ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুরা জাতীয় নির্বাচনের পর বোধ করি প্রথম রাজপথে দাঁড়িয়ে দাবি জানালেন, ‘দেশের সংখ্যালঘুরা ভালো নেই’ (প্রথম আলো ২৬.৫.২০১৯)। বিগত ২৬ মে, ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ক্ষুব্ধচিত্তে নেতৃবৃন্দরা বলেছেন, ‘আমরা আতঙ্কের সঙ্গে লক্ষ করছি, এ বছরের এপ্রিল মাস পর্যন্ত সারা দেশে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর ২৫০টি হামলা চালানো হয়েছে। এই সরকার সাম্প্রদায়িক হামলায় জিরো টলারেন্সের কথা বললেও প্রশাসন ও আওয়ামী লীগের ভেতরে ঘাঁপটি মেরে থাকা সাম্প্রদায়িক শক্তি নির্যাতন করছে। …সংখ্যালঘুদের ওপরে নির্যাতন, অত্যাচার হচ্ছে। এসব নিয়ে কথা বলতে আমাদের কেন বারবার রাস্তায় দাঁড়াতে হবে?’ উল্লেখ্য যে, বিগত বছরের একটি চিত্রও ইতিমধ্যে উপস্থাপন করা হয়েছে। দেখা যায়, ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে ১০৭ জন সংখ্যালঘু খুন, ২৫ নারী-শিশু ধর্ষণের শিকার, ২৩৫টি উপাসনালয় ভাঙচুর করা হয়েছে।
বিগত ২২ মে তারিখে সাতক্ষীরা’র তালা উপজেলার মহান্দী গ্রামে উপস্থিত হয়েছিলাম। এপ্রিল ১০, ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের রাতে কে বা কারা মহান্দী এসেমব্লিজ অব গড চার্চের পুরোহিত পাষ্টর অনাদি বিশ^াসের বাসস্থানটিকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। স্থানীয় পত্র-পত্রিকায় বলা হয়েছে, ‘…এতে কোনো প্রাণহানির ঘটনা না ঘটলেও মিশনের চারটি ঘরে রক্ষিত কমপক্ষে আটটি কম্পিউটার, দুটি ল্যাপটপ, কয়েকটি সিলিং ফ্যান এবং ২৩৩ জন শিশুর জন্য রাখা শিক্ষা উপকরণ, ব্যাগ, শুকনো খাবার, স্বাস্থ্যসেবার যাবতীয় উপকরণ, মূল্যবান কাগজপত্র এবং অন্যান্য সম্পদসহ ২০ লাখ টাকার মালামাল পুড়ে গেছে (দৈনিক সুপ্রভাত সাতক্ষীরা, ১২.৪.২০১৯)। অপরদিকে পুরোহিত অনাদি বিশ^াস তালা থানায় ডায়েরিতে উল্লেখ করেছেন, ‘…অফিস ও কোয়াটারে থাকা যাবতীয় মালামাল/বিল্ডিং আগুনে পুড়ে (৩২,০০০০+৫,০০০০) = (সাঁইত্রিশ লক্ষ) টাকার ক্ষতি সাধন হয়।’ সেদিন চারটি কক্ষ ঘুরে ঘুরে স্বচক্ষে অবলোকন করেছি, আগুনের তীব্রতা বা লেলিহান যে অপ্রতিরোধ্য ছিল, সেটি লোহার খাট, ওয়ারড্রোব, ফ্যান কিংবা আরো লোহার তাকগুলো পর্যবেক্ষণ করলেই অনুমিত হয়। স্থানীয় ফায়ার সার্ভিসের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় ভোর রাতে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। প্রাথমিকভাবে দায়িত্বরত কর্মকর্তাগণ বলেছিলেন, শর্ট সার্কিট থেকে আগুণের সূত্রপাত হতে পারে। পরবর্তীকালে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, থানা নির্বাহী অফিসারসহ বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাগণ পরিদর্শন করেছেন। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ এক প্রকার পুরোহিত অনাদি বিশ^াসকে শাসিয়ে গেছেন যে, তিনি যেন এ বিষয়ে কোনো বিতর্কমূলক বক্তব্য, সাম্প্রদায়িকতামূলক তথ্যাদি কিংবা প্রশাসনের নিরপেক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ না করে!
আমাদের টিমের সামনে অশ্রুসজলে বলছিলেন, ‘আমি বিগত ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে প্রভু যিশু খ্রিষ্টকে বিশ^াস ও গ্রহণ করেছি। অতঃপর কয়েক দফা ধর্মীয় প্রশিক্ষণের পর মহান্দীতে চার্চের দায়িত্ব গ্রহণ করেছি।’ জানা যায়, পুরোহিত অনাদি বিশ^াস বাগেরহাট জেলার চিতলমারী উপজেলার দরিউমাজুরি গ্রামের বাসিন্দা। বাক্রুদ্ধ হয়ে বলার চেষ্টা করেছেন, স্বর্গের ঈশ^রই জানেন, আগুনটি কে বা কারা অথবা শর্ট সার্কিটে লেগেছে! তবে তার আকার-ইঙ্গিতে বুঝেছি, আগুনের পেছনে শত্রুতা রয়েছেই। আশপাশের লোকজন এবং আশপাশের পুরোহিতদের সাথে কথা বলে যে বিষয়গুলো আবিষ্কার করেছিÑ
১. খ্রিষ্টিয়ান পুরোহিত অনাদি বিশ^াস (৩৮) হিন্দু ধর্মের এবং হিন্দু অধ্যুষিত এলাকার হওয়ায় এবং খ্রিষ্টিয়ান ধর্মে ধর্মান্তরিতকে পিতৃপুরুষের ধর্মকে উপেক্ষা এবং অবমূল্যায়ন করার ক্ষোভ ছড়িয়েছে;
২. তালা সাতক্ষীরায় শিশুদের প্রজেক্টে ইসলাম, হিন্দু, খ্রিষ্টান, অন্ত্যজ শ্রেণীর শিশুরা পড়াশোনা, শিক্ষার উপকরণ এবং আনুসাঙ্গিক খরচাদি যোগানকে ধর্মান্তকরণের হাতিয়ার হিসেবে অপব্যাখ্যা চালানো হয়েছে;
৩. বিগত প্রায় তিন দশক পূর্ব থেকেই স্থানীয় বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সাথে মনোশৈথিল্য ভাবধারা চলমান রয়েছে; খ্রিষ্টিয়ান ধর্মবিশ^াস, পুরোহিতদেরকে সমাজ বিশৃঙ্খলার আভ্যন্তরীণ কারণ হিসেবে বিবেচনা করে;
৪. খ্রিষ্টিয়ানদের সেবামূলক কাজকে সর্বদা সন্দেহের চোখে দেখা এবং ধর্মান্তকরণের প্রাথমিক ফাঁদ হিসেবে জনসাধারণের কাছে উপস্থাপন করা;
৫. ধর্মীয় উগ্রবাদিরা সব সময়ই লক্ষ করেছেন, এখানে খ্রিষ্টিয়ান প্রতিষ্ঠানসমূহের বিভিন্ন পর্যায়ের লোকজনের গমনাগমন রয়েছে; এই শক্ত ঘাঁটিকে ধ্বংস করতে সক্ষম হলেই ধর্মীয় সংখ্যালঘু খ্রিষ্টিয়ান সম্প্রদায়ের বিশ^াসীরা ধর্ম ত্যাগ করে স্বধর্মে প্রত্যাবর্তন করার সম্ভাবনা রয়েছে। ইতিপূর্বেও এরূপ দুয়েকটি নজির এলাকায় রয়েছে।
৬. খ্রিষ্টিয় বিশ^াসীদেরকে তৃতীয় শ্রেণীরও নিচু শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়; এই কারণে তাদের সাথে ওঠা-বসা কিংবা সম্পর্ক স্থাপনকে সামাজিকভাবে নিরুৎসাহিত করা হয়।
খ্রিষ্টিয়ান পুরোহিত অনাদি বিশ^াস সাহসের সাথেই বলেছেন, ‘এই জায়গা ছেড়ে আমি কোথাও যাব না, আমি আমার আচরণ, চিন্তা- চেতনা, কাজ ও প্রতিটি পদক্ষেপে দিয়েই প্রমাণে সচেষ্ট হবো, আমি ধর্মকে সংরক্ষণ করি, এলাকার জনসাধারণকে ভালোবাসি, দেশকে সেবা দিয়ে নিরপেক্ষতা তুলে ধরবো।’
কেউ কেউ হয়ত বলবেন, এরকম ঘটনা তো অহরহই ঘটছে, তাহলে কেন দুঃশ্চিন্তা কিংবা শঙ্কিত হচ্ছেন! কারণ হলো, সংখ্যালঘুদের একটি ঘটনাই সুদূর প্রভাব ঘটিয়ে থাকে; পুরো এলাকা, দেশ জুড়ে চাঁও হয়ে যায়। আর এতে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের হার্টবিট বেড়ে যায়। সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা বিধানে সরকারকে আরো বেশি সচেতন ও যতœশীল হতে হবে।
২
নিকট সম্প্রতিতে ময়মনসিংহের কলসিঁন্দুর গ্রামে মেয়েদের অর্জিত মেডেল, ট্রফি, সনদ, উপহারসামগ্রী কে বা কারা যেন রাতের অন্ধকারে পুড়িয়ে দিয়েছে। ৬ মে থেকে রমজান উপলক্ষে কলসিঁন্দুর উচ্চমাধ্যমিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ বন্ধ থাকায় এবং দুর্বল ছেলেমেয়েদের বিশেষ ক্লাস চলমান সুবাধে পরের দিন মঙ্গলবার শিক্ষার্থীরা স্কুল প্রাঙ্গনে পৌঁছালে ঘটনাটি টের পায়। বলা হয়েছে, ‘দুর্বৃত্তরা তালা ভেঙে আগুন দিয়েছে। স্কুলের অফিস কক্ষ খোলার পর দেখা যায়, কাঠের টেবিলের ওপর ও মেঝেতে গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র ও সনদ পোড়া অবস্থায় পাওয়া গেছে। কাগজ ছাড়াও একটি কম্পিউটারের অংশবিশেষ পোড়া অবস্থায় দেখা যায়।’ বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা ফুটবল দলের অন্যতম সদস্য আদিবাসী গারো মেয়ে মারিয়া মান্দা ঘটনাটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে আবেদনে বলেছেন, ‘আমি চাই যেন এই অগ্নিকা-ের সুষ্ঠু বিচার হয়। ঘটনার তদন্ত করলেই দোষীদের বের করা যাবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমরা এর বিচার চাই। আবারও কখনো যদি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা হয়, তাহলে আমরা প্রকৃত দোষীদের খুঁজে বের করে কঠিন শাস্তি দিতে অনুরোধ করব। ভবিষ্যতে যেন এই স্কুলে এমন ঘটনা আর না ঘটে, সেটাই আমাদের প্রত্যাশা।’
এই কলসিঁন্দুর থেকেই উঠে এসেছে শিউলি মানকিন, মার্জিয়া, তহুরা, সাজেদা, সাজেদা আক্তার, তাসলিমা আক্তার, শামসুন নাহার, মাহমুদা আক্তার, নাজমা আক্তার ও মারিয়া মান্দা। এই অজো পাড়া গাঁয়ের মেয়েদের উৎসাহিত ও উজ্জীবীত করে রেখেছেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মিনতী রানি শীল। এই নারী ফুটবলার দেখে আদিবাসী মেয়েরা যেমন ফুটবল মাঠমুখী হচ্ছে, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মেয়েরাও সামাজিক বাধা-বিপত্তি টপকে সামনে এগিয়ে চলেছেন। ইতোমধ্যেই মারিয়া মান্দাকে ইউনিসেফ সেরা সংগ্রামী কিশোরী হিসেবে রোল মডেল মনে করছে বাংলাদেশের কিশোরী ফুটবলার মারিয়া মান্দাকে। ইউনিসেফ বলেছে, ‘ও বিশে^র রোল মডেল। আমরা ওর সংগ্রামী জীবন আর আত্মপ্রত্যয়ের কথা ছড়িয়ে দিবো সারা বিশে^। ও অনুকরণীয়।’ কলসিঁন্দুরে আগুনে প্রতিথযশা খেলোয়াড়দের সনদ পোড়ানো ও বিদ্যালয়ের কাগজপত্র পোড়ানোতে কতকগুলো সন্দেহের অবকাশ ঘোরাঘুরি করে।
১. নারীরা ফুটবল খেলবে, সেটিকে অনেকে পছন্দ করেন না; এক শ্রেণীর ধর্মান্ধরা এটিকে ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়ে স্তব্ধ করতে প্রত্যাশী;
২. আদিবাসী নারীরা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে উপেক্ষা করে দেশের পক্ষে লড়বে, এটিও সহনীয় নয়; তাদেরকে নিরুৎসাহিত করতে প্রাথমিক পদক্ষেপ গ্রহণীয় আবশ্যিক;
৩. আদিবাসী নারীরা ধর্মে খ্রিষ্টিয়ান; দুয়েকবার সাক্ষাৎকারে বলেছেন, খেলার পূর্বে প্রার্থনা করা, ঈশ^রের আশির্বাদ যাচনা করাকে ধর্মান্ধরা অপব্যাখ্যা দিতে পারে;
৪. স্থানীয় অর্থবিত্তবান কিংবা রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের চেয়েও সুনাম ও সম্মান, যশ ও খ্যাতিতে ঈর্ষান্বিত হওয়া স্বাভাবিক, এটি থেকেও হতে পারে;
৫. আদিবাসী নারীদের উত্থানকে ক্ষমতার হুমকিও মনে হতে পারে; যেমনÑ ইতিমধ্যেই মারিয়া মান্দা বলেছেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ হলে বিষয়টি তদন্ত করার অনুরোধ জানাবেন ইত্যাদি।
বিশ^াস করি, এই প্রত্যন্ত অঞ্চলের খেলোয়াড়দের সুবাদেই কলসিঁন্দুর উচ্চমাধ্যমিক স্কুল অ্যান্ড কলেজকে সরকার সরকারি হিসেবে ঘোষণা করেছেন। পথ চলাতে বিঘœ থাকবে, কণ্টকাকীর্ণ বন্ধুর পথে তবুও এগিয়ে যেতে হবে। শাস্ত্রে বলা হয়েছে, ‘সকল বিষয়েরই সময় আছে, ও আকাশের নিচে সমস্ত ব্যাপারে কাল আছে।’ রাতের পরেই দিন, দুঃখের পরেই আনন্দ এবং ব্যর্থতার পরেই সাফল্য।
মিথুশিলাক মুরমু : আদিবাসী গবেষক ও লেখক।