দামু, ও দামু খড়গুলো তুলে রেখে জায়গাটা পরিষ্কার করে রাখ, গোঁসাইবাড়ির বড়োকত্তা হেঁকে বলেন। দামু, বারান্দাটার কোণায় জড়ো করে রাখা, খড়ের স্তূপ ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করে গোরুগুলোকে খুঁটি থেকে খুলে ছেড়ে দেয়। বড় শীত পড়েছে এবার। বিবর্ণ চাদরটা গায়ে জড়ায় দামু—একটু রোদে বসলে ভালো হতো। কাল রাতে বড়ো ঠান্ডা লেগেছে। হাত, পা যেন অসাড় হয়ে গেছে। পঞ্চাশ বছর বয়স হলে কী হবে, জোয়ান লোকেদের মতো শক্তি ধরে দামু। তাদের গাঁয়ের আর পাঁচটা সাঁওতাল জোয়ানের চেয়ে দামুর গায়ের শক্তি কম না।
ঐ—আবার ডাক পাড়ে বড়বাবুথ কোথায় গেলি রে দামু—গোরু, মোষগুলোর মুখে একটু জল ধর।
আবার বড়গিন্নি ডাকেন অন্দর থেকে—ও দামু, উঠোনটা একটু পরিষ্কার করে দে দিকি বাবা। সারাদিন এই ফাইফরমাশ চলতেই থাকে। তারপর ক্ষেতে যেতে হয় লাঙ্গল নিয়ে। এখন ধান তোলার সময়। আরও পাঁচটা মুনিষ খাটে, তবু দামুই বড় ভরসা।
: মারাং বুরু দামুকে শক্তিও দিয়েছে। কালো, খোদাই করা, পেটানো চেহারা—কষ্টিপাথর যেন। দীর্ঘ চেহারা, গায়েও সেরকম শক্তি। একালে, ভীম বেঁচে থাকলে হয়ত দামুর মতোই দেখতে হতে। ঘরে ঝুমরি আর ছেলে-মেয়ে দুটো—ওদের কথা বড়ো মনে হয়। ফসল মাড়াই না হলে, যাওয়া তো যাবে না ঘর।
গোঁসাইকত্তাদের এত বড়ো দালান বাড়িটার গোয়ালের কোণার বারান্দাটায় জায়গা হয় তার। খড় বিচালি পাতে, চট পাতে, তার ওপর একখান ছেঁড়া চাদরে মুড়িসুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকে, এই দীর্ঘ শীতের রাত। বেলা দশটা বাজলে, মালকিন জলখাবার দেয়—মুড়ি আর একখান কাঁচামরিচ সাথে একখান মুলোও দেয়। তারপর গোরুগুলোকে নিয়ে চলে যায় মাঠে—ধান তোলার সময় এখন। কত্তারা মাঠে বসেই তদারকি করে। বেলা পড়ে আসে। সাঁঝের মুখে ক্ষেত থেকে ফিরে—সেজ মালকিনের কাছে সর্ষের তেল চেয়ে গায়ে মাখে দামু। তারপর পুকুরে একটা ডুব মেরে ভাত খাওয়ার ফুরসৎ পায়। একথালা ভাত বেড়াল ডিঙোতে পারে না। দামু খেতে বসে—সামান্য ডাল আর তরকারি। সেজমালকিনের বড়ো মায়া—একটা মোটা চাদর দিয়েছে দামুকে গায়ে দেয়ার জন্য। এই চাদরের ওমটুকু তার বিলাসিতা। শুকনো কাঠকুটোয় আগুন জ্বালিয়ে অসাড় হাতপা টানটান করে। গোয়ালঘরের কাছের এই বারান্দাটুকুতে রাতে বড় হাওয়া ঢোকে হু হু করে। ভাত খেয়ে একটা শালপাতার চুট্টা ধরায় সে। গোরু মোষগুলোই তার আপন মনে হয়। রাতের বেলায় ঝুমরির মুখটা মনে পড়ে। ছেলে, পিলে দুটোকে নিয়ে শীতের রাতে কী করচে কে জানে! আগুনটুকু নিবু নিবু হয়ে আসলে, ঘুম লাগায় দামু। সারাদিনের খাটা-খাটনির শরীরে ঘুমের পাহাড় নেমে আসে, স্বপ্ন দেখার আর ফুরসৎ কই। আরো পাঁচটা মুনিষ কাজ করে তার সাথে গোঁসাইবাড়িতে। সবই আশপাশের গাঁয়ের। এ বাড়িতে অনেক লোক। সকাল হলে সে গোরুর জাব নিয়ে গোয়ালঘরে ঢোকে। বড়কত্তার নাতি আর নাতনি ছুটে আসে—ও দামুকাকা, আমাদের বলটা নালার দিকে গড়িয়ে গেছে, তুলে দাও দিকি। একহাঁটু কাদার মধ্যে বল গেছে ঢুকে। তাও সে কাদা মাড়িয়ে তুলে আনে বল। দামু গোল গোল চোখে দেখেছে, দাদাবাবুদের ছেলেরা লম্বা লাঠি আর বল নিয়ে কী একটা খেলছিল। আরো তিনটে লাঠি পোঁতা। এ তো তাদের ছোটবেলার ডাংগুলি খেলার মতো অনেকটা। তাকে বারবার ডাকছিল বলটা কুড়িয়ে আনার জন্যে। বেশ মজার খেলা। আহা ছেলেপুলের কথা মনে হয়। গাঁয়ে গাঁয়ে পাখির পেছনে আর কুলজঙ্গলে খড়ি ওঠা গায়ে ঘুরে বেড়ায়। এ খোকা আর খুকিটা ঠিক তার বুধন আর হাসির বয়সের। চোখে জল আসে ওদের দেখে। এ-বছরের পরবে ওদের জন্যে বল একটা কিনে নিয়ে যেতে হবে আর ঝুমরির কাচের চুড়ি। বড় ভালো পিঠে বানায় ঝুমরি। আসন্ন পরবের আনন্দে চোখ চিকচিক করে দামুর থ কী হলো, ও দামুকাকু, বলটা ধুয়ে আনো—খোকাটার আওয়াজে বাস্তবে ফেরে দামু।
গোরুগুলোকে খামারের রোদে বেঁধে রাখে। আজ ধান তুলতে হবে। ছোটগিন্নি এসে খাবার দেয় দামুকে। সেই ছোটবেলায় বাবা মরে যায়। তারপর থেকে লোকের বাড়ি কাজ করেই অর্ধেক জীবন পার হয়ে গেল তার। গোঁসাইদের এই এতোবড় তিনতলা বাড়িটা—উঠোন, খামার—চার ভাইয়ের জমজমাট সংসার। কতলোক ঘরে থ চাষবাস আর মস্ত বড়ো ভূষিমালের দোকান।
বড়কত্তার তিন ছেলে আর চারটে মেয়ে—মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। মেজোকত্তারও দুই ছেলে দুই মেয়ে, আর সেজোকত্তার তিন মেয়ে, ছোটো কত্তার তিন ছেলে। দিদিমণিরা যখন আসে, ঘরে হৈ চৈ লেগে যায়। দামুর খাটনি পড়ে খুব, কিন্তু ভালোটা মন্দটা জোটে। মিষ্টি তো আগে দেখেনি কখনও, এদের বাড়িতে দিদিরা এলে খেতে পায়। এ বাড়ির সেজোগিন্নির গরীব দুখীর দিকে বড় মায়া। দামুর জন্যে মিষ্টি রেখে দেয়। বাটি করে জলখাবারের মুড়ির সঙ্গে দেয়—বলে, ও দামু খা। বড়ো ভালো লাগে দামুর এটুকু স্নেহ।
দামুর জায়গা তো গোয়ালঘরে ওই গোরু মোষগুলোর পাশে। মানুষের চেয়ে ওই গোরু মোষগুলোকে বেশি চেনে সে। অবলা জীব কেমন করে তাকিয়ে থাকে। খড়ের গাদায় চাদর পেতে শুয়ে কত কথা মনে পড়ে তার, সেই হাঁসুলির কথা—সে তো চলে গেল, দু-দিনের জ্বরে।
তারপর ঘরে ঝুমরি এলো। কেমন আছে কে জানে বৌটা। বুকের ভেতরটা কেমন চিন্ চিন্ করে। কাল আবার সকাল সকাল উঠোন ঘরদোর সব পরিষ্কার করতে হবে—গোরুগুলোকে ক’দিন বাইরের খামারে বেঁধে রাখতে হবে। মেজোকত্তার মেয়ের বিয়ে যে।
: দামুর জায়গা তখন বাইরে খামারের কোণার বারান্দাটায়, গোরুগুলোর সাথে। এক এক করে কুটুমজন আসতে থাকে, আর দামু ওদের বাক্স, সুটকেস ব’য়ে ব’য়ে আনে। চোখ বড়ো বড়ো করে দেখে কতো রঙিন রঙিন কাপড় জামা পরা দিদিদের ছেলেমেয়েদের। দাদাবাবুরাও বাইরে থেকে অনেকে আসে।
আহা, ছেলেপুলের কথা মনে করে দামুর চোখে জল আসে। এই শীতের রাতে দুটো পাতলা চাদর গায়ে জড়িয়ে থাকে। কে জানে শরীর কেমন আছে তাদের। এবার মনিব পয়সা দিলে, দুখান মোটা জামা কিনে নিয়ে যাবে সে। আর ঝুমরির একখান ফুলকাটা শাড়ি। হঠাৎ খেয়াল হয়, বাছুর দুটোকে তো ছাড়া হয়নি, দুধ দোয়ার সময় বেঁধে রাখা হয়েছিল।
বাছুর দুটোকে ছেড়ে দেয় মায়ের কাছে। লোকজন, হৈ চৈ লেগে গেছে ঘরে। সন্ধ্যের মুখে থালায় ভাত নিয়ে বারান্দার কোণাটায় খেতে বসে দামু। কত বড়ো চাঁদোয়া টাঙ্গানো হয়েছে উঠোনে। বিশাল উঠোন, ওখানেই বিয়ের আসর বসবে। খামারের এক কোণায় বড়ো বড়ো উনুন করে মিষ্টির ভিয়ান হচ্ছে। আর চারদিন মোটে। অবাক বিস্ময়ে বড়ো বড়ো চোখ করে দামু দেখে। অনেক রাতে, সেজ মালকিন বাটি করে দুটো মিষ্টি দিয়ে যায়—এ দামু খা। কৃতজ্ঞতায় মন নুয়ে আসে—গরীব দুখীর ওপর তোমার এত কেন দয়া মালকিন?
ছ’দিন কেটে গেছে, বিয়ে বাড়ি চুকেছে, সবকিছু যেন ঘোরের মতো লাগে। মেজোকত্তার মেয়ে বেলিদিদিকে বিয়ের সময় কী সুন্দর লাগছিল! কতো আতসবাজি, আলো। চোখ তার ধাঁধিয়ে গেছে। অনেক খাটাখাটনি গেছে। সন্ধের পর আজ কেমন জ্বর জ্বর লাগছে। গায়ে হাতে পায়ে বড়ো ব্যথা। রাতে এল ধুমজ্বর। সকালে ধুমজ্বর গায়ে সে শুয়ে থাকে। উঠতে আর পারে না। বড়ো কত্তা শুধোন—এই তোর কী হয়েছে রে? দামু নড়ে না। গোয়ালের কোণাটায় চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকে। দুপুরে সেজ মালকিন এসে দুটি মুড়ি আর একটা ওষুধ দিয়ে যায় তাকে। ঘোর চোখে তাকায় দামু। ওষুধটা খেয়ে জ্বরটা একটু কমে। দুদিন শুয়েই থাকে, কেমন একটা নেশা নেশা অন্ধকারের মধ্যে ঝুমরির মুখটা যেন দেখতে পায়। ছেলেপুলে দুটোর মুখ মনে ভাসে।
আজ তিনদিন হল, দামুটা গোয়ালঘরটার কোণায় পড়ে আছে। গোঁসাইবাড়ির সেজমালকিন একটা ছোটো বাটিতে জল আর একটা কাপড়ের ফেট্টি নিয়ে আসে—ও দামু এইটা একটু লাগা দেকিনি। আর এই ওষুধটা খা। আলগোছে সেজ মালকিন দেয়। সকালে জ্বরটা একটু কমে। আজ অনেকদিন বাদে চোখ খুলে তাকালো সে। কিন্তু বড্ড দুর্বল, মাথা তুলতে পারে না। বেলায় এসে সেজ মালকিন দুটো গরম ভাত দিয়ে যায়—বলে, খা দামু—সেরে যাবি। সামনে এসে বাটিটা নামায়। বাটিটা তুলতে গিয়ে দুফোঁটা চোখের জল মালকিনের পায়ের ওপর পড়ে। কাঁদিস না রে, ভালো হয়ে যাবি। বাঁচতে তো তোকে হবেই। ঘরে ছেলেপিলে আছে, মালকিন বলে।
বিধাতা অলক্ষে হাসেন—এ কিসের সম্পর্ক! সম্পূর্ণ বিজাতীয় পুরুষ দামু। এ তো স্নেহের সম্পর্ক নয়, না তো এ প্রেমজ সম্পর্ক, বা অপত্য সম্পর্ক। এর একটাই নাম মানবতা। সেখানে না আছে স্বামী-স্ত্রীর সীমারেখা, না আছে ভাই-বোন বা মাতা পুত্রের বাঁধন। কোনও স্বার্থ নেই, না আছে কোনো চাওয়া, পাওয়া। এটুকুর টানেই সূর্য আলো দেয়, বিনা স্বার্থে বাতাস বয় ধনী, দরিদ্র, পাপী, পুণ্যবান সকলের জন্য। প্রসাদবারি আকাশ থেকে পড়ে ঝরে, ভোরের আলো ফোটে, পাখিরা গান গায়।
আস্তে আস্তে দামুর মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। শিগগিরই সেরে উঠবে সে। ঝুমরি আর ছেলে-মেয়ে দুটোর হাসি হাসি মুখ তার দিকে চেয়ে থাকে। আস্তে আস্তে চোখ খোলে দামুথ বাঁচতে তাকে হবেই—শুধু বেঁচে থাকার জন্যে। শীর্ণ হাতদুটো তুলে গড় করে সেজ মালকিনকে। গোয়ালের গরুটা হাম্বা রবে ডেকে ওঠে বাছুরটার দিকে তাকিয়ে।