ভালোবাসা নাকি ক্ষণে ক্ষণে রং বদলায়। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে নাকি ভালোবাসার সংজ্ঞা বদলে যায়। যে প্রিয় মানুষটাকে ছাড়া আপনার জীবন অসম্পূর্ণ, যাকে নিজের চেয়ে বেশি ভালোবাসেন, যাকে ছাড়াও জীবন একদিনও চলবে না। সে ধারণা হয়ত একদিন ভুল বলে প্রমাণিত হবে। জীবন বহমান, কারো অনুপস্থিতে জীবন থেমে থাকে না।
পৃথিবীতে সবাই ব্যস্ত, মায়ের কোলের শিশুটিও ব্যস্ত আপন গণ্ডিতে। কাউকে এড়িয়ে চলার নাম ব্যস্ততা। কাউকে অবহেলা করার নামেই ব্যস্ততা। তারপরেও এরই মধ্যে মানুষ মানুষকে ভালোবাসে, ভালোবাসার মধ্যে হয়থ অনেক স্বার্থ থাকে, থাকে অনেক কারণ! তারমানে কি পৃথিবীতে ভালোবাসা বলতে কিছ নেই? একটা প্রবাদ, আছে সরকারি চাকরি আর সত্যিকার ভালোবাসা নাকি যোগ্য ছেলেরা পায় না, কথাটা পুরোটা সত্যিই না হলেও একেবারে মিথ্যেও নয়।
মানুষের মন রংধনুর মতো ক্ষণে ক্ষণে রং বদলায়। কখন যে, কাকে ভালো লাগে বলা যায় না। কিন্তু সব ভালো লাগা ভালোবাসায় পূর্ণতা পায় না, কারণ ভালো লাগা আর ভালোবাসা এক না। কারো জন্য বুকের মধ্যে শূন্যতা অনুভব করা, কারো সাথে একপথে চলার জন্য তীব্র ইচ্ছা, তাকে নিয়ে ভাবার নাম ভালোবাসা।
প্রথমে দেখা, দেখা থেকে ভালোলাগা, তারপর চেনা-জানা, নিজেদের মধ্যে বোঝা পড়া, বিশ্বাস সৃষ্টি এভাবে ভালোবাসার জন্ম হয়। ভালোবাসা একটি তালগাছের মতো। একটি বীজ থেকে যেমন একটি পূর্ণাঙ্গ গাছের সৃষ্টি হয় তিলে তিলে যত্ন করতে। আবার একটি গাছ বেড়ে উঠতে অনেক সময় লাগে। অনেক কষ্ট পরিশ্রেম করতে হয়, কিন্তু একটা পূর্ণাঙ্গ গাছ নষ্ট করতে মাত্র অল্প কিছু সময় লাগে করাত দিয়ে কাটতে। তেমনি যদি ভালোবাসায় কখনও অবিশ্বাস প্রবেশ করে সেই অবিশ্বাস করাতের মতো ভালোবাসাকে নষ্ট করে দেয়। ভালোবাসা বেঁচে থাকে বিশ্বাসের ওপর, বিশ্বাস ছাড়া ভালোবাসা কখনই টিকে থাকতে পারে না। রংধনুতে যেমন সাতটি রং থাকে, এ কারণে রংধনু এত সুন্দর দেখায়, তেমনি ভালোবাসায় দুঃখ-কষ্ট, হাসি-কান্না মিশে থাকে বলে, ভালোবাসা মানুষের হৃদয়ে চিরকাল বেঁচে থাকে। শুনেছি মেয়েরা নাকি সহজে প্রেমে পড়ে না, আবার প্রেমে পড়লে সহজে ভুলতে পারে না, যখন একটা মেয়ে কারও প্রেমে পড়ে তখন তার জন্য সব কিছু বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত। এমনকি নিজের পরিবারকে বির্সজন দিয়ে দেয়, পরিবার বির্সজন দেওয়া আমার মতে ঠিক না। কারণ একটা মেয়েকে তিলে তিলে অনেক কষ্ট করে পরিবার বড়ো করেছে। পরিবারের অবাধ্য হয়ে কোনো কিছু করলে আমার মনে হয় জীবনে সুখী হওয়া যায় না।
আমার এক কাছের বন্ধু কাওসার, এমবিএ সম্পূর্ণ করে, একটা বিজনেস ফার্মে জয়েন করেছিল। বাবার-মায়ের আদরের বড়ো ছেলে, ছেলেটা ভার্সিটি জীবনে কখনো মেয়ে বন্ধুদের সাথে খোলা-খুলিভাবে কথা বলত না। সে যে ফার্মে জয়েন করেছিল তার সিনিয়র এক কলিগের সাথে কাজের কারণে অনেক ভালো বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। অফিস শেষে তারা নিয়মিত একসাথে বের হতো। মাঝে মাঝে চা- কফির আড্ডা দিত। মেয়েটা অনেক ভালো ছিল। সবকিছু ভালোই চলছিল এর মধ্যে হঠাৎ করে একদিন কাওসারের বাবা খুব অসুস্থ হয়ে মারা যান, যেটা ছিল কাওসারের জন্য অনাকাক্সিক্ষত। বাবার মৃত্যুর পর এই কঠিন সময়ে, সবার আগে জারা তার বন্ধুত্বেও হাত বাড়িয়ে দেয়, কারণ একজন কলিগ হিসাবে কিংবা বন্ধু হিসাবে। কারণ জারাও বাবা নেই। আছে শুধু মা। মা ছাড়া জারার পরিবারে আর কেউ নেই। আর কাওসারে একটা ছোটো ভাই ও বোন আছে। বাবার অনুপস্থিতে বড়ো ভাই হিসাবে, কাওসারের ওপর আপনা-আপনিভাবে সব দায়িত্ব এসে পড়ে। কাওসারে এই পিতৃবিয়োগে, অনেকটা কাছে আসার চেষ্টা করে জারা। তাদের এত কাছাকাছি আসাকে অফিস কলিগরা ততটা খারাপভাবে নেয়নি। কারণ তারা ভেবেছিল, তাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক থাকলে ভালোই হবে। কারণ একজন অন্য জনের জন্য উপযুক্ত ছিল। তারা দুজন দুজনকে অনেক বেশি পছন্দ করত। কিন্তু কেউ কাউকে বলতে পারেনি। কিংবা বলার মতো সুযোগ কোনোদিন হয়নি। জারা চাইত কাওসার তাকে, তার ভালোলাগার কথা বলুক ুদিকে কাওসার চাইত, জারা যেন তাকে তার ভালো লাাগার কথা বলে। এমননিভাবে সবকিছু চলছিল। জারাকে তার অফিস বস্ পছন্দ করত। তা কারো জানা ছিল না। বস্ প্রায় সময় জারাকে কাজে-অকাজে ডাকত এবং বিভিন্ন বিষয়ে জিজ্ঞাসা করত, পরিবারের খোঁজ খবর নিত। বিষয়টা জারা কাছে স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু কাওসার বিষয়টা স্বাভাবিকভাবে নিতে পারত না। কারণ তার খারাপ লাগত। আপনার প্রিয় মানুষটা যখন অন্য কোনো ছেলের সাথে হেসে হেসে কথা বলবে কিংবা একটা দীর্ঘ সময় গল্প করবে বা আড্ডা দিবে আপনি তা সহজে নিতে পারবেন না। ঈর্ষান্বীত হবেন। কাওসারের বেলায়ও ঠিক তেমনি। যেহেতু জারা ও কাওসারে সম্পর্কটা নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল সেহেতু অনেক কথা বলতে চাইলেও বলতে পারত না।
হঠাৎ একদিন জারার মা খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে, তার চিকিৎসার জন্য অনেক টাকা লাগে কিন্তু জারার কাছে এতা টাকা ছিল না। এমন অবস্থায় অফিস বস্ করিম সাহেব এগিয়ে এসেছিল। মায়ের চিকিৎসার প্রয়োজনীয় সব টাকা দেয়। হয়ত করিম সাহেব সেসময় টাকা দিয়ে সাহায্য না করলে অনেক বড়ো সমস্যা হয়ে যেতে পারত। জারার মা সুস্থ হয়ে উঠলে পরে একদিন বস্ জারার বাসায় আসে, জারার মায়ের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারে মা অনেক বেশি চিন্তিত জারাকে নিয়ে। বস্ করিম সাহেবকে জারার বিয়ের বিষয়ে সব ভার নেয়, করিম সাহেবের অনেক বয়স হলেও সে কিন্তু এখনও অবিবাহিত। একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। অবশেষে জারার মতামত না নিয়ে মা করিম সাহেবের সাথে জারার বিবয়ের পাকা কথা বলে ফেলে। একথা জানার পর জারার মাথা ওপর বাজ পড়ে। জারা কথাটা সবার আগে কাওসারের সাথে শেয়ার করে। অন্য দিকে কাওসার মোটেও প্রস্তুত ছিল না এমন কথা শোনার কারণ কাওসার মোটামোটি ঠিক করে ফেলেছিল তার ভালোলাগার কথাটা সে জারাকে জানাবে এবং পারিবারিকভাবে আলোচনার মধ্যে দিয়ে তাদের সম্পর্কটাকে একটা পূর্ণতা দিবে। কিন্তু বিধি বাম। এমন অবস্থায় কাওসারের কিছু করার থাকে না এবং জারাও অনেকটা নীরবে সবকিছু মেনে নেয়। কারণ করিম সাহেব তার কাছে অনেক টাকা পাবে তারচেয়ে বড়ো বিষয় তার বিপদের সময় এগিয়ে এসেছিল। অবশেষে তাদের বিয়েটা হয়ে যায় আর রাগ অভিমানে কাওসার চাকুরিটা ছেড়ে দেয়।
কাওসার অনেক বেশি ভেঙে পড়ে। একদিন বাসা ফেরার পথে অন্যমনস্ক হয়ে রাস্তা পার হতে গিয়ে বাসে চাপা পড়ে, হাসপাতাল নেওয়ার পথেই মারা যায়। হয়ত বা অনেক ভালোবাসা-ভালোলাগা প্রকাশ করার আগেই এভাবে নিভে যায়।
এবার পহেলা ফাল্গুনে-বসন্তের প্রথম দিনে বাঙালিকে সাজাবে কৃষ্ণচূড়া আর শিমুল ফুলে, সবার ভালোবাসা রাঙিয়ে উঠুক। পূর্ণতা পাক সকল বোবা প্রেম। কাওসারের মতো জীবন নিভি যাওয়ার আগে জেনে যাক তাদের ভালোবাসার কথা প্রিয় মানুষরা।
নাহিদ বাবু : তরুণ লেখক।