মহানগরী ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে বেশি জনবসতিপূর্ণ শহরগুলোর একটি। কর্মব্যস্ত দিন, এমনকি ছুটির দিনেও যানজটে অচল, স্থবির হয়ে পড়ে ঢাকা। অথচ প্রশাসনিক কর্মকান্ড, কর্মসংস্থান থেকে শুরু করে বিভিন্ন কাজের কেন্দ্রস্থল রাজধানী ঢাকা। সমীক্ষা বলছে, আগামী দেড় দশকে ঢাকার জনসংখ্যা ৫৫ শতাংশ বেড়ে যাবে। দৈনিক যাতায়াত বাড়বে ৭১ শতাংশ। এরই ধারাবাহিকতায় যানজট বেড়ে হবে দ্বিগুণ। সড়কে যানজট, নৈরাজ্য এ থেকে কি পরিত্রাণ নেই? এ অবস্থা থেকে আমাদের প্রিয় রাজধানীকে বাঁচাতে এখনই নিতে হবে সঠিক দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যথাযথ উদ্যোগ।
একটি দেশের একটি আধুনিক শহরে শান্তিপূর্ণ ও স্বস্তিদায়ক চলাচলের জন্য মোট আয়তনের ২০ থেকে ২৫ ভাগ সড়ক থাকা প্রয়োজন। কিন্তু মেগাসিটি ঢাকায় সড়ক আছে মাত্র ৭ থেকে ৮ ভাগ। অর্থাৎ যতটা প্রয়োজন তার মাত্র এক-তৃতীয়াংশ সড়ক আছে। ট্রাফিক বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, সেই সড়কের প্রায় ৩০ ভাগ বা তার বেশি দখল হয়ে আছে অবৈধ পার্কিং, হকারসহ নানা ধরনের দখলদারদের হাতে। ফুটপাত হকারদের দখলে থাকায় প্রধান সড়কের ওপর দিয়ে হেঁটে চলেন নগরবাসী। ফলে যানজটের সঙ্গে তৈরি হয় জনজট সমস্যা। এমন দৃশ্য প্রায়ই দেখা যায়-গাড়ি চলার জন্য সবুজ সংকেত পাওয়া মাত্রই থেমে থাকা গাড়িগুলো, কার আগে কে যাবে শুরু হয় হুরোহুরি। ফলশ্রুতিতে শুরু হয় আরেক বিশৃঙ্খলা। এটিও যানজটের আরেক কারণ।
বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, রাজধানী ঢাকায় যানজটের কারণে প্রতিদিন ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। যাতে রাষ্ট্রের এবং জনগণের সম্মিলিত আর্থিক ক্ষতি হয় বছরে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। আর্থিক ক্ষতি ছাড়াও শারীরিক, মানসিক ক্ষতিতে জীবন হয়ে ওঠে আরও দুর্বিষহ। যানজটের কারণে নির্ধারিত সময়ে ঢাকার মধ্যে যেকোনো গন্তব্যে পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়েছে।
প্রাথমিকভাবে রাজধানী ঢাকায় যানজটের অন্যতম প্রধান কারণ অতিরিক্ত ব্যক্তিগত গাড়ির উপস্থিতি বলে মনে করা হয়। রাস্তার যানবাহনের প্রায় ৮০ শতাংশ ব্যক্তিগত গাড়ি। কোনো কোনো সময় দেখা যায়, ব্যক্তিগত গাড়ির ড্রাইভার ও একজন যাত্রী। একটি রিপোর্টে দেখা যায়, রাজধানীর মোট রাস্তার ৫৪.২ শতাংশ জায়গা দখলে রাখে প্রাইভেটকার।
সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকাসহ সারাদেশের সড়কেই বাড়ছে মোটরবাইকের সংখ্যা। রাইডশেয়ারিংয়ে মোটরবাইকের ব্যবহারও আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। ঢাকার অনেক রাস্তাই থাকে এই যানটির দখলে। রাজধানীর সড়কে মোটরবাইকের মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি, চালকদের চরম অদক্ষতাসহ নানা কারণেই দুর্ঘটনা বাড়ছে। সড়ক দুর্ঘটনার জন্য এককভাবে সবচেয়ে বেশি দায়ী করা হচ্ছে মোটরবাইকে।
মোটরবাইক দুর্ঘটনা শীর্ষে থাকার প্রধান কারণ হেলমেট ব্যবহার না করার প্রবণতা, ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন ও বেপরোয়া ড্রাইভিং। আর অদক্ষ এবং লাইসেন্সবিহীন চালক তো আছেই।
শুধু বাংলাদেশে নয়, সারাবিশ্বেই মোটরবাইক থ্রি ও ফোর হুইলারের চেয়ে ৫০ থেকে ১০০ ভাগ বেশি ঝুঁঁকিপূর্ণ। এখন প্রচুর ফ্রিল্যান্স মোটরবাইকার আছে। ফলে নিরাপত্তা ও সড়ক ব্যবহারের দিক থেকে বড়ো সংকট তৈরি করবে যদি এখনই কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা না যায়।
সুষ্ঠু পরিকল্পনা না থাকায় নগরীতে গাড়ির সংখ্যা বাড়লেও গণপরিবহন সংকট তীব্র। বস্তুত গণপরিবহন খাতে বিদ্যমান বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা যানজটের একটি বড়ো কারণ।
পরিবহন বিশেষজ্ঞ না হলেও ভুক্তভুগির অভিজ্ঞতায় প্রাথমিক কিছু উপায় উত্থাপন করছি-সরকারের ভবিষ্যত পরিকল্পনা কাজে লাগতে পারে। যারা প্রতিদিন এই যানজটের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হন, তাদের কাছ থেকে শোনা কিছু পরামর্শ যানজট নিরসনে কিছুটা হলেও কাজে লাগতে পারে। স্বল্পমেয়াদে পদক্ষেপগুলো নিলে সুফল পাওয়া যেতে পারে। যানজট কমাতে প্রথমেই যে গুরুত্বপূর্ণ কাজে হাত দেওয়া প্রয়োজন তা হলো, ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণে আনা। বিশ্বের অনেক দেশেই এটি চালু আছে। জোড়-বিজোড় সংখ্যায় নিবন্ধিত ব্যক্তিগত গাড়ি একদিন পরপর চলাচল করবে। তবে এও ঠিক চাইলেই এটা করা কঠিন, কেননা যারা ইতিমধ্যেই ব্যক্তিগত গাড়িতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে তাদের সেখান থেকে বের হওয়া কঠিনই। এমন ক্ষেত্রে গণপরিবহনের সংখ্যা এবং সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে।
গণপরিবহন ব্যাবস্থাকে গুচ্ছ মালিকানা ব্যবস্থার মধ্যে নিয়ে আসা যেতে পারে। প্রতিটি রাস্তায় গণপরিবহন নির্দিষ্ট সময় অনুযায়ী ছেড়ে আসবে, প্রতিটি স্টপেজে নির্দিষ্ট সময় দাঁড়াবে, তারপর চলে যাবে। একই রুটে একই কোম্পানির গাড়ি চলাচল করবে। ফলে রাস্তায় নৈরাজ্য, যাত্রী নিয়ে টানাটানির মতো ঘটনা ঘটবে না। পরিবহন মালিক এবং সরকার এদিকে নজর দিলে যানজটের তীব্রতা কিছুটা কমিয়ে আনা সম্ভব। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় আরও লোকবল নিয়োগ ও কঠোর নজরদারি করতে হবে। অফিস শুরু এবং শেষের সময় বিবেচনায় কিছু সমান্তরাল সড়কে একমুখী যান চলাচল ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে; এতে সুফল পাওয়া যেতে পারে। ইউলুপ নির্মাণ করা। যেখানে-সেখানে গাড়ি ডানে, বাঁয়ে চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা। একই সড়কে যান্ত্রিক বাহন এবং অযান্ত্রিক যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা। তার আগে রিকশাচালকদের জন্য সড়ক নির্দিষ্ট করে দিতে হবে।
যদিও এখন কিছু কিছু এলাকায় এই ব্যবস্থা চালু রয়েছে। এটি বিস্তৃত করা যেতে পারে। নির্দিষ্ট এলাকার বাইরে যেখানে-সেখানে গাড়ি পার্কিং ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে। পার্কিংয়ের নিয়ম ভঙ্গ করলে উচ্চহারে জরিমানা আরোপ করা যেতে পারে। তবে কেবল জরিমানা আদায় করেই দায় সারা যাবে না; চালকদের ট্রাফিক সিগন্যাল মান্য করা, গাড়ি চালনার দক্ষতা বাড়াতে নিয়মিত সচেতনতামূলক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণে উৎসাহিত কিংবা বাধ্য করতে হবে। চালকরা সচেতন হলে কাজগুলো নিশ্চিতভাবেই অনেক সহজ হবে। মানুষ হেঁটে চলার জন্য ফুটপাত হকারমুক্ত করে দিতে হবে। হকারদের জন্য হলিডে মার্কেট চালু করা যেতে পারে। এখন যেসব এলাকায় সাপ্তাহিক বন্ধের দিন আছে, সেসব এলাকায় ওইদিন হকারদের বসার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। স্বল্প দূরত্বে নাগরিকদের হেঁটে চলার জন্য জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। সাইকেল ব্যবহারে উৎসাহিত করতে হবে, তেমনটা হলে যানজট কমার সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশেরও দূষণ কমবে।
রাজধানীর যানজটের প্রধান কারণগুলো হলো যত্রতত্র পার্কিং, আইন লঙ্ঘন করে গাড়ি চালনা, ব্যক্তিগত গাড়ির আধিক্য ও গণপরিবহনের স্বল্পতা। জরিমানার অঙ্ক বাড়ানো গেলে অবাধে গাড়ি পার্কিং কমবে। ব্যক্তিগত গাড়ি পার্ক করায় সড়ক সরু হয়ে যায়। ফলে গণপরিবহনগুলো ধীরগতিতে চলতে বাধ্য হয়। চালকরা মেতে ওঠে কে আগে যাবে প্রতিযোগিতায়, ফাঁক পেলেই গাড়ি ঢুকিয়ে দেয়। ট্রাফিক আইন মেনে চলতে হবে সব ধরনের গাড়িচালককে। পার্কিং স্পট বাড়ানোর পাশাপাশি বিদ্যমান স্পট ব্যবহারও নিশ্চিত করতে হবে।
যানজট নিরসনে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হিসেবে-রফতানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঢাকার পর্যায়ক্রমে বাইরে স্থানান্তর করা। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে যেসব পণ্য আমদানি ও রফতানি হয়, সেগুলোর যাবতীয় কাজ যাতে চট্টগ্রাম থেকে ওয়ানস্টপ সেবার মাধ্যমে সম্পন্ন করা যায়, তার ব্যবস্থা করা।
নগরীকে বাসযোগ্য রাখতে প্রয়োজন ব্যাপকভিত্তিক পরিকল্পনা ও এর বাস্তবায়নের উদ্যোগ। এ জন্য সরকারের সদিচ্ছা এবং দৃঢ় মনোবল দরকার। সরকার চাইলে রাজধানীর যানজট নিরসন একেবারেই অসম্ভব এবং সময়সাপেক্ষ হওয়ার কথা নয়। আমরা নিম্নমধ্যম আয় এবং উন্নয়নশীল দেশের কাতারে পৌঁছে গেছি। যে লক্ষ্যে আমরা এগোচ্ছি তা বাস্তবায়ন করতে গেলে আর সময়ক্ষেপণ না করে এখনি সম্মিলিত উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। সরকারের মতো আমরা সাধারণ নাগরিকরা আশাবাদী রাজধানীতে মেট্রোরেল চালু হলে যানজট অনেকটাই কমবে। তবে কেবল মেট্রোলের আশায় বসে থাকলেই হবে না পাপাশাপশি যানজট হ্রাসে অন্যান্য কার্যকরী পদক্ষেপগুলোও বাস্তবায়নে জোরদার হতে হবে।
কায়সার আহমেদ