হজ্জ আরবি শব্দ। হজ্জ শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, বাসনা, আকাঙ্ক্ষা, সংকল্প, দৃঢ় সংকল্প ও কোনো মহৎ উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে দৃঢ় সংকল্প প্রকাশ করা। পরিভাষায় নির্দিষ্ট দিনসমূহে নির্ধারিত পদ্ধতিতে আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে পবিত্র কাবাঘর ও সংশ্লিষ্ট স্থানসমূহে বিশেষ কার্যাদি সম্পাদন করাকে হজ্জ বলে। হজ্জ শান্তির ধর্ম ইসলামের অন্যতম রুকন ও ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ। হ্জ একটি ফরয ইবাদত। যা সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের উপর ফরয। এর অপরিসীম গুরুত্বের সঙ্গে সঙ্গে ফজিলতও সীমাহীন। পৃথিবীতে যত রকম নেক আমল রয়েছে এরমধ্যে হজ্জ শ্রেষ্ঠতম। রাসূল মোহাম্মদ (সা.) অন্য সকল আমলের উপর হজ্জের মর্যাদাকে পূর্ব ও পশ্চিম দিগন্তের দূরত্বের সাথে তুলনা করেছেন। আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হজ্জ পালনকারীকে গুনাহমুক্ত নবজাতকের ন্যায় বলা হয়েছে। কবুল হজ্জের পুরস্কার জান্নাত। হজ্জের প্রতিটি কর্ম সম্পাদনের জন্য রয়েছে পৃথক ফজিলত ও মর্যাদা। এই ইবাদতের মাধ্যমে বিশ্ব মুসলিম একত্রিত হওয়ার সুযোগ লাভ করে।
হজের তারিখ ইসলামি বর্ষপঞ্জি (হিজরি বর্ষপঞ্জি বা হিজরি নামে পরিচিত) দ্বারা নির্ধারিত হয়, যা চান্দ্র বছরের উপর ভিত্তি করে চলে। প্রতি বছর, হজের অনুষ্ঠানগুলো দশ দিনের মেয়াদে সংঘটিত হয়, যা ১ তারিখ থেকে শুরু হয় এবং ১০ জ্বিলহজ্জ অর্থাৎ, ইসলামি বর্ষপঞ্জির দ্বাদশ এবং শেষ মাসে শেষ হয়। এই দশ দিনের মধ্যে, ৯ জ্বিলহজ্জ আরাফাতের দিন হিসাবে পরিচিত এবং এই দিনটিকে হজের দিন বলা হয়।
হজ্জ ফরয হওয়ার শর্তসমূহ—
১. মুসলমান হওয়া, ২. বালেগ হওয়া, ৩. সুস্থ মস্তিষ্কের অধিকারী হওয়া, ৪. হজ্জ করার মতো দৈহিক ও আর্থিক সামর্থ হওয়া, ৫. যাতায়াতের পথ নিরাপদ হাওয়া ৬. মহিলাদের জন্য মুহরেম সঙ্গী সাথে থাকা।
হজ্জের করণীয় কাজ —
১. ৮ ই জ্বিলহজ্জ মিনায় অবস্থান করা।
২. ৯ই জ্বিলহজ্জ আরাফাতে অবস্থান, তালবিয়াসহ যিকির, দোয়া, তাওবা, আরাফাতের খুতবা শ্রবণ ও জোহর আসর একত্রে আদায় করা।
৩. সন্ধ্যার সময় মুযদালিফায় গমন করে মাগরিব ও ইশার সালাত আদায় করা।
৪. ১০ই জ্বিলহজ্জ প্রভাতের পর মুযাদলিফা হতে মিনায় গমন ও দ্বিপ্রহরের পূর্বে যুমরায় আকাবায় ৭টি কংকট নিক্ষেপ ও কুরবানীর পর ইফরাদ ও তামাত্তো হজ্জ আদায়কারীগণ মাথা মুন্ডন বা চুল কর্তন করে ইহরাম খোলা, অতঃপর বিকালে কাবাঘর ৭ বার তাওয়াফ, মাকামে ইব্রাহীমে দু-রাকাত নামায আদায় করে, সাফা মারওয়া ৭ বার দৌড়াদৌড়ি করতে হবে।
৫. ১১ ও ১২ই জ্বিলহজ্জ মিনায় অবস্থান ও পূর্বের ন্যায় ৭টি কংকর নিক্ষেপ করা। ১২ তারিখ আসর পর্যন্ত মিনায় অবস্থান করলে ১৩ তারিখে ও পুনঃ তিন জায়গায় ২১টি কংকর নিক্ষেপ করতে হবে।
৬. অতঃপর দেশে আসার আগে পুনঃ কাবাঘর ৭ বার তাওয়াফ করতে হবে।
হজ্জের গুরুত্ব ও ফজিলত অপরিসীম। সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।
কুরআনের আলোকে হজ্জের গুরুত :
ছালাত, ছিয়াম ও যাকাতের মতো হজ্জ পালন করা সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের উপর ফরয। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَلِلَّهِ عَلَى النَّاسِ حِجُّ الْبَيْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ إِلَيْهِ سَبِيلاً وَمَنْ كَفَرَ فَإِنَّ اللهَ غَنِيٌّ عَنِ الْعَالَمِينَ
—‘আর আল্লাহর উদ্দেশ্যে এ গৃহের হজ্জ করা ঐ ব্যক্তির উপর ফরয করা হলো, যার এখানে আসার সামর্থ্য রয়েছে। আর যে ব্যক্তি তা অস্বীকার করে (সে জেনে রাখুক যে,) আল্লাহ জগদ্বাসী থেকে মুখাপেক্ষীহীন’ (আলে ইমরান ৩/৯৭)। এটিই হজ্জ ফরয হওয়ার মূল দলিল।
মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেন,
وَأَذِّنْ فِي النَّاسِ بِالْحَجِّ يَأْتُوكَ رِجَالاً وَعَلَى كُلِّ ضَامِرٍ يَأْتِينَ مِنْ كُلِّ فَجٍّ عَمِيقٍ، لِيَشْهَدُوا مَنَافِعَ لَهُمْ وَيَذْكُرُوا اسْمَ اللهِ فِي أَيَّامٍ مَعْلُومَاتٍ عَلَى مَا رَزَقَهُمْ مِنْ بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِ-
‘আর তুমি মানুষের মাঝে হজ্জের ঘোষণা প্রচার করে দাও। তারা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে এবং সকল প্রকার (পথশ্রান্ত) কৃশকায় উটের উপর সওয়ার হয়ে দূর-দুরান্ত হতে। যাতে তারা তাদের (দুনিয়া ও আখেরাতের) কল্যাণের জন্য সেখানে উপস্থিত হতে পারে এবং রিযিক হিসাবে তাদের দেওয়া গবাদিপশুসমূহ যবেহ করার সময় নির্দিষ্ট দিনগুলিতে তাদের উপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করতে পারে’ (হজ্জ ২২/২৭-২৮)। অত্র আয়াতসমূহে হজ্জ ফরয হওয়ার বিষয়টি সুস্পষ্টরূপে প্রতিভাত হয়েছে।
পবিত্র হাদিসের আলোকে হজ্জের গুরুত্ব :
হজ্জের গুরুত্ব সম্পর্কে অনেক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। এরমধ্যে বিশেষ কয়েকটি হাদিস নিম্নে উল্লেখ করা হলো —
ইবনু ওমর (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের উপরে প্রতিষ্ঠিত (১) তাওহীদ ও রিসালাতের সাক্ষ্য প্রদান করা এ মর্মে যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ (সা.) তাঁর বান্দা ও রাসূল (২) ছালাত কায়েম করা (৩) যাকাত প্রদান করা (৪) হজ্জ সম্পাদন করা ও (৫) রামাযানের সিয়াম পালন করা’।
আবূ হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, একদা রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাদের উদ্দেশ্যে ভাষণে বললেন, ‘হে জনগণ! তোমাদের উপর হজ্জ ফরয করা হয়েছে। অতএব তোমরা হজ্জ সম্পাদন কর। এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসূল! তা কি প্রতি বছর? তিনি নীরব থাকলেন এবং সে তিনবার কথাটি বলল। এরপর রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, আমি হ্যাঁ বললে তা ওয়াজিব হয়ে যাবে (প্রতি বছরের জন্য) অথচ তোমরা তা পালন করতে সক্ষম হবে না। তিনি পুনরায় বললেন, তোমরা আমাকে ততটুকু কথার উপর থাকতে দাও যতটুকু আমি তোমাদের জন্য বলি। কারণ তোমাদের পূর্বেকার লোকেরা তাদের অধিক প্রশ্নের কারণে এবং তাদের নবীদের সাথে বিরোধিতার কারণে ধ্বংস হয়েছে। অতএব আমি তোমাদের যখন কোনো কিছু করার নির্দেশ দেই, তোমরা তা যথাসাধ্য পালন কর এবং যখন তোমাদের কোনো কিছু করতে নিষেধ করি তখন তা পরিত্যাগ কর’। এ হাদিসটি স্পষ্টভাবে জীবনে একবার হজ্জ ফরয হওয়ার প্রমাণ বহন করে।
ইবনু আববাস (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, একদা আকরা‘ বিন হাবেস নবী করীম (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! হজ্জ কি প্রতি বছর ফরয না জীবনে একবারই ফরয? তিনি বললেন, না বরং হজ্জ জীবনে একবার ফরয। যে অধিক করবে তা তার জন্য নফল হবে’।
আবু সাঈদ খুদরী (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ইয়াজূজ ও মাজূজ বের হওয়ার পরও বায়তুল্লাহর হজ্জ ও ওমরাহ পালিত হবে’। হজ্জ এমন গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত যে, পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতেও তা সম্পাদন করতে হয়। অন্য বর্ণনায় আছে, রাসূল (সা.) বলেন, ‘বায়তুল্লাহর হজ্জ বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে না’।
অন্য বর্ণনায় রয়েছে, রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা দ্রুত ফরয হজ্জ সম্পাদন কর। কারণ তোমাদের কেউ জানে না কখন অপরিহার্য প্রয়োজন সামনে এসে যায়’। ইবাদত হিসাবে হজ্জ অধিক গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় রাসূল (সা.) তা দ্রুত সম্পাদন করার নির্দেশ দিয়েছেন। ওমর (রা.) বলেন, যাদের সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও হজ্জ সম্পাদন করবে না তারা ইহুদি ও নাছারা অবস্থায় মারা যাবে’। এর দ্বারা হজ্জের গুরুত্ব বুঝানো হয়েছে এবং ফরয ত্যাগকারীদেরকে হুমকি দেওয়া হয়েছে। এর অর্থ এই নয় যে, তারা অমুসলিম হয়ে যাবে’।
হজ্জের ফজিলত :
আল্লাহ তা‘আলা মুসলিম মিল্লাতের উপর হজ্জ ফরয করেছেন। উদ্দেশ্য স্বীয় বান্দাদের ক্ষমা করে তাদেরকে জান্নাতের সুখময় স্থান দান করা। আর তিনি হজ্জের প্রতিটি কর্ম সম্পাদনের জন্য পৃথক পৃথক ফজিলতের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। রাসূল (সা.)বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রশ্নের প্রেক্ষিতে হজ্জের ফজিলত ও মর্যাদা বর্ণনা করেছেন। সেগুলো নিম্নে আলাকপাত করা হলো।
হজ্জ পালনকারী নবজাতকের ন্যায় গুনাহমুক্ত :
আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ্জ করেছে। যার মধ্যে সে অশ্লীল কথা বলেনি বা অশ্লীল কার্য করেনি, সে হজ্জ হতে ফিরবে সেদিনের ন্যায় (নিষ্পাপ অবস্থায়) যেদিন তার মা তাকে প্রসব করেছিলেন’। অর্থাৎ সে কাবীরা-ছাগীরা, প্রকাশ্য-গোপনীয় সকল গুনাহ থেকে ঐরূপ মুক্ত হয়ে ফিরে আসে। যেরূপ একজন শিশু গুনাহ মুক্ত হয়ে জন্মগ্রহণ করে।
হজ্জের একমাত্র প্রতিদান জান্নাত:
আবু হুরায়রাহ (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘এক ওমরাহ অপর ওমরাহ পর্যন্ত সময়ের (ছগীরা গুনাহের) কাফফারা স্বরূপ। আর জান্নাতই হলো কবুল হজ্জের একমাত্র প্রতিদান’। ‘হজ্জে মাবরূর’ বা কবুল হজ্জ বলতে ঐ হজ্জকে বুঝায়, যে হজ্জে কোনো গোনাহ করা হয়নি এবং যে হজ্জের আরকান-আহকাম সবকিছু (ছহীহ সুন্নাহ মোতাবেক) পরিপূর্ণভাবে আদায় করা হয়েছে।
হজ্জ থেকে ফিরে আসার পরে পূর্বের চেয়ে উত্তম হওয়া এবং পূর্বের গোনাহে পুনরায় লিপ্ত না হওয়া কবুল হজ্জের বাহ্যিক নিদর্শন হিসাবে গণ্য হয়’। আল্লাহর রাসূল (সা.) বিদায় হজ্জের ভাষণে বলেছিলেন, ‘হে লোকসকল! সত্বর তোমরা তোমাদের প্রভুর সঙ্গে মিলিত হবে। অতঃপর তিনি তোমাদেরকে তোমাদের আমল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন। অতএব সাবধান! তোমরা আজকের দিনের পর যেন পুনরায় পথভ্রষ্ট হয়ো না’।
হজ্জ পূর্ববর্তী গুনাহকে ধ্বংস করে দেয় :
ইবনু শামাসা আল-মাহরী (রহ.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আমরা আমর ইবনুল আছ (রা.)-এর মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে দেখতে উপস্থিত হলাম। তখন তিনি দীর্ঘ সময় ধরে কাঁদলেন এবং দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে রাখলেন। এরপর তিনি বললেন, আল্লাহ যখন আমার অন্তরে ইসলামের অনুরাগ সৃষ্টি করে দিলেন, তখন আমি রাসূল (সা.)-এর নিকটে উপস্থিত হয়ে অনুরোধ জানালাম যে, আপনার ডান হাত বাড়িয়ে দিন, যাতে আমি বায়‘আত করতে পারি। রাসূল (সা.) তাঁর ডান হাত বাড়িয়ে দিলেন। কিন্তু আমি আমার হাত গুটিয়ে নিলাম। তখন রাসূল (সা.) বললেন, কি ব্যাপার হে আমর? আমি বললাম, আমি শর্ত করতে চাই। তিনি বললেন,কী শর্ত করতে চাও? আমি বললাম, আল্লাহ যেন আমার (পিছনের সব) গুনাহ মাফ করে দেন। তিনি বললেন, হে আমর! তুমি কি জান না, ‘ইসলাম’ তার পূর্বেকার সকল পাপ বিদূরিত করে দেয় এবং ‘হিজরত’ তার পূর্বেকার সকল কিছুকে বিনাশ করে দেয়। একইভাবে ‘হজ্জ’ তার পূর্বের সবকিছুকে বিনষ্ট করে দেয়?
হজ্জ দরিদ্রতা ও গোনাহ সমূহ বিদূরিত করে :
আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা হজ্জ ও ওমরাহর মধ্যে ধারাবাহিকতা বজায় রাখো (অর্থাৎ সাথে সাথে কর)। কেননা এ দুটি মুমিনের দরিদ্রতা ও গোনাহ সমূহ দূর করে দেয়, যেমন (কামারের আগুনের) হাপর লোহা, স্বর্ণ ও রৌপ্যের ময়লা দূর করে দেয়। আর কবুল হজ্জের প্রতিদান জান্নাত ব্যতীত কিছুই নয়’।
শ্রেষ্ঠ জিহাদ হজ্জ :
উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা কি আপনাদের সঙ্গে যুদ্ধ ও জিহাদে অংশগ্রহণ করব না? তিনি বললেন, তোমাদের জন্য উত্তম ও উৎকৃষ্ট জিহাদ হলো হজ্জ, কবুল হজ্জ। আয়েশা (রা.) বললেন, আল্লাহর রাসূল (সা.) হতে এ কথা শোনার পর আমি আর কখনো হজ্জ ছাড়ব না’। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, আয়েশা (রা.) একদা রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! মহিলাদের উপরে ‘জিহাদ’ আছে কি? তিনি বললেন, হ্যাঁ আছে। তবে সেখানে যুদ্ধ নেই। সেটি হলো হজ্জ ও ওমরাহ’। অপর এক বর্ণনায় এসেছে, রাসূল (সা.) বলেন, ‘বড়ো, ছোটো, দুর্বল ও মহিলা সকলের জন্য জিহাদ হলো হজ্জ ও ওমরাহ’।
অন্যতম শ্রেষ্ঠ আমল হজ্জ :আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করা হলো, কোন আমলটি সর্বোত্তম? তিনি বললেন, ‘শ্রেষ্ঠ আমল হলো আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপরে ঈমান আনা। বলা হলো, তারপর কী? তিনি বললেন, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা। জিজ্ঞেস করা হলো, তারপর কী? তিনি বললেন, কবুল হজ্জ।

হাজীগণ আল্লাহর অতিথি:
আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহর মেহমান হলো তিনটি দল—আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধকারী, হজ্জকারী ও ওমরাহ্কারী’। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, রাসূল (সা.) বলেন, ‘হজ্জ ও ওমরাহ পালনকারীগণ আল্লাহর মেহমান। তারা দো‘আ করলে তিনি কবুল করেন। তারা ক্ষমা প্রার্থনা করলে তিনি তাদের ক্ষমা করে দেন’।
হজ্জের নিয়তকারীগণ কোনো কারণে হজ্জ করতে সক্ষম না হলেও নেকি পাবে :
আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি হজ্জ, ওমরাহ কিংবা জিহাদের উদ্দেশ্যে বের হলো এবং রাস্তায় মৃত্যুবরণ করল, আল্লাহ তার জন্য পূর্ণ নেকি লিখে দিবেন’।
হজ্জে মৃত্যুবরণকারীগণ ক্বিয়ামতের দিন
তালবিয়া পাঠরত অবস্থায় উঠবে:
ইবনু আববাস (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘এক ব্যক্তি আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর সঙ্গে আরাফাতে অবস্থান কালে অকস্মাৎ সে তার সওয়ারী হতে পড়ে যান। এতে তাঁর ঘাড় মটকে গেল অথবা রাবী বলেন, ঘাড় মটকে দিল। (যাতে তিনি মারা গেলেন)। তখন আল্লাহর রাসূল (সা.) বললেন, তাঁকে বরই পাতাসহ পানি দিয়ে গোসল দাও এবং দু-কাপড়ে তাঁকে কাফন দাও; তাঁকে সুগন্ধি লাগাবে না এবং তার মস্তক আবৃত করবে না। কেননা আল্লাহ তা‘আলা ক্বিয়ামতের দিন তাঁকে তালবিয়া পাঠরত অবস্থায় উত্থিত করবেন’।
হাজীদের প্রতিটি পদচারণায়
নেকি অর্জিত হয় ও গুনাহ বিদূরীত হয় :
ইবনু ওমর (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসূল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘যে ব্যক্তি বায়তুল্লাহর সাতটি ত্বাওয়াফ করবে, এই সময় প্রতি পদক্ষেপে আল্লাহ তার জন্য একটি করে নেকি লিখেন এবং একটি গুনাহ বিদূরীত করেন এবং একগুণ মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন।
হজ্জের প্রতিটি বিধান সম্পাদনের জন্য পৃথক মর্যাদা ও নেকি:
ইবনু ওমর (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, একদা আমরা রাসূল (সা.)-এর সাথে মিনার মসজিদে বসা ছিলাম। এমন সময় একজন আনছার ও ছাক্বীফ গোত্রের একজন লোক এসে সালাম দিল। অতঃপর বিভিন্ন প্রশ্ন করল… তাদের জওয়াবে রাসূল (সা.) বললেন, তুমি যখন বায়তুল হারাম তাওয়াফের উদ্দেশ্যে বের হও, তোমার এবং তোমার উটের প্রতিটি পদক্ষেপে আল্লাহ তার জন্য একটি করে নেকি লিখেন এবং তোমার থেকে একটি গুনাহ মিটিয়ে দেন। তওয়াফের পর তোমার দু-রাক‘আত সালাত আদায় বনী ইসমাঈল গোত্রের একটি গোলাম আযাদ করার সমতুল্য। এরপর ছাফা-মারওয়ায় সাঈ করা সত্তরটি গোলাম মুক্ত করার সমতুল্য। তোমার সন্ধ্যায় আরাফায় অবস্থান করা—এই দিন আল্লাহ তা‘আলা প্রথম আকাশে নেমে আসেন এবং ফেরেশতাদের সামনে গর্ব করে বলেন, আমার বান্দারা দূর-দুরান্ত হতে এলোমেলো হয়ে আমার নিকট এসেছে। তারা আমার রহমতের প্রত্যাশা করে। যদি তোমাদের গুনাহ বালির পরিমাণ বা বৃষ্টির ফোঁটা বা সমুদ্রের ফেনার পরিমাণও হয় তবুও আমি তা ক্ষমা করে দিব। হে আমার বান্দারা! তোমরা কল্যাণের দিকে ধাবিত হও, তোমাদের জন্য ক্ষমা রয়েছে। তাদের জন্যও ক্ষমা রয়েছে যাদের জন্য তোমরা সুপারিশ করবে। আর তোমার প্রতিটি নিক্ষিপ্ত কংকর যা তুমি নিক্ষেপ কর তা ধ্বংসাত্মক আমলের জন্য কাফফারা স্বরূপ। আর তোমার কুরবানীটি আল্লাহর নিকট তোমার জন্য ভান্ডার। আর তোমার মাথা মুন্ডন যার প্রতিটি চুলের বিনিময়ে তোমার জন্য রয়েছে একটি নেকি এবং এর মাধ্যমে তোমার একটি গুনাহ বিদূরীত হবে। আর তোমার বায়তুল্লাহর বিদায়ী তওয়াফ যেটি তুমি করবে, এতে তোমার কোনো গুনাহ থাকবে না। ফেরেশতা এসে তোমার কাঁধে হাত রেখে বলবে, ভবিষ্যতের জন্য তুমি আমল করতে থাক, কারণ তোমার অতীতের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে’।
বায়তুল্লাহ তাওয়াফের ফজিলত :
আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করবে ও শেষে দু-রাক‘আত ছালাত আদায় করবে, সে যেন একটি গোলাম আযাদ করল’। তিনি বলেন, ‘তাওয়াফ হলো ছালাতের ন্যায়। তবে এই সময় প্রয়োজনে যৎসামান্য নেকির কথা বলা যাবে’।
হাজারে আসওয়াদ ও রুকনে ইয়ামানী
স্পর্শ করার ফজিলত :
ইবনু ওমর (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রুকেন ইয়ামানী ও হাজারে আসওয়াদ (কালো পাথর) স্পর্শ করবে, এ দুটি তার সমস্ত গোনাহ ঝরিয়ে দিবে’।
তিনি হাজারে আসওয়াদের ব্যাপারে আরো বলেন, ‘আল্লাহ ক্বিয়ামতের দিন হাজারে আসওয়াদকে উঠাবেন এমন অবস্থায় যে, তার দুটি চোখ থাকবে, যা দিয়ে সে দেখবে ও একটি যবান থাকবে, যা দিয়ে সে কথা বলবে এবং ঐ ব্যক্তির জন্য সাক্ষ্য দিবে, যে ব্যক্তি খালেছ অন্তরে তাকে স্পর্শ করেছে’।
রুকনে ইয়ামানী ও মাকামে ইবরাহীম সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘রুক্নে ইয়ামানী ও মাকামে ইবরাহীম দুটি জান্নাতি ইয়াকূত পাথর। আল্লাহ এ দুটির আলোকে নির্বাপিত করেছেন। যদি তিনি নির্বাপিত না করতেন তাহলে এ দুটির মাধ্যমে পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যবর্তী স্থান (পৃথিবী) আলোকিত হয়ে যেত’।
উল্লেখ্য, পাথরের নিজস্ব কোনো ক্ষমতা নেই। আমরা কেবলমাত্র রাসূল (সা.)-এর সুন্নাতের উপর আমল করব।
যমযমের পানি পান করার ফজিলত :
ত্বাওয়াফ শেষে দু-রাক‘আত ছালাতান্তে মাত্বাফ থেকে বেরিয়ে পাশেই যমযম কুয়া। সেখানে গিয়ে যমযমের পানি বিসমিল্লাহ বলে দাঁড়িয়ে পান করবে ও কিছুটা মাথায় দিবে। যমযমের পানি সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘ভূপৃষ্ঠে সেরা পানি হলো যমযমের পানি। এর মধ্যে রয়েছে পুষ্টিকর খাদ্য এবং রোগ মুক্তি’। অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘এটি বরকত মণ্ডিত’। রাসূল (সা.) আরো বলেন, ‘এই পানি কোনো রোগ থেকে আরোগ্যের উদ্দেশ্যে পান করলে তোমাকে আল্লাহ আরোগ্য দান করবেন। এটি পানের মাধ্যমে আশ্রয় প্রার্থনা করলে আল্লাহ তোমাকে আশ্রয় দিবেন। আর তুমি এটা পরিতৃপ্তি বা পিপাসা মিটানোর জন্য পান করলে আল্লাহ সেটিই করবেন’। বস্তুত যমযম হলো আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহে সৃষ্ট এক অলৌকিক কুয়া। যা শিশু ইসমাঈল ও তাঁর মা হাজেরার জীবন রক্ষার্থে এবং পরবর্তিতে মক্কার আবাদ ও শেষনবী (সা.)-এর আগমন স্থল হিসাবে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে সৃষ্ট হয়েছিল।
বায়তুল্লায় সালাত আদায়ের ফজিলত :
জাবের (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, ‘অন্যত্র ছালাত আদায়ের চেয়ে আমার মসজিদে (মসজিদে নববীতে) ছালাত আদায় করা এক হাজার গুণ উত্তম এবং মসজিদুল হারামে ছালাত আদায় করা অন্য মসজিদে ছালাত অপেক্ষা এক লক্ষ গুণ উত্তম’।
হজ্জ একটি ইবাদত, যা আদায়ের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও বিশেষ মর্যাদা লাভ করা যায়। আয়েশা (রা.) হজ্জের বিধান জানার পর কখনো হজ্জ ত্যাগ করেননি। হজ্জের উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর থেকে এর কার্যাবলী সম্পাদন করে বাড়ি ফিরা পর্যন্ত প্রতিটি পদক্ষেপে পৃথক পৃথক ফজিলত ও মর্যাদা রয়েছে। রাসূল (সা.) আয়েশা (রা.)-কে লক্ষ করে বলেন, ‘তোমার কষ্ট ও খরচের পরিমাণের উপর তোমার সওয়াব প্রাপ্তি নির্ভর করবে’।
প্রত্যেক আল্লাহপ্রেমী মুমিন বান্দাই জীবনে অন্তত একবার হজ্জ পালনের স্বপ্ন লালন করে, সর্বদা তৃষ্ণার্ত থাকে মহানবী(সা.) কবর জিয়ারতে। মহান প্রভুর দরবারে আমাদের এই মিনতি, হে আল্লাহ! আপনার সকল প্রেমিক বান্দাদের দয়ার চাদরে আবৃত করে হজ্জ পালনের স্বপ্ন পূরণ করুন। তাওফিক দিন আমরা যেন হজ্জ সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে এই গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতটি সম্পন্ন করতে পারি। আল্লাহ আমাদের সকলকে এর গুরুত্ব ও ফজিলত বুঝে সে অনুযায়ী আমল করার সামর্থ্য দান করুন। আমিন!