উনিশ গিয়ে বিশের আগমনের শুরুতেই বাংলার ভাগ্যাকাশে বিজয় নিশান উড়িয়েছিল উদিয়মান বাংলার এক ঝাঁক তরুণ ক্রিকেটার ছিনিয়ে এনেছিল বিজয়ের সেই শিরোপা ৯ই ফেব্রুয়ারি বিশে। ভেবেছিলাম বাংলার নীল আকাশ হয়ত আর ঘনিভূত হবে না বিশৃঙ্খলায় পুঞ্জীভূত কালো কালো মেঘে আর যদি না হতো কারোরই স্বপ্ন মরণ! অথচ কয়েকদিন গড়াতেই মার্চে শুরু হলো মহা-আতঙ্কের ঝড় করোনা ভাইরাস। মার্চ আট যখন প্রথম করোনা নির্ণয়ের পরে তা তিন থেকে উনচল্লিশে পৌঁছাল আর ছাব্বিশে মার্চ ঘরবন্দী হলাম মানে ‘লক ডাউন’ মানেই অপরিচিত শব্দটা হৃদয়াঙ্গম করতে অভ্যস্ত হতে বাধ্য করল আমাদের করোনা। প্রথম মৃত্যু হলো আঠারোই মার্চ।
বাতাসে লাশের গন্ধ আর স্বপ্ন বোনা পাখিদের প্রাণনাশ হতে থাকল আর তা যেন তীব্র থেকে তীব্রতর হতেই থাকল আমরা যারা স্বপ্ন নিযে বেঁচে আছি তাদের কাছে। শুধু এটাই নয় আশীর্বাদ পুষ্ট সমাজ, রাষ্ট্র যেন বিশৃঙ্খলতার তীব্র গন্ধে আজও নিমজ্জমান। চারিদিকে ভাসছে যেন অস্থিরতার গ্লানি, বিষণ্নতা। অভাব, অনটন, দুর্নীতি, রেষারেষী, কলহ, বিচ্ছেদ, ধর্ষণ ও আত্মহত্যার মতো ঘৃণ্য অপরাধ সকল।শান্তি যেন কারো না কারো ভাণ্ডার ঘরে আজ আত্মহত্যা করেছে। বন্যা আমাদের করেছে পঙ্গু, ধর্ষণ আমাদের করেছে লাঞ্ছিত—আত্মহত্যা আমাদের হৃদয়ে তুলে দিয়েছে বিষাদের করুণ সুর। এত পাওয়ায় কি বেঁচে আছি, নাকি না মরে বেঁচে আছি তা বুঝতেই পারছি না। জানলাম বিগত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় নাকি এই বিশের বিষ।
উন্নত হয়েছি আজ তাই তো সমান্তরালভাবেই উন্নয়ন হচ্ছে দুর্নীতি, ধর্ষণ, আত্মহত্যা, প্রাকৃতিক বিপর্যয় আমাদের শিক্ষা সাংস্কৃতি ও সম্পর্কের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করে দিয়েছে। ভাটাপড়ছে সকল প্রাপ্তির পাওয়া আনন্দগুলো—নতুন বছর, ২৬ শে মার্চ ১লা মে, ১৬ই ডিসেম্বর, ২৫ শে ডিসেম্বরের সব আনন্দগুলো কিংবা শোকের ১৫ই আগস্ট। চলে গেছে সকল প্রকার বাহ্যিক অনুষ্ঠান, ঘরকুনো হয়ে গেছি আমরা পৃথিবীর মানুষগুলো। আর তা করেছে ঐ করোনা তাই তো মাঝে মাঝ মনে হয় এটা কি বিশ না কি বিষ।
বিশে যে মিষ্টতা ছিল না তা বলছি না কিন্তু তা যেন সাগরের মধ্যে হাবুডুবু খাওয়া নৌকার মতোই ভাসছে আর ডুবছে। ১৯৭১ এর সেই বীর বাঙালি যারা পৃথিবীর মানচিত্র পাল্টে লাল সবুজে আঁকা বাংলাকে স্থান করে দিয়েছিল তারা তো এখনো মরেনি। তাদের রক্ত কণা প্রবাহিত হচ্ছে আমাদের শিরা-উপশিরায়।
অনেক না দেখা অসম্ভবকে দৃশ্যমান করে বিশ্ব দরবারে নিজেদেরকে আরো উঁচু করে তুলতে অকুতোভয়ের মতো কাজ করে যাচ্ছে সেই সব বীর বাঙালিকে বিনম্র শ্রদ্ধা। তাঁদের মনে রাখবো যারা এই বিশের বিষে আত্মাহুতি দিয়েছেন—আমরা যারা এখনও বেঁচে আছি ।
প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম খুঁজে পাবে ইতিহাসের পাতায় এই বিষে ভরা বিশকে। তবুও বলব এই বিষে ভরা বিশ যেন আর না আসে এই পৃথিবীতে, আসুক নতুন সূর্য, নতুনভাবে আলো দিয়ে যাক সকলের হৃদয়ে হৃদয়ে চাঁদের কিরণে জোছনা রাতে বাগানের ফুলগুলোর মতোই আনন্দে নাচুক আমাদের তৃষ্ণার্ত মনপ্রকৃতি দিক নির্মল সেই অক্সিজেন পূর্ণ বাতাস—সেই আশায় হয়ত আজও বেঁচে থাকা আমার ।
● অলোক মজুমদার : চিকিৎসক ও লেখক।