সকালে উঠেই দীপার মনটা খারাপ হয়ে গেল। বারান্দায় এসে দেখে নীলমণি লতাটা একেবারেই মরে গেছে। দুদিন আগেও দীপার আশা ছিল গাছটা হয়ত বাঁচবে। গাছটা ওর খুব প্রিয়। টব থেকে মরা গাছটা ফেলে দিল দীপা। বারান্দায় মোড়াতে বসলো। ওর হঠাৎ মনে হলো, যা কিছু বা যাকেই ও ভালোবাসে সে কেন ওর কাছে থাকে না? ওর কি কোনো সমস্যা?
ছেলেটা দেশের বাইরে পড়তে গেল। দীপা চেয়েছিল অন্তত গ্রাজুয়েশনটা ও দেশে করুক। মায়ের কাছে থাক। কিন্তু ছেলেটা গেল। দেশের বাইরে যত আগে যাওয়া যায় ততই নাকি ভালো। ছেলের বাবাও ছেলের কথায় সায় দিল। মায়ের ভালোবাসার টানে ছেলেটা তো থাকতে পারত!
বাসায় এখন দুইজন মানুষ ওরা। দুইজন যেন দুই মেরুর বাসিন্দা। না, ঝগড়া হয় না। একদিন শুধু অজয় বলেছিল, ‘‘ছোটোবেলা থেকে বাবা-মায়ের ভালোবাসা না পেয়ে তোমার ভিতরে একটা কমপ্লেক্স কাজ করে। তুমি স্বাভাবিকভাবে কিছু নিতে পারো না।’’
কথাটা দীপার খুব লেগেছিল। দীপা দূরে সরে এসেছে। দরকার ছাড়া দুজনের খুব একটা কথা হয় না। যে যার মতো থাকে।
আর দীপার ভালোবাসার পাত্র যে ছিল সেও তো চলে গেছিল। দীপা আটকাতে পারেনি অথবা আটকাতে আগ্রহী ছিল না। অভিমান করে সরে এসেছিল দীপা। আর সেও চলে গেছিল। মাঝে মাঝে দীপার মনে হয়, দীপার ভালোবাসার শক্তি থাকলে সে কি যেত দীপাকে ছেড়ে?
‘‘দীপা কী এত ভাবছ? আজ স্কুলে যাও নাই?’’ — পাশের ব্যালকনি থেকে পাশের বাসার খালা জিজ্ঞেস করলেন।
দীপা বললো, ‘‘না আজ স্কুলে যেতে ইচ্ছা করছে না। ভাবছি আজ ছুটি নিব। একটা ফোন করে দিব স্কুলে।’’
—তোমার কি মন খারাপ? অজয় কই? অফিসে?
—না খালাম্মা ঠিক আছি। অজয় অফিসের কাজে ঢাকার বাইরে গেছে কাল। আরো দুইদিন পর আসবে।
—ফ্রি থাকলে আসো আমার বাসায় চা খাও।
—খালাম্মা আপনি আসেন। আমি চা বানাচ্ছি।
—আচ্ছা একটু পর আসছি।
দীপা ঘরে আসে। প্রতিবেশী এই খালা ওর বিয়ের পর থেকে ওকে অনেক স্নেহ করেন। ঠিক মায়ের মতো। মায়ের মতো! মায়ের মতো! দীপা কয়েকবার ভাবে।
ডিপফ্রিজ থেকে দীপা নিজের বানানো সিঙ্গারা বের করে। সিঙ্গারা দীপার মায়ের খুব পছন্দের। দীপা ভাবে, মা কি কোনোদিন বলেছিল যে সিঙ্গারা মায়ের পছন্দের?
মায়ের কী ভালো লাগে কী তার পছন্দের তা দীপা জানে না। আসলে মা কখনো নিজের পছন্দ-অপছন্দের কথা বলে নাই বা বুঝতেও দেয় নাই।
শুধু দীপা যখন অনেকটাই ছোটো একবার মামাবাড়ি যাওয়ার সময় দীপা দেখেছিল মা খুব মজা করে সিঙ্গারা খাচ্ছিল।
কলিংবেলের আওয়াজ হতেই দীপা দরজা খুলে দেয়।
পাশের খালা আসেন।
দীপা চা সিঙ্গারা দেয়। টুকটাক কথা বলে।
খালা বলেন, একটা গাছের জন্য তোমার মন এত খারাপ! তুমি পাগল। তুমি যে একটু পাগল তা অবশ্য আমি অনেক আগে থেকেই জানি। বলে, একটু মুচকি হাসেন।
দীপা বলে, ঠিক গাছ না, খালাম্মা! আমার মনে হয় আমি ভালোবেসে কোনো কিছুই ধরে রাখতে পারি না। কোনো সম্পর্কই ভালো রাখতে পারি নাই। কেন বলেন তো, খালাম্মা? কেন পারি না?
খালা বলেন, কেন এভাবে বলছ? কত মানুষ তোমাকে কত ভালোবাসে। তোমার ছাত্রীরা, তোমার তোমার শ্বশুর বাড়ির লোকেরা, আমি, অন্যান্য প্রতিবেশীরা। এমনকি তোমার কাজের লোক, মাছওয়ালা, সবজিওয়ালা সবাই তোমাকে পছন্দ করে।
দীপার চোখে জল আসে।
খালা দীপার মাথাটা টেনে বুকে নেয়। বলে, মন খারাপ করো না।
দীপাকে খালা মায়ের মতো মাথায় হাত দিয়ে আদর করে। দীপা ভাবে মায়ের মতো!
দীপার মা কোনোদিন দীপাকে জড়িয়ে ধরে নাই। কোনোদিন আদর করে, মাথায় হাত দেয় নাই। দীপা খালাম্মার বুকে মাথা রেখে মায়ের জন্য কষ্ট পাচ্ছিল।
২
আজ সারাদিন দিপার ভালো লাগছে না। কেন জানি খুব ছোটোবেলার কথা মনে হচ্ছে।
খুব ছোটোবেলায় ও ভাবত, সবার মা বাচ্চাদের এত আদর করে, মা আমাদের দূরে দূরে রাখে কেন?
দীপার মা তপতীও স্কুল টিচার ছিলেন। ছাত্র-ছাত্রীদের মন দিয়ে পড়াতেন। গরীব ছাত্রদের সাহায্য করতেন। কিন্তু নিজের বাচ্চাদের থেকে দূরে থাকতেন। কাজের মহিলা ওদের খেতে দিত। ওরা নিজেরা স্নান করত, খেত, স্কুলে যেত। পড়ত, ঘুমাত। বড়ো হবার পর একা একাই স্যারদের বাড়িতে গিয়ে পড়ত।
মা তার ছাত্রদের ভালো রেজাল্ট করলে উৎসাহ দিত। কিন্তু দীপাকে কিছুতেই কিছু বলত না। ভালো করলেও উৎসাহ দিত না, খারাপ করলেও বকা দিত না।
গ্রামের অনেকেই মায়ের কাছে আসত নানা সমস্যা নিয়ে, মা সব শুনত যতটা পারে সমাধান করত। সবাই মায়ের কথা শুনত, মানত। কিন্তু নিজের বাচ্চাদের নিয়ে খুব একটা চিন্তা ছিল না।
পুকুরের মাছ উঠত, মা গরীব-দুঃখী, প্রতিবেশী সবাইকে দিত। বাড়িতে রান্না হতো। দীপারা খেত। মা কখনো জিজ্ঞাসা করে নাই দীপা কী খেতে ভালোবাসে! মাছের লেজ না মাছের মাথা!
দীপার আর ছোটো দুইভাই বোনকে একটু মাঝে মধ্যে ঘরে এসে, দেখে যেতে দেখেছে দীপা। একটু আদর করে কথাও বলেছে। বা একটু খেয়াল রেখেছে। কিন্তু দীপাকে কখনোই না! দীপা অনেকদিন ইচ্ছা করে বারান্দায় ঘুমিয়ে গেছে। যেন ওর মা এসে আদর করে কোলে নিয়ে ওকে ঘরে নিয়ে যাবে। না, মা কখনো করে নাই। কাকিমা, জ্যেঠিমা বা কাজের মেয়েটা ডেকে ওকে ঘরে বিছানায় নিয়ে যেত। প্রয়োজনীয় কথা ছাড়া দীপার মায়ের সাথে কখনো কোনো কথা হতো না।
একদিন দীপার বিয়ে হয়। মা নিজের পছন্দে বিয়ে দেয়।
দীপা মাকে খুশি করতে বিয়ে করে। কিন্তু মা কি খুশি হয়েছিল? জানে না দীপা।
তারপর প্রায় ৬ বছর আগে। একদিন বাড়িতে দীপার সাথে দীপার মায়ের কথা কাটাকাটি হয়।
দীপা বলে, ছোটো থেকে যে অপরাধ আমি করি নাই সেই অপরাধের শাস্তি তুমি কেন আমাকে দিয়ে চলেছ মা? কেন আর দশটা বাচ্চার মতো আমার জীবনটা ছিল না? সব সময় মানসিক কষ্টে থাকতে হতো! মা বলো, তুমি না বললে, আজ তুমি ভালোভাবে আমার সাথে কথা না বললে আমি আর কখনো বাড়িতে আসবো না।
দীপার মা চুপ করে ওর দিকে তাকিয়ে বলেছিল, তোর ইচ্ছা না করলে তুই বাড়িতে আসিস না।
দীপা সেদিন তখুনি ওদের বাড়ি থেকে চলে এসেছিল।
আর বাড়ি যায়নি। মা সেদিন একটু অসুস্থ হয়ে গেছিল। ভাই বারবার বলেছিল থেকে যেতে। দীপা থাকেনি। বোন বলেছিল তোর জন্য মা অসুস্থ হয়েছে। মায়ের কিছু হলে তুই দায়ী।
সেই থেকে ভাই-বোনের সাথেও দূরত্ব। বোন বিয়ে করে আমেরিকায় চলে গেছে। দীপার নিজের পরিবারের সাথে যোগাযোগ কম হতে থাকে। বিজয়া দশমীতে মাকে ফোন করে একটা প্রণাম জানানো ছাড়া দীপাও আর ফোন করে না। ভাইটাও খুব কম ফোন দেয়।
কিন্তু দীপার কী দোষ?
৩
দীপার তখন সাড়ে পাঁচের মতো বয়স। ওর ভাই তিন বছরের আর বোন মাত্র কোলে তখন, বাবা সবার জন্য পূজার জামা এনেছিল । দীপার জামা দীপার পছন্দ হয় নাই। দীপা জেদ করতে থাকে। দীপার বাবা দীপাকে নিয়ে ওর জামা চেঞ্জ করতে যায়। বাইকের পিছনে দীপা। বাবা বাইক চালাচ্ছিল। হঠাৎ এক্সিডেন্ট দীপার তেমন কিছু মনে নাই। শুধু মনে আছে মা খুব জোরে একটা থাপ্পড় দিয়েছিল ওর গালে।
মোবাইলের রিংটোনে দীপা অতীত থেকে ফেরে দেখে, ভাইয়ের কল। ভাই খুব কম ফোন দেয়। দীপা ফোন রিসিভ করতেই ভাই বলে, দিদি মা অসুস্থ হয়ে কয়েকদিন হাসপাতালে ছিল। কাল বাড়িতে এনেছি। এখন ভালো। তোর সাথে কথা বলতে চাচ্ছে। কথা বল।
দীপা হ্যালো মা বলতেই, দীপার মা বলে, তোকে অনেকদিন দেখি না। একবার আসবি? খুব দেখতে ইচ্ছা করছে
দীপা আজ ৬ বছর পর বাড়িতে এসেছে। জামাকাপড় চেঞ্জ করে হাত মুখ ধুয়ে মায়ের ঘরের দিকে যায়। ভাই বলে, দিদি মায়ের উত্তেজিত হওয়া যাবে না। সাবধানে কথা বলিস।
দীপার একবার মনে হয় ভাইকে বলে তোরা সব কিছুর জন্য সব সময় আমাকে কেন দোষী বানাস!
কিন্তু কিছু বলে না। মায়ের কাছে আসে। দেখে মা শুয়ে আছে। শুকিয়ে কাঠি হয়ে গেছে।
দীপা ‘মা’ বলে ডাকতেই। তাকায়।
বলে, দীপা এসেছিস? খেয়েছিস কিছু?
দীপা বলে, খাব। তুমি বল কেমন আছো?
দীপার মা হাতটা ধরে দীপাকে কাছে বসায়। মাথায় আস্তে আস্তে হাত দেয়। বলে, অসুস্থ হয়ে যখন হাসপাতালে ছিলাম বারবার ভগবানকে ডেকেছি, বলেছি আমাকে আর কয়টাদিন সময় দাও। আমি আমার দীপাকে দেখব। আমার বুকটা হাহাকার করছে। মরে গেলেও শান্তি পাব না। আমি একবার আমার দীপাকে বুকে জড়িয়ে নিব।
দীপা ওর মাথাটা মায়ের বুকে রাখে। মা মাথায় হাত বুলাতে থাকে। দীপার মনে হয় ঠিক ছোটোবলায় মা এইভাবে আদর করত। ওর স্মৃতিতে নেই কিন্তু কাকিমা জ্যেঠিমার মুখে শুনেছে মা বুকে নিয়ে আদর করত আর বলত, আমার দীপা একদিন বড়ো হবে, লেখাপড়া করবে, তারপর একদিন মাকে কাঁদিয়ে নিজে কেঁদে শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে। আমার বুকটা ফাঁকা হয়ে যাবে আমি কী নিয়ে থাকব তখন!
দীপা স্মৃতিতে না থাকা মায়ের কথাগুলি যেন শুনতে পায়…