ক্ষমা একটি মহৎ গুণ। শিক্ষকের মুখ থেকে শুনেছি। আমার মা ছিলেন আমার প্রথম মাতৃভাষার শিক্ষক। আর বাবা দিয়েছিলেন হাতেখড়ি। তারপরেই পেয়েছিলাম সেই সময়ে শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের। যাঁদের আদর্শের শিক্ষায় আজ আমি গর্ব বোধ করি। যাদের কোনোদিন হিংসা করতে দেখিনি। আদরে ও স্নেহের বাঁধনে আটকে রেখে সুশিক্ষা উজাড় করে দিয়ে গেছেন। কতই না অন্যায় করেছি তাঁদের কাছে কিন্তু তাঁরা সকলেই ক্ষমা করে আবার শিখিয়েছেন ভালো হতে ও অপরের ভালো করতে। আজ কেন যেন ক্ষমা শব্দটা হৃদয়ের অভিধান থেকে চিরতরে বিলুপ্ত হতে চলেছে। যদিও এটা খুব কঠিন কাজ সবার জন্য। কোনো কোনো ক্ষেত্রে জাগতিকতায় আমরা ক্ষমা করি কিন্তু তা ভুলতে পারি না। বারবার যেন মনের কোণে সেই কথাটাই দোলা দেয়। কিন্তু প্রকৃত ক্ষমায় তো সেটা ডিলিট হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু তা হয় না। আসলে প্রকৃত ক্ষমাতে কোনো স্বার্থ থাকে না। আর তাই তো প্রকৃত ক্ষমা করতে হলে নিজের ক্ষতি ও অপমান সহ্য করেই তা করতে হয় ।
পবিত্র বাইবেলের লুক লিখিত সুসমাচারের ২৩ : ৩৩-৩৪ লেখা আছে পিতঃ এদের ক্ষমা করো। কারণ এরা কী করছে তা তারা জানে না।
রক্ত ঝরা দেহে মৃত্যুর অপেক্ষায় ক্রুশের ওপর থেকেই, যারা তাকে ক্রুশে দিয়েছে তাদেরকে উদ্দ্যেশ্য করে এই ক্ষমার বাণী তিনি আমাদের শেখালেন। আমাদের সামান্য কিছু হারালে বা নষ্ট হলেই তা যারা করে তাদের ক্ষমা করতে পারি না কিন্তু তিনি মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে ক্ষমার এই নিদর্শন আমাদের দিলেন। পবিত্র বাইবেলে সক্কেয়কে সেই সময়ের একজন খারাপ মানুষ হিসেবে দেখা যায়। একজন খারাপ মানুষ হিসেবে তাকে সবাই ঘৃণা করত। অথচ যীশু তাকে দেখলেন আর বললেন সক্কেয় আজ আমি তোমার বাড়িতে থাকব। তিনি তাকে ক্ষমা করলেন আর বললেন আজ এই বাড়িতে পরিত্রাণ উপস্থিত হলো। সক্কয়র পরিবর্তন হয়েছিল আর তা যীশুর ক্ষমার আদর্শের জন্যই। যদিও তাকে জাগতিকতায় অনেক মূল্য দিতে হয়েছিল।
ক্ষমা করা বা ক্ষমা পাওয়া কি এতই সহজ কাজ। এটাতে অনেক শর্ত থাকে। আমাদের জানতে হয় অনেক কিছু। আসলে যারা আমাদের ক্ষমা করেন তারা কি সত্যই আমাদের ক্ষমা করেন। যাদেরকে ক্ষমা করা হয় তারা কি সত্যই ক্ষমা পাওয়ার উপযোগী। আবার যাদেরকে ক্ষমা করা হয় তারা কি ক্ষমার অর্থ বোঝে। ক্ষমা পাওয়ার পরে তারা কি পরিবর্তিত জীবনে চলবে।
আমরা প্রতিদিন বড়ো বড়ো করে প্রার্থনা করি। চোখ বন্ধ করে, ওপরে হাত তুলে, অনেক সময় নিয়ে, চোখর জলে কত কথাই না ঈশ্বরের কাছে বলি। শেষে যখন প্রভুর প্রার্থনায় বলি, আমাদের অপরাধ সকল ক্ষমা করো। আমরা যেমন আপন আপর অপরাধীদেরকে ক্ষমা করেছি। তাহলে ঈশ্বর আমাদের ততটুকুই ক্ষমা করবেন যতটুকু আমি আমার অপরাধীকে ক্ষমা করব। চাই অনেক। দিতে চাই খুবই কম। আমাদের হৃদয়ের কলশ ভরতি রেখেছি অহংকার আর ঘৃণা। ক্ষমা রাখবো কোথায়। কেননা শূন্য থাকলে তো শূন্যতা পূরণ করা যাবে। আবার সেই ১৯৯৯ সালের ২৩ শে জানুয়ারি ভারতের উড়িষ্যায় অষ্ট্রেলিয়ার একজন ধর্ম প্রচারক গ্রাহাম স্টেইন্সকে তার দুই সন্তানসহ গাড়িতে আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে মেরেছিল কিছু উগ্রবাদী। জীবন্ত দগ্ধ তিনটে প্রাণ। তারা সেখানে কুষ্ঠ রোগীদের সেবা করত। সেই সুদূর অস্ট্রেলিয়া থেকে সেখানে এসে নিজেদেরকে মানুষের সেবায় নিয়োজিত করেছিল। আর তার ফল তাদের পরিবারসহ মৃত্যু। খুবই দুঃখজনক ঘটনা ছিল সেটা। কিন্তু তার পরেই ঘটলো আশ্চর্যজনক ঘটনা। তার স্ত্রী গ্লাডিস এই মৃত্যুর জন্য কোনো বিচার চাইলেন না। শুধু তাই নয় নিঃশর্ত ক্ষমা করে দিলেন। তার পরেও তারা থেমে যায়নি। তিনি ও তার মেয়ে ইস্টের নিজেদের প্রচেষ্টায় সেখানে একটা ৪০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল তৈরি করে অনন্য নজির সৃষ্টি করলেন। সেখানে এখনো শত শত কুষ্ঠ রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। তিনি বললেন অপরাধীদের ক্ষমা করে দিয়ে আমি মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়েছি।
অলোক মজুমদার : চিকিৎসক, লেখক ও বিশেষ প্রতিনিধি সাপ্তাহিক সময়ের বিবর্তন।