লৈঙ্গিকভাবে পুরুষ শক্তিশালী। তারা সামাজিক এবং রাজনৈতিকভাবেও শক্তিশালী। নারীদের সামাজিকভাবে সুরক্ষা দেয়ার রাষ্ট্রের যে দায়িত্ব রয়েছে রাষ্ট্র তা পালন করছে না। আর নারীদের বাইরে বের হওয়া কিংবা কাজে যাওয়ার বিষয়গুলোকে সমাজে এখনো ভালো চোখে দেখা হয় না। নারীর বাইরে বের হওয়াকে পুরুষের ক্ষমতা খর্ব হওয়া হিসেবে দেখা হয়। আর প্রতিদিন নানা জায়গায় নারীর বিরুদ্ধে কথা বলা হয় কিন্তু সরকার ব্যবস্থা নেয় না। ফলে নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়ছে।
এখানে অভিযোগ থানায় জানাতে গিয়েও ধর্ষণের শিকার হয়
শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন
অধ্যাপক, আইন ও অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগ, ঢাবি।
নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে শক্ত আইন আছে। কিন্তু শাস্তি দিয়ে খুব বেশি অপরাধ কমানো যায় না। আর এটা ধর্ষণ এবং ধর্ষণের পর হত্যার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আমাদের এখানে সমাজের ভেতরে অসংখ্য উপাদান আছে যা ধর্ষণ বা নারীর প্রতি সহিংসতাকে উসকে দেয়। আমাদের সমাজে এখানো নারীকে ভোগের সামগ্রী মনে করা হয়। তাকে সেভাবে উপস্থাপনও করা হয় বিভিন্ন মাধ্যমে।
ফৌজদারী বিচার ব্যবস্থা এবং সাক্ষ্য আইনে নানা সমস্যা রয়েছে। আছে ধর্ষণের শিকার একজন নারীর চরিত্র হননের সুযোগ। কিন্তু একজন যৌনকর্মীর সঙ্গেও তো তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করা যাবে না। করা হলে সেটা ধর্ষণ হবে। এখানে অভিযোগ থানায় জানাতে গিয়েও ধর্ষণের শিকার হয়।
একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ডাক্তারি পরীক্ষা না করলে ধর্ষণের আলামত নষ্ট হয়ে যায়। আদালতে তাকে অনেক বিব্রতকর প্রশ্ন করা হয়। ফলে অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়ে।
অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে সরকার পদক্ষেপ নেবে
নাছিমা বেগম (এনডিসি), চেয়ারম্যান, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন প্রথমেই বলব, দেশের এম ক্রাইসিস মুহূর্তে যারা ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের মতো জঘন্য অপরাধে জড়িত তাদের নিন্দা জানানোর ভাষা আমার নেই। অপরাধীরা গ্রেপ্তার হচ্ছে কিনা, শাস্তির আওতায় তাদের আনা হচ্ছে কিনা, সে বিষয়ে আমরা মনিটরিং করছি। অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে সরকার পদক্ষেপ নেবে। আমি মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেছি। আমি নিজেও এই মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলাম। দেশের সঙ্কটময় মুহূর্তে এটাকে ছোট করে দেখলে চলবে না।
বিচারহীনতা এবং ভয়ের সংস্কৃতির কারণে ধর্ষণ অনেকটা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে নূর খান
সাবেক নির্বাহী পরিচালক, আইন ও সালিশ কেন্দ্র
বিচারহীনতা এবং ভয়ের সংস্কৃতির কারণে ধর্ষণ অনেকটা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। বিচার না পাওয়ায় এখন অনেকেই আর মামলা করতে আগ্রহী হচ্ছেন না। আর ভয়ের কারণেও অনেকে মামলা করতে পারছেন না। সাহস পাচ্ছেন না। ক্ষমতা আর বিত্তের কাছে বিচার প্রার্থীরা অসহায় হয়ে পড়ছেন। আর যারা অপরাধী, তারাও জানে যে তাদের কিছু হবে না। তাই তারাও নিবৃত্ত হয় না। এরসঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে ঘৃণার সংস্কৃতি। এমনভাবে ঘৃণা ছড়িয়ে দেয়া হয় যে মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হন। মানুষ নিজেকে গুটিয়ে নেন। বিচার চান না।
বিচারহীনতার প্রবণতা দূর করে অপরাধীদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে হবে
উম্মে ওয়ারা
শিক্ষক, অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগ, ঢাবি।
সমাজে ধর্ষণের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে এটা ঠিক, তবে এমন ঘটনা সমাজে নতুন কিছু নয়। বর্তমানে ধর্ষণের ঘটনা বেশি নজরে আসায় আপাতদৃষ্টিতে অনেক বেশি বলে মনে হয়। আমাদের দেশে যেসব ধর্ষণের ঘটনা রেকর্ড করা হয় সেগুলো মূলত গণমাধ্যমের প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করেই করা হয়। বর্তমানে দেশের গণমাধ্যমগুলো ধর্ষণের ঘটনাকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। পাঠকপ্রিয়তার ওপর ভিত্তি করেই হয়ত তারা এমনটা করছে। আর এর ফলে মনে হচ্ছে ধর্ষণ অনেক বেশি ঘটছে।
সমাজে যখন কোনো অপরাধ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে তখন ওই অপরাধের প্রতি অপরাধপ্রবণ মানুষের আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। এছাড়া ধর্ষণের কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে যৌন শিক্ষার অভাব, বিদ্যালয়ে নীতিশিক্ষার ব্যবস্থা না থাকা, ধর্মীয়ভাবে নারীদের সম্ভ্রমকে গুরুত্বপূর্ণভাবে দেখা। ধর্ষণের পর ধর্ষিতা নারীর পরিবার সাধারণত বিষয়টিকে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করে। নিজেদের সম্মানহানির ভয়ে অপরাধীকে শাস্তির মুখোমুখি করার ক্ষেত্রে তাদের কিছুটা অপারগতা দেখা যায়। এ কারণে অপরাধীরা আরও বেশি সুযোগ পায়। অন্যদিকে ইন্টারনেটের প্রসারতায় পর্নোগ্রাফির প্রতি ঝোঁক অনেক বাড়ছে। পর্নোগ্রাফিতে সাধারণত নারীকে পণ্যের মতো উপস্থাপন করা হয়। যখন কোনো পুরুষ এটা দেখেন তখন তার মধ্যেও নারীকে ইচ্ছেমতো ব্যবহারের ভাবনা তৈরি হয়। এটা ধর্ষণ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।
বিদ্যালয়গুলোতে যৌনশিক্ষার প্রচলন চালু করতে হবে। যৌনতা সম্পর্কে ছোটবেলা থেকেই ধারণা দিতে হবে, সন্তানদের নারীদের প্রতি সম্মান দেখানো শেখাতে হবে। বিচারহীনতার প্রবণতা দূর করে অপরাধীদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
ধর্ষণের বিচারের ক্ষেত্রে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করতে হবে
শাহ এহসান হাবীব
অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাবি নিম্নবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত, সব শ্রেণির মধ্যেই বাড়ছে এ অপরাধ প্রবণতা। এর পেছনে মূল কারণ, নারীর দেহকে পুরুষের পণ্য হিসেবে দেখার প্রবণতা। ধর্ষণের পর ধর্ষিতা নারীর প্রতিবাদ করার ‘অক্ষমতা’, অপারগতা ও বিচারে ক্ষমতাবানদের প্রভাব খাটানোর প্রবণতা। এছাড়া আমাদের সমাজের নাটক ও সিনেমাগুলোতে নারীদের এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যেন তাদের দেহের ওপর পুরুষদের এমন একটা অধিকার রয়েছে যে চাইলেই তারা নারীদের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতে পারেন। এর ফলে নারীরা হীনম্মন্যতায় ভুগবেন। আত্মবিশ্বাসের অভাব ছাড়াও বাইরে বের হওয়ার ক্ষেত্রে ভুগবেন নিরাপত্তাহীনতায়। এছাড়া নষ্ট হবে সামাজিক শৃঙ্খলা। এতে সমাজে অস্থিরতা বৃদ্ধির পাশাপাশি সবার মধ্যে এমন ধারণা সৃষ্টি হবে যে, পুরুষ মানেই ধর্ষক এবং নারী মানেই ধর্ষিত। বিশ্বের যেকোনো সমাজের জন্যই এমন ধারণা ক্ষতিকর।
ধর্ষণের বিচারের ক্ষেত্রে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করতে হবে। পুলিশের মামলা নেয়ার অপারগতা দূর করা ছাড়াও আদালতে নারীদের হয়রানি বন্ধ করতে হবে। নারীদের পোশাকের ক্ষেত্রেও কিছুটা শালীনতা বজায় রাখা দরকার।ধর্ষণের কারণ সম্পর্কে বিভিন্ন সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নারীদের পোশাকের বিষয়টি উঠে এলেও প্রত্যেক বিশেষজ্ঞই মনে করেন নারীর পোশাক ধর্ষণের জন্য দায়ী হতে পারে না। যদি সেরকমটাই হতো তবে শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটত না।
নারীরা আজ কোথাও নিরাপদ নয়
মোহাম্মদ শাহিন আলম শিক্ষার্থী, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়
চারিদিকে যে লোমহর্ষক ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে, এতে জোর দিয়ে বলতে পারি যে নারীরা আজ কোথাও নিরাপদ নয়। এমনকি তার স্বামী ও তার নিজের বাবা-মার কাছে থেকেও সে নিরাপদ নয়। এর জন্য আমি এ দেশের বিচার ব্যবস্থাকে দায়ী করবো। বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা ও সঠিক শাস্তি না হওয়ায় দিন দিন এসব ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমার মতে ধর্ষণের বিচার কাজ দ্রæত সম্পন্ন করে এবং দোষী ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করে উন্মুক্ত জায়গায় তার শাস্তি কার্যকর করা দরকার। তাহলে এ দেশ আর কোনো ধর্ষণকারী থাকবে না।
অ্যাড. নীনা গোস্বামী
উপপরিচালক, আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)
এখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দৃষ্টি করোনাভাইরাস মোকাবিলার দিকে। কিছু খারাপ চরিত্রের মানুষ সুযোগ খোঁজে। এছাড়া, এখন তো স্বল্প জায়গার মধ্যে সবাইকে থাকতে হচ্ছে। পরিবারে অভাব-অনটন দেখা দিলে নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়ে যায়। নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে এ বিষয়েও ওপরও দৃষ্টি দেওয়ার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অনুরোধ করছি।
ধর্ষণ, যৌন নির্যাতন বন্ধে সবার আগে মানসিকতা বদলাতে হবে। যুব সমাজকে বিপথে যাওয়ার পথ আটকাতে দেশে অনলাইনে সবগুলো পর্নো সাইট স্থায়ীভাবে বন্ধে আরও কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। যেকোনো রকম মাদকের সহজলভ্যতা বন্ধ করতে হবে। পিতামাতাকে ভাবতে হবে আপনার সন্তান অনলাইনে কী করছে, কার সঙ্গে মিশছে, ঘরে-বাইরে কী করছে তা জানার দায়িত্ব আপনার। পাশাপাশি আইনগত ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নারী ও কন্যা নির্যাতনকারীদের দ্রæত বিচার আইনে সাজা প্রদান, জেন্ডার সংবেদনশীল শিক্ষানীতি ও পাঠ্যসূচি প্রণয়ন, প্রতিষ্ঠানভিত্তিক সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা, প্রশাসন, বিচার বিভাগ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সব ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণে জেন্ডার ও মানবাধিকার বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। যুবসমাজকে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে যুক্ত করা এখন সময়ের দাবি। স্বাভাবিক, সুস্থ ও সমতা ভিত্তিক সমাজ বির্নিমাণে তাই সব প্রতিষ্ঠানকে কাজ করতে হবে। তাহলেই ধর্ষণ, হত্যা, নারী নির্যাতনের বিষবৃক্ষের বিষদাঁত উৎপাটন সম্ভব।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ, মানবাধিকার নেত্রী, বিশেষজ্ঞগণের মতামত, তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করা হয়েছে।
● নাজিম উদ্দীন, বিশেষ প্রতিবেদক।