বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে ডেঙ্গুর উপদ্রব মহামারি আকার ধারণ করেছে। ডেঙ্গু এখন আর শুধু রাজধানীতে সীমাবদ্ধ নেই। ঢাকার বাইরে সারা দেশে বিস্তার লাভ করেছে এটি। সব বয়সী মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, তবে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ শিশুদের নিয়ে। ঢাকায় শিশুদের রীতিমতো পাহারা দিয়ে রাখতে হচ্ছে এডিস মশার হাত থেকে। দরজায় নেট, জানালায় নেট। এরপরও রক্ষা নেই। যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তাতে এতোক্ষণে জাতীয় সতর্কতা জারি করা উচিত ছিল।
‘মশা মারতে কামান দাগা’ কথাটির ব্যবহার করতাম সামান্য কাজের জন্য বিরাট আয়োজন বোঝাতে। কিন্তু বর্তমানে ডেঙ্গুর প্রকটতায় শুধু কামান দাগানোই না মশা মারতে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ পর্যন্ত দেখতে হচ্ছে আমাদের। যেকোনো ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা মহামারিতে একটি দেশ কীভাবে কাটিয়ে উঠবে সেটা নির্ভর করে মূলত সেসব দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার এবং সংকটময় অবস্থায় কীভাবে চিকিৎসা দেওয়া হয় তার ওপর মশাবাহিত রোগগুলোর মধ্যে এক সময় বাংলাদেশে ম্যালেরিয়াই বেশি পরিচিত ছিল। তখন এই ম্যালেরিয়া আতঙ্ক ছিল ঘরে ঘরে। এখনো বাংলাদেশের পাহাড়ি এলাকায় ম্যালেরিয়ায়ার প্রাদুর্ভাবের কথা শোনা যায়। সেখান থেকে মৃত্যুর খবরও পাওয়া যায়।
মশাবাহিত আরেকটি রোগ চিকুনগুনিয়া, এ রোগে মৃত্যুর কথা খুব বেশি শোনা না গেলেও মানুষকে কর্মহীন করে দিয়েছে এবং বেশ ভুগিয়েছে সেসময় মানুষকে। তবে আধুনিক জীবন ধারায় আমাদেরকে ধ্বংস করে দিচ্ছে এই মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু। পুরো দেশ এখন এটা নিয়ে উত্তাল ও উদ্বিগ্ন। প্রতিদিন আসছে মৃত্যুর সংবাদ। মারা যাচ্ছে নারী, পুরুষ, শিশু, এমন কি মারা যাচ্ছে অভিজ্ঞ ডাক্তারও। এখন পর্যন্ত কয়েক হাজার মানুষ এই রোগে আক্রান্ত। আসলে ডেঙ্গু এর আগেও হয়েছে, তবে এমন মহামারী আকার ধারণ করেনি! দেশে প্রথম বড়ো আকারে ডেঙ্গু প্রকোপ দেখা দেয় ২০০০ সালে, সরকারি হিসাবে ওই বছর ৫ হাজার ৫৫১ জন আক্রান্ত হয়েছিল আর মারা গিয়েছিল ৯৩ জন। এরপর ডেঙ্গু জ্বরে মৃতের সংখ্যা কমতে থাকে। গত বছর ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে যায়। মারা গিয়েছিল ২৬ জন। এবছর ঢাকায় মহামারি আকারে দেখা দেয় এ রোগ। চিকিৎসকরা বলছেন, এবারের ডেঙ্গু অন্যবারের তুলনায় ভয়ঙ্কর। গবেষকরা বলেছেন, জানুয়ারি-জুলাই এসময়ে মশাবাহিত রোগের যে প্রভাব থাকে সেপ্টেম্বর-আগস্টে আরো বেশি হয় তার মানে দাঁড়ায়, সামনে ডেঙ্গু প্রকোপের ঝুঁকি আরো বেশি রয়েছে। এখনই যদি এ অবস্থা হয় তবে তখন পরিস্থিতি আরও ভয়ানক হয়ে উঠবে। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২৯ জুলাই পর্যন্ত সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে বাংলাদেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ প্রায় ১৪ হাজার রোগি ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত থেকে দেখা যাচ্ছে আক্রান্তদের মধ্যে শুধু জুলাই মাসেই ভর্তি হয়েছেন ১১ হাজার ৪৫০ ডেঙ্গু রোগি। যদিও সরকারিভাবে ‘মহামারি’ শব্দটিতে ভীষণ আপত্তি তুলে থাকলেও বাংলাদেশের ইতিহাসে এ বছর বিশেষ করে চলতি মাসের মতো এত বিপুলসংখ্যক ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তির কোনো অতীত রেকর্ড নেই।
তাহলে এবার ডেঙ্গু কি মহামারির দিকেই যাচ্ছে না? এখন এই প্রশ্নে পুরো জাতি জড়সড়! আমরা জানি যে কোন সংক্রামক রোগ যা দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ে এবং অনেক লোককে দ্রুত ছড়িয়ে দেয় তাকে মহামারি বলা হয়। অর্থাৎ স্বল্প সময়ের মধ্যে সংক্রামক রোগের দ্রুত ছড়িয়ে পড়া, সাধারণত দুই সপ্তাহ বা তার কম সময়ের মধ্যে জনসংখ্যার একটি বৃহৎ সংখ্যক লোককে বিপর্যস্ত করে তোলার রোগটাই মহামারি। প্রায় তিন হাজার বছর পূর্বে প্লেগ নামের এক রোগের অস্তিত্ব আবিষ্কৃত হয়েছিল। মধ্য যুগে বহু রাজ্য এ রোগ দ্বারা ধ্বংসাত্মক পরিণতির শিকার হয়েছে। ম্যালেরিয়ার বয়সও প্রায় চার হাজার বছর। খ্রিস্টের জন্মের ২৭০০ বছর আগে চীনারা এ রোগের সাথে পরিচিত ছিল। গ্রীক বীরেরা বারবার পরাজিত হয়েছে এ রোগের কাছে।
শক্তিশালী রোমান সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম কারণ ছিল ম্যালেরিয়া। একসময় আমাদের এই ব-দ্বীপ এলাকায় কলেরা মহামারী আকারে আবির্ভূত হত আর এতে নারী, পুরুষ ও শিশুসহ গ্রামের হাজার হাজার মানুষ মারা যেত। ওলাবিবি, নামে গ্রামে বা অঞ্চলে উঠে আসার সাথে এর সম্পৃক্ততা রয়েছে এ ধারণা থেকে ওলাউঠা নামেও এ রোগটি অভিহিত ছিল। এলাকায় ওলাবিবি বা দেবীর উঠে আসা প্রতিরোধে আর উঠে আসলে একে বের করে দেয়ার নিমিত্তে বিভিন্ন আচরণ ও রীতির কুসংস্কার তখন প্রচলিত ছিল। ১৮৩২ সালে ইউরোপের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে এক ব্যাপক কলেরা মহামারি দেখা দিয়েছিল। কৌতুহলোদ্দীপক ব্যাপার হচ্ছে, সেই মহামারির জীবাণুটি তার যাত্রা শুরু করেছিল আমাদের এই বাংলাদেশ থেকে। এখান থেকে রওনা দিয়ে নৌ ও স্থল বাণিজ্যের পথ ধরে এই কলেরার জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, হল্যান্ড, রাশিয়াসহ ইউরোপের বিশাল অঞ্চলে। ইতিহাসে এটি ‘বেঙ্গল কলেরা প্যান্ডেমিক’ হিসেবেই পরিচিত।
ইউরোপের সামাজিক, আত্মিক, স্থাপত্যিক, রাজনৈতিকসহ নানা ক্ষেত্রে এই কলেরা এক সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে। আমাদের স্মরণ রাখা প্রয়োজন, রোগ একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হলেও মহামারির অভিজ্ঞতাটি সামাজিক। ফলে মহামারির একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক মাত্রা রয়েছে। ইতিহাসে রোগ ও মহামারির ভূমিকা নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রণিধানযোগ্য কাজটি করেছেন উইলিয়াম ম্যাকনিল (১৯৭৭) তাঁর প্লেগ অ্যান্ড দ্য পিপল বইটিতে। তিনি মূলত অনুসন্ধান করেছেন উপনিবেশ বিস্তারে জীবাণুর ভূমিকা নিয়ে। তিনি দেখিয়েছেন, কলম্বাসের আমেরিকা জয়ে যেমন বন্দুকের ভূমিকা ছিল তেমনি ভূমিকা ছিল জীবাণুরও। কলম্বাস তাঁর জাহাজে করে পুরোনো পৃথিবী থেকে যেসব রোগ নতুন পৃথিবীতে বয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তার কোনোটির বিরুদ্ধে প্রতিরোধক্ষমতা ছিল না আদিবাসী আমেরিকানদের।
এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মহামারি কিংবা প্রাকৃতিক বিপর্যয় ওইভাবে কোনো রাজা-রাজন্য হয়ত একক ভাবে ঠেকাতে পারেননি তাই বরাবরের মতোই এদেশের আপামর জনসাধারণকে বিশেষ করে ছাত্র-যুবসমাজকে এগিয়ে আসতে হবে নানা উদ্যোগ নিয়ে। ডেঙ্গু রোগীদের অনেকের রক্তের প্রয়োজন পড়ছে, এসময় ডেঙ্গু রোগীদের জন্য প্রয়োজনীয় রক্ত সরবরাহ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে রোগীদের শঙ্কা কমাতে আমাদের এগিয়ে আসতে হবে। ডেঙ্গুর জীবাণু বাহক এডিশ মশার বংশবৃদ্ধি ও বিচরণের উপযোগী পরিবেশ নষ্ট করতে সম্মিলিত ভাবে কাজ করতে হবে। বিভিন্ন সোস্যাল মিডিয়াকে কাজে লাগিয়ে বিপদগ্রস্ত মানুষদের সাহায্যে সবাইকে যুক্ত থাকতে হবে। বর্তমান সময়ে পৃথিবী অনেক এগিয়ে গেছে, সুস্থ থাকার জন্য যে পরিবেশ আমাদের দরকার সেটা আমরা চাইলে তৈরি করতে পারি, অভ্যস্ত হতে পারি ভালো থাকার এবং ভালো রাখার। আর এক্ষেত্রে যারা দায়িত্ব পালন করছেন তাদের কাছ থেকে যথাযথ পদক্ষেপ আশা করছি। শুধু কথার ফুলঝুড়িতে নয় ডেঙ্গু প্রতিরোধে বাস্তবায়নযোগ উদ্যোগ চাই।
রিপন আহসান : কলামিস্ট-সংগঠক।