মহান আল্লাহ পাক ধন-সম্পদের সঙ্গে যেসব বিধি-বিধান রেখেছেন তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো যাকাত। দেহের সঙ্গে সম্পর্কিত ইবাদতের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো নামাজ, আর সম্পদের সঙ্গে সম্পর্কিত ইবাদতের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যাকাত। নামাজ এবং যাকাত এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, এ দুটোকে মুসলমান হওয়ার আলামত হিসেবে গণ্য করা হয়।
রাসূল (সা.) এর যুগে সাহাবায়ে কেরামকে জেহাদের জন্য বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো হতো। তাদেরকে বলে দেয়া হতো যে, তোমরা যুদ্ধ করতে থাকবে, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা ঈমান না আনে এবং নামাজ না পড়ে আর যাকাত না দেয়। এতে বোঝা যায় যে, কাফেরদের বিরুদ্ধে জেহাদ চলতে থাকবে, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা ঈমান না আনবে, নামাজ না পড়বে এবং যাকাত না দিবে। অর্থাৎ এই তিনটা কাজ যতক্ষণ না করবে, ততক্ষণ তাদেরকে মুসলমান বলে গণ্য করা হবে না।
কেউ যদি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত নামাজ ও যাকাতের ধারে-কাছে না থাকে, তাহলে তাকে কীভাবে মুসলমান হিসেবে বিবেচনা করা যাবে? যে নামাজ পড়বে না, যাকাত দিবে না সে যেন মুসলমানই না।
পবিত্র কোরআনো নামাজ ও যাকাত এ দুটো ইবাদতের কথা সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বার উল্লেখ করা হয়েছে। কোরআনের প্রায় ৮০ জায়গায় নামাজের কথা এবং ৩২ জায়গায় যাকাতের কথা বলা হয়েছে। এ দুটো আমল খেলাফের শাস্তি অনেক কঠিন।
যাকাত না দেয়ার শাস্তি সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে : ‘যারা স্বর্ণ-রৌপ্য বা টাকা-পয়সা সঞ্চয় করে রাখে, আল্লাহর রাস্তায় তা ব্যয় করে না, তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দিয়ে দাও।’
এই যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি সম্পর্কে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন : ‘ওই স্বর্ণ-রৌপ্য জাহান্নামের আগুনে দগ্ধ করা হবে এবং তা দ্বারা তাদের কপালে, পাঁজরে পিঠে (অর্থাৎ শরীরের বিভিন্ন স্থানে) দাগ দেয়া হবে এবং বলা হবে যে, নিজেদের জন্য এটা সঞ্চয় করে রেখেছিলে এটা তো তাই। এখন তার স্বাদ চেখে দেখ, কত মজা!’
যাকাত আদায় না করার আরও অনেক রকম শাস্তি রয়েছে। এক হাদিসে রাসূল (সা.) বলেছেন: ‘যে ব্যক্তি সম্পদের যাকাত না দেয়, কেয়ামতের দিন তার সম্পদ বিষাক্ত সাপে রূপ নিয়ে তার গলায় পেঁচিয়ে থাকবে এবং দুই গালে দংশন করতে থাকবে, আর বলতে থাকবে আমি তোমার মাল, আমি তোমার সঞ্চয় করে রাখা সম্পদ।’
আমরা যদি যাকাত না দেই, সম্পদের হক আদায় না করি, তাহলে আমাদের শাস্তি হবে। সন্তানের জন্য রেখে যাব, এটা সন্তানের উপকারে আসবে কিনা তা নিশ্চিত নয়, কিন্তু সম্পদের হক আদায় না করলে আমার শাস্তি নিশ্চিত। যদি আল্লাহর হুকুম পালন করার পর যা থাকল তা রেখে গেলাম, তাহলে আশা করা যায় আল্লাহপাকের রহমতে আমাদের সেই রেখে যাওয়া সম্পদ সন্তানের উপকারে আসবে।
আল্লাহপাক মালের (সম্পদ) ৪০ ভাগের ১ ভাগ যাকাত হিসেবে দিতে বলেছেন। অর্থাৎ, শতকরা আড়াই টাকা যাকাত হিসেবে দেয়া ফরজ। অনেকে শতকরা আড়াই টাকা হিসেবে দিতে দিয়ে অনেক টাকা চলে গেল বলে কষ্ট বোধ করেন। কিন্তু ধন-সম্পদের যাকাত দিতে কষ্ট বোধ করা বোকামী। কারণ ধন-সম্পদের আসল মালিক হলেন আল্লাহ তা’আলা। আমরা শুধু এটা ব্যবহার করার মালিক।
আমাদের সকলকে মনে রাখতে হবে সম্পদ আল্লাহর অনুগ্রহে অর্জিত হয়ে থাকে, মানুষ নিজের বাহুবলে, মেধাবলে, জ্ঞানবলে সম্পদ উপার্জন করতে পারে না। তাই সম্পদ আল্লাহর মেহেরবানী, সম্পদ আল্লাহর অনুগ্রহ কথাটি কখনোই ভুললে চলবে না।
জাকাত আদায় করলেই কি দায়িত্ব আদায় হয়ে যাবে। আমাদের অনেকেরই ধারণা এমন। জাকাত দেয়া হয়ে গেল তো আর কোনো দায়িত্ব থাকল না। এমন ধারণা সর্বাংশে ভুল। যাকাত বিষয়ে জানতে ইসলামের বিধানাবলির গভীরে প্রবেশ করতে হবে আমাদের। জাকাতের বিধান শরিয়তে আবশ্যকীয় করে দেয়া হয়েছে। চল্লিশভাগের একভাগ আদায় না করলে পূর্ণ সম্পত্তি অপবিত্র থাকবে। কিন্তু এরপর দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। জাকাত আবশ্যকীয় করা হয়েছে অভ্যাস করানোর জন্য। যাকাতের মাধ্যমে সমাজের ও জাতীয় প্রয়োজনে যেন অভাবী দুস্থ মানুষের সহায়তায় এগিয়ে আসতে পারে। রাসুল (সা.) স্পষ্ট করে বলেছেন, জেনে রেখ, সম্পদে জাকাত ছাড়াও আরও হক রয়েছে। (তিরমিযি)
গত দু-বছর ধরে করোনাভাইরাস মহামারিকাল চলছে, এখন মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের মানুষ চরম অবস্থার ভেতর রয়েছে। এসময় যারা বিত্তশালী আছেন জাকাত আদায় করলেই তাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। যতদিন দেশে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরে না আসে ততদিন সাধ্যমতো সবাইকেই চেষ্টা করতে হবে দুর্যোগ মোকাবেলা করার।
আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, লোকেরা আপনার নিকট জিজ্ঞেস করে তারা কী খরচ করবে? আপনি বলুন, প্রয়োজন অতিরিক্ত সব কিছুই ব্যয় করো। (সুরা বাকারা, আয়াত: ২১৯)
এটাই ইসলামের শিক্ষা। কেবল জাকাত নয়। নিজের সাধ্যের সবটুকু দিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। সদকার মর্মার্থ কেবল চল্লিশভাগের একভাগ নয়। চল্লিশ ভাগের একভাগ দিয়েই সব দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না।
মূল কথা হচ্ছে মহানুভবতা ও সহানুভূতি। মানবিক বোধ ও সহমর্মিতার গুণ। সমাজের অর্থনৈতিক ও মানবিক সংকট থেকে উত্তরণে আন্তরিক প্রয়াস প্রতিটি মুমিনের কর্তব্য। যাদের ওপর যাকাত ফরজ নয় তাদেরও একথা বুঝে নিতে হবে। হাত গুটিয়ে না থেকে আমাদের ভেতর তৈরি করতে হবে বদান্যতা ও দানশীলতার গুণ।
দানশীল ব্যক্তি আল্লাহর নিকটবর্তী, মানুষের নিকটবর্তী, জান্নাতের নিকটবর্তী, জাহান্নাম থেকে দূরে। বখিল আল্লাহ থেকে দূরে, মানুষ থেকে দূরে, জান্নাত থেকে দূরে, জাহান্নামের নিকটবর্তী। (তিরমিযি)
এ পবিত্র মাহে রমজানে বেশি বেশি দান সদকা করি। ছিন্নমূল দুস্থ নিরন্ন ও সব অসহায়ের কষ্টগুলো উপলব্ধির চেষ্টা করি। মহান আল্লাহ আমাদের সকলকে তাঁর বিধি-বিধান সঠিক ও পূর্ণাঙ্গভাবে মেনে চলার তওফিক দান করুন। আমিন।