২০২২ খ্রিষ্টাব্দে সমগ্র দেশে প্রথমবারের মতো ডিজিটাল ডিভাইস ‘ট্যাবলেট’ ব্যবহার করে Computer Assisted Personal Interveiwing (CAPI)পদ্ধতিতে জনশুমারি পরিচালিত হতে যাচ্ছে। আগামী ১৫ থেকে ২১ জুন প্রথম ডিজিটাল জনশুমারি ও গৃহগণনা অর্থাৎ ১৪ জানুয়ারি রাত ১২ থেকে শুমারি রেফারেন্স পয়েন্ট/ সময় হিসেবে ধার্য করা হয়েছে। অনুষ্ঠিতব্য জনশুমারি দেশের ৬ষ্ঠ শুমারি, ইতিপূর্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশনায় ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে, ১৯৮১, ১৯৯১, ২০০১, ২০১১ সালে আদমশুমারি অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সাধারণ অর্থে কোনো দেশের একটি নির্দিষ্ট সময় পর পর (এটি সাধারণত হয়ে থাকে ১০ বছর অন্তর অন্তর) দেশের জনসংখ্যার যেমন—সামাজিক ও আর্থিক স্থিতি জানার জন্য যে সার্ভে করা হয়, তাকেই আদমশুমারি বলে। বাংলাদেশে পূর্বে এটিকে আদমশুমারি হিসেবে অভিহিত করলেও ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে জাতীয় সংসদে পরিসংখ্যান আইন ২০১৩ পাস হওয়া আইন অনুসারে আদমশুমারিকে ‘জনশুমারি’ হিসেবে নামকরণ করা হয়েছে। বৈশ্বিক কোভিড-১৯ মহামারির ডামাডোলের কারণে নির্দিষ্ট ঘোষিত তারিখ ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের ২-৮ জানুয়ারি পিছিয়েছে; পরবর্তিতে ২৫ থেকে ৩১ অক্টোবর পুনর্নিধারণ করা হয়; অতঃপর আয়োজন করতে ব্যর্থ হওয়ায় তৃতীয় দফা ২৫ থেকে ৩১ ডিসেম্বর ঘোষণা করা হয়। এবারও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সাজ-সরঞ্জাম সরবরাহ করতে ব্যর্থ হওয়ায় জুন ১৫ থেকে ২৪ তারিখ পর্যন্ত জনশুমারি চূড়ান্তকরণ করা হয়েছে।
উপমহাদেশে আদমশুমারির সূচনা হয়েছে ১৫৮২ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে। এটিই ছিল প্রথম জরিপ ও ভূমি জরিপ। তৎকালীন সময়ে জরিপে কৃষিজমি উৎপাদনভিত্তিক জমির বিবরণ, অধিসত্ত্বগ্রহণের ধরণ, অধিসত্ত্ব গ্রহণকারীদের তথ্য ইত্যাদি সংগ্রহ করা হয়। বাংলার জেলাসমূহের ওপরও ১৮০১ খ্রিষ্টাব্দে আদমশুমারি অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়াও কালেক্টর, ম্যাজিস্ট্রেট এবং বিচারকদের নিজ নিজ এলাকায় জনসংখ্যার অনুমিত হিসাব দিতে হতো। প্রতিটি বাড়িতে গড়ে পাঁচজন ধরে জেলাওয়ারী জনসংখ্যার গণনার পদ্ধতি ব্যবহার করা হতো। ১৮৪০ এবং ১৮৫০ দশকে কর প্রদানকারী ও করমুক্ত এস্টেট এবং বাংলার জনসংখ্যার হিসাবের জন্য বেশকিছু নমুনা জরিপ ও শুমারি পরিচালিত হয়। উল্লেখ্য যে, ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম উইলিয়ম ১০৮৬ খ্রিষ্টাব্দে ডুমস ডে বুক অথবা ডোমসডে বুক নামে জমি অথবা জমিতে বসবাসকারী মানুষের একটি জরিপ পরিচালনা করেন। যুক্তরাষ্ট্র প্রথম আদমশুমারি ১৭৯০ এবং পরবর্তীকালে ইংল্যাণ্ড ও ফ্রান্সে ১৮০১ পরিচালিত হয়।
এবারে দেশের প্রতিটি ব্যক্তির তথ্যাদি সংগ্রহের লক্ষ্যে জোরেশোরে প্রচার-প্রচারণা চালানো হচ্ছে, সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ দিয়েই ইলেকট্রনিক ও প্রিন্টিং মিডিয়াগুলো কাভারেজ দিচ্ছে। লক্ষ করেছি, মোটাদাগে উদ্দেশ্যসমূহে বলা হয়েছে—দেশের প্রতিটি খানা ও খানার সদস্যগণকে গণনা করে দেশের মোট জনসংখ্যার হিসাব নিরূপণ করা; দেশের সকল বসতঘর বা বাসগৃহের সংখ্যার নিরূপণ করা; দেশের সার্বিক উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণের লক্ষ্যে তথ্য সংগ্রহ করা; স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনে নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণের জন্য তথ্য সরবরাহ এবং জাতীয় সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তথ্য সরবরাহ করা। উদ্দেশ্যগুলোকে আরো সুনির্দিষ্ট করলে—গৃহের সংখ্যা ও ধরন, বাসস্থানের মালিকানা, খাবার পানির প্রধান উৎস, টয়লেটের সুবিধা, বিদ্যুৎ সুবিধা, রান্নার জ্বালানির প্রধান উৎস, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, বৈদেশিক রেমিট্যান্স, খানা সদস্যের বয়স, লিঙ্গ, বৈবাহিক অবস্থা, ধর্ম, প্রতিবন্ধিতা, শিক্ষা, কর্ম, প্রশিক্ষণ, মোবাইবল ফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহার, ব্যাংক মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, জাতীয়তা, নিজ জেলা ইত্যাদি বিভিন্ন তথ্যাদি সংগ্রহ করা হবে। আর এই মহাকর্মযজ্ঞে সামিল হচ্ছে লক্ষ লক্ষ তরুণ ১৮ থেকে ৩৫ কিংবা ২৩ থেকে ৪০ বছর বয়সের। জনশুমারিতে তথ্য সংগ্রহ কর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে প্রায় ৩ লক্ষ ৭০ হাজার গণনাকারী, ৬৪ হাজার সুপারভাইজার; এছাড়াও রয়েছে বিবিএস’র ৪ হাজার ৫০০ অধিক কর্মচারী, বিবিএস বহির্ভূত বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের প্রায় ৯০০ কর্মচারী। ৩ লক্ষ ৯৫ হাজার ট্যাব ক্রয় করা হয়েছে। বিবিএস-এর সঙ্গে ওয়ালটন ডিজি-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের চুক্তি মোতাবেক ট্যাব এবং ৭২ পিস এয়ার কন্ডিশনার সরবরাহ করবে। প্রকল্প বাস্তবায়নে ওয়ালটন ভিএমওয়্যার এমডিএম সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে ডিভাইস মনিটরিংয়ের কাজ করবে। দেশের শীর্ষস্থানীয় ডিজিটাল সেবাপ্রদানকারী কোম্পানি রবিকে বেছে নিয়েছে বিবিএস। গণনাকারীরা রবি’র ৪.৫জি নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে সারা দেশের উপাত্ত সংগ্রহ করে ডাটা প্রক্রিয়াকরণের জন্য কেন্দ্রীয় সার্ভারে আপলোড করবে। ডাটা সংযোগসহ কম্পিউটার অ্যাসিস্টেড পার্সোনাল ইন্টারভিউইং (সিএপিআই) সিস্টেম, ভৌগলিক তথ্য ব্যবস্থাপনা এবং ট্যাবলেট কম্পিউটার ব্যবহার করে প্রতিটি গৃহ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হবে। জনশুমারির তথ্য সম্বলিত এক পৃষ্ঠা প্রশ্নপত্র প্রিন্ট করতে ব্যয় পড়েছে আট টাকা ৩৭ পয়সা। ষষ্ঠ জনশুমারিতে খরচ ধরা হয়েছে ১ হাজার ৭’শ ৬১ কোটি ৭৯ লক্ষ টাকা।
পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান বলেছেন, ‘…প্রথমে আমরা ভেবেছিলাম ম্যানুয়ালি শুমারি করব, পরে ডিজিটালি শুমারি করার বিষয় সিদ্ধান্ত হয়। যেহেতু বাংলাদেশ ডিজিটালি অনেক এগিয়ে গেছে। সব জায়গায় এখন স্মার্টফোন ব্যবহার হচ্ছে, ইন্টারনেট সংযোগও বেড়েছে। ডিজিটালি শুমারির কারণে বেশি নিখুঁত হবে, বিশুদ্ধতা বেশি হবে।’ ‘নিখুত’ ও ‘বিশুদ্ধতা’ নিশ্চিতকরণ করবে তালিকাকারী/গণনাকারীরা। তালিকাকারী/গণনাকারী ও সুপারভাইজার পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বেকার যুব/যুব মহিলা এবং ছাত্র-ছাত্রীদের, যোগ্যতা সুপারভাইজার স্নাতক এবং গণনাকারী ইন্টারমিডিয়েট। অতিরিক্ত যোগ্যতা হিসেবে— নিজস্ব স্মার্ট ফোন (এন্ড্রয়েড ভার্সন ৬.০ বা তদূর্ধ্ব) থাকা ও অপারেটে দক্ষতা, স্মার্টফোনের ডিসপ্লে ন্যূনতম ৫.০ (পাঁচ ইঞ্চি), সহজে বোধগম্য হাতের লেখার অধিকারী এবং পূর্ববর্তী কোনো শুমারিতে কাজের অভিজ্ঞতা থাকলে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে।
জনশুমারির সুযোগ বারবার আসে না। আমাদের কাছে মনে হয়েছে, ‘নিখুঁত’ ও ‘বিশুদ্ধ’ করতে আদিবাসী যুবদের সম্পৃক্ততা খুবই জরুরি। দেশের সরকার এখনো কতটি আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী ১৪৮,৪৬০ বর্গকিলোমিটারে বসবাস করছে সঠিক তথ্যাদি উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। আর জনসংখ্যা তো গোজামিল হয়ে আসছে দশকের পর দশক থেকেই। আদিবাসী সংখ্যাধিক্য এলাকায় গণনাকারী হিসেবে আদিবাসীদের দায়িত্ব প্রদান করলে তাদের নামের বানান, টাইটেল নির্ভুলতা ও সঠিক উচ্চারণেই তথ্য প্রাপ্তিতে সহজসাধ্য হবে। দু’একটি আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর টাইটেল বাঙালি টাইটেলের মতোই, যেমন—মালপাহাড়িয়াদের টাইটেল হচ্ছে ‘বিশ্বাস’, ‘দাস; এরূপ আদিবাসীদের শনাক্তকরণ করা দুঃসাধ্য, যদি নিজ থেকেই তথ্য প্রদানে উদ্যোগী না হোন। আদিবাসীরা জাতীয় পরিচয়পত্রের ভ্রান্তির মাসুল গুণতে গুণতে এক প্রকার অতিষ্ট হয়ে পড়েছে। সংশোধনের প্রচেষ্টায় অনেকে হতাশা ব্যক্ত করেছে, প্রত্যেকটি জায়গার সাথে অর্থের যোগসূত্র রয়েছে; ইট-পাথরও যেন অর্থের প্রয়োজনীয়তা বুঝে ফেলেছে।
চা শ্রমিকদের বৃহদাংশই আদিবাসী বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী কিন্তু চা শ্রমিক হিসেবেই সমাধিক পরিচিত। বৃহত্তর সিলেটাঞ্চলে কর্মরত অভিজ্ঞজনেরা বলছেন, প্রায় ১১৬টি জাতিগোষ্ঠী চা বাগানগুলোতে শ্রমিক হিসেবে নিয়োজিত রয়েছে। সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কোনোভাবেই একমত হতে পারছে না চা শ্রমিকদের এ ব্যাপারে। সাহিত্যে আমরা দেখি যে, জাতি, গোত্র, বংশ, নাম, পরিচয় সব মুছে চা বাগানের শ্রমিকদের এক নতুন নামকরণ হয় কুলি; আবার কখনো বাগানি, আর এখন চা শ্রমিক। জনশুমারিতে তথ্যনির্ভর জাতিগোষ্ঠীর উপস্থিতি উপস্থাপনের আবশ্যিকতা রয়েছে।
আদিবাসীদের বাসস্থানের মালিকানা বিষয় সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়া দরকার। পবিত্র সংবিধানে রাষ্ট্রীয় মালিকানা, সমবায়ী মালিকানা এবং ব্যক্তিগত মালিকানার কথা লিপিবদ্ধ রয়েছে, তবে নেই যৌথ মালিকানা। জনশুমারিতে ‘বাসস্থানের মালিকানা’র জায়গায় যৌথ মালিকানা তথ্য কেউ সরবরাহ করতে আগ্রহী হলে গণনাকারীরা কোন জায়গায় টিক দেবেন বা লিখবেন! আদিবাসীদের যৌথ মালিকানা তথ্যটি সরকারের তথ্য ভাণ্ডারে সংগৃহীত হওয়া খুবই সময়োপযোগী।
আদিবাসীদের নিজস্ব ধর্ম রয়েছে যা অনেকেরই অজানা। ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ধর্ম ছাড়াও রয়েছে—‘সারিসারণা’, ‘অপকোপা’, ‘ক্রামা’, ‘সানামাহি’, ‘সাংসারেক’, ‘ধার্মেস’ ইত্যাদি। কোন ধর্মে কতজন অনুসারী রয়েছে, সেটির তথ্য সংগ্রহের একটি মোক্ষম সময় জনশুমারি। তবে এইসব জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় আচার-আচরণ প্রাথমিক দৃষ্টিভঙ্গিতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীর মতোই মনে হবে কিন্তু একটু খুঁটিয়ে দেখলে বা বোঝার চেষ্টা করলে ধর্মের যোগবন্ধন আবিষ্কার করা সম্ভবপর।
অনুষ্ঠিতব্য জনশুমারিতে কোটি কোটি টাকা ব্যয়িত হচ্ছে, এ কোটি টাকার রাজস্বতে প্রত্যেকটি নাগরিকের অংশায়ন রয়েছে; সেটি হোক—জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা নির্বিশেষে। তাহলে তো আমরা আশান্বিত হতেই পারি, জনশুমারিতে আদিবাসী যুবদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে ‘বিশুদ্ধ’, ‘নিখুঁত’ তথ্যাদি জাতিকে উপহার দেওয়া। বিশুদ্ধ তথ্য ব্যতিরেকে উন্নয়নের পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে, টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্তই হচ্ছে তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা তথা নিখুঁত বা বিশুদ্ধতা। আমরাও সরকারের শ্লোগানে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে চাই—
‘জনশুমারিতে তথ্য দিন, পরিকল্পিত উন্নয়নে অংশ নিন’।
মিথুশিলাক মুরমু : আদিবাসী বিষয়ক গবেষক ও লেখক।