এই যে ভাই, আপনার কি কোনো সাহায্যের প্রয়োজন?
পেছন থেকে ডাকটা শুনে মাথা ঘোড়াই। আমাকে দেখে ভদ্রলোক জিভ কেটে লজ্জা প্রকাশ করে বলেন, স্যরি ভাইয়া আমি বুঝতে পারিনি যে, আপনি কোনো সাহায্য প্রার্থী মানুষ হতে পারেন না।
ধবধবে সাদা দাড়িওয়ালা বৃদ্ধ মানুষটির অসহায়ত্ব অনুধাবন করে আমি বলি, ধন্যবাদ ভাই, আমার কোনো সাহায্যের প্রয়োজন নেই। এই শহরে গরীব মিসকিনের তো কোনো কমতি নই। তাদের খুঁজে বের করে সাহায্য করুন গিয়ে।
আমার কথায় মাথা ঝুঁকিয়ে সহমত প্রকাশ করে, লোকটি ধীর পদক্ষেপে সামনের দিকে হেঁটে গেল। হঠাৎ কী মনে করে, আামিও দু-কদম সামনে এগিয়ে তাকে ধরে বলি, তা ভাই এমন খুঁজে খুঁজে সাহায্যপ্রার্থী ধরার চেষ্টা করছেন কেন?
উনি বললেন, করছি ভাই এ জন্য যে, আমি অক্সিজেনের দাম পরিশোধ করতে চাই।
-অক্সিজেনের দাম!
-হ্যা অক্সিজেনের দাম।
-ব্যাপারটা কী একটু খুলে বলুন তো ভাই।
-বলছি। তার আগে একটু নিজের কথা বলি?
-আচ্ছ বলুন।
-নিরঙ্কুশ আদর-যত্ন একজন শিশুকে প্রকৃত এবং অভিযোজনক্ষম করে তোলায় বাধা দেয়। ছোটোবেলা থেকেই থেকে বিপুল ধন-সম্পদ আর সীমাহীন আদর-যত্নের মধ্য দিয়ে বড়ো হয়ে উঠেছি। কিন্তু প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠতে পারিনি। সবাই বলত—অমুক হ, তমুক হ—কিন্তু কেউ বলত না মানুষ হ।
আমার আব্বাকে দেখেছি অত্যন্ত বড়ো মাপের একজন মানুষ ছিলেন তিনি।
-অক্সিজেনের কাহিনী বলতে গিয়ে কি বাপ-বেটার কাহিনী শুরু করলেন!
-যে কাহিনীই বলি না কেন, ভূমিকায় আব্বার কথা আসবেই। কারণ এই যে, যেভাবে এখন আমি কথা বলছি, এই স্টাইলটাও আব্বার কাছ থেকেই শিখেছি।
-আচ্ছা বলুন, আপনার আব্বার কথাই বলুন।
-আব্বা খুব গুণী মানুষ ছিলেন। তিনি যেমন ছিলেন গুণী তেমনি ছিলেন জ্ঞানী। অর্থাৎ তাত্ত্বিক, সমাজ বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক ও রাজনীতির সম্মিলিত ধারক। আব্বা তাঁর সময়ের একজন বিখ্যাত মানুষ ছিলেন। নামের পরিচিতিতে তার সাথে টেক্কা দেয়ার কেউ ছিল না।
-আচ্ছা এ ভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলা তো ভালো দেখায় না। চলুন কোথাও গিয়ে বসি।
-সেটাই ভালো হবে, চলুন।
২
পাশেই একটা পার্ক মতো জায়গা ছিল। আমি ভদ্রলোককে নিয়ে সেখানে ঢুকে, একটা সিমেন্টর বেঞ্চে বসি। তারপর বলি, হ্যা এবার বলুন আপনার অক্সিজেনের কাহিনী। তার আগে আপনার নাম-ঠিকানা-সাকিন কী বলুন।
উনি বলেন, আমার নাম নিজামউদ্দিন প্রামাণিক। লক্ষ্মীবাজারে যে প্রামাণিক ভিলা আছে, ওটাই আমার সাকিন। দেশের বাড়ি কুমিল্লায়। তিন পুরুষ ধরে ঢাকায় থাকি। পূর্ব পুরুষের উত্তারাধিকারী হিসেবে, অঢেল বৈভবের মালিক আমি। আমার ধন সম্পত্তি-স্থাবর-অস্থাবর মিলিয় যা আছে, তাতে বলতে গেলে ঢাকা শহরের ছোট্ট একটা অংশই আমার।
-আপনার আব্বার নাম কী ছিল?
-আব্বার নাম ছিল সিরাজউদ্দিন প্রমাণিক।
এবার আাশে পাশে তাকিয়ে নিজামুদ্দিন বললেন, চারিদিকে একটু তাকিয়ে দেখুন, শুধু নির্মাণ আর নির্মাণ। সব কংক্রিটের নির্মাণ। কংক্রিট নির্মাণ এখন উন্নয়নের সমার্থক হয়ে উঠেছে। উন্নয়ন আর শপিং প্লাজাও এখন সমার্থক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। উন্নয়ন শব্দটাই এখন এতো উজ্জ্বল যে, কাদের জন্য এই উন্নয়ন, সেই প্রশ্নটির দিকে বেশিক্ষণ দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রাখা যাচ্ছে না।
-প্রথমে আপনার আব্বার কথা বললেন, তারপর বলছেন শহরের উন্নয়নের কথা। এ দুটো বিষয়ের মধ্যে সাযুজ্যটা কোথায়?
-প্রথমে আমার আব্বার কথা বললাম এই জন্য যে, আমি আমার আব্বার মতো হতে পারিনি। সেটা আমার সারা জীবনের একটা আক্ষেপ। আব্বার মতো যদি হতে পারতাম, তা হলে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার বাহানাটা হয়ত মানাতো। আমি তো এই পৃথিবীতে একজন পাপী মানুষ। এটাই আমার একটা দুঃখ। আর শহরের উন্নতীর কথা বললাম এই জন্য যে, মানুষ নিজেকে নিয়ে কত বিভোর হয়ে আছে। নিজের সুখ সমৃদ্ধি আর উন্নতির জন্য কত কিছু করছে। প্যারালালে অসহায় মানুষের জন্য সময় ও সমাজ কী করছে? যারা এ সব করছে, তারা একবারও ভাবে না, এত শপিং কমপ্লেক্স না বানিয়ে, গরীব ও পেশাহীন মানুুষের জন্য আয়-রোজগারের কোনো পথ সৃষ্টি করলে, কতই না ভালো হতো।
-আপনি তো বিশাল বৈভবের মালিক। আপনি নিশ্চয় কিছু করছেন, অসহায় মানুষদের জন্য।
-করছি যতটুকু পারছি। তবে সবাই মিলে করলে, এ দেশের দরিদ্র রেখাই ঘুঁচে যেত। এই যে দেখুন, বা পাশে কারা যেন একটা মাল্টিস্টোরি হাসপাতাল বানিয়ে রেখেছেপ্রাইভেট হাসপাতাল। প্রাইভেট হাসপাতাল ও ডায়াগোনোস্টিক সেন্টারগুলো, এ যুগের রক্তচোষার আইকন।
-সে কেমন?
-এই হাসপাতালগুলোতে রোগী বাঁচানোর ব্যবস্থা থাকলেও, রোগীর স্বজনদের সর্বশান্ত করারও পাক্কা ব্যবস্থা আছে। অর্থাৎ মানুষকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে দেয়ার জন্য, এই প্রাইভেট হাসপাতালগুলোর সৃষ্টি হয়েছে। শুধু তাই না, এদের কোনো কোনোটি আবার সরাসরি ডাকাতিও করে।
-সে কেমন?
-ঐ যে শোনেননি—Ñমাঝে মাঝে ভুয়া করোনার রিপোর্ট তৈরি করে, লক্ষ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে, প্রাইভেট হাসপাতালগুলো।
-হ্যা শুনেছি।
-শিক্ষা যেমন একটা ঘোষিত পণ্য—প্রাইভেট হাসপাতালগুলোও এখন তাই। প্রাইভেট সেক্টরে ধনীরা এসে বাঁচে, কিন্তু অন্য সেক্টর হতে ছিটকে আসা গরীব মানুষগুলো প্রাইভেট সেক্টরে এসে কদাচ বাঁচলেও, অর্থনৈতিকভাবে একেবারেই পঙ্গু হয়ে যায়।
-আপনি কি কখনো প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন?
-হ্যা। যখনই অসুস্থ হই, ছেলেরা ধরে নিয়ে প্রাইভেটেই ভর্তি করায়।
এই যে আমরা মানুষ এই পৃথিবীতে, আমরা কত নাজুক-ভঙ্গুর এবং ক্ষণস্থায়ী! একটুতেই হাজারো রোগ বালাই এসে আক্রমণ করে বসে আমাদের। অতি অল্পেতেই মিইয়ে যাই আমরা। তবুও আমরা নিজেদের সৃষ্টির সেরা জীব বলে দাবি করি। অথচ আল্লাহর সৃষ্টি এমন প্রাণীও আছে এই পৃথিবীতে, যারা আমাদেও চেয়েও শত গুণ ঘাতসহী।
-কাদের কথা বলছেন ভাই?
-বলছি আল্লাহর সৃষ্টি অন্যান্য প্রাণীদের কথা। যাদের সহনক্ষমতা কল্পবিজ্ঞানকেও হার মানায়।
-সে কেমন?
–তাদের একত্রে বলা হয়, ‘এক্সিট্রমোফিল’। প্রকৃতির চরম অবস্থাই এদের স্বাভাবিক স্ফূরণের সহায়ক। এদের মধ্যে আছে এমন ব্যাকটেরিয়া, যারা বাঁচে এক লক্ষ র্যাড বিকিরণেও। যেখানে একশ’ র্যাড সাত দিনের মধ্যে মানুষের মৃত্যু ঘটায়। আছে এমন ব্যাকটেরিয়া সাদৃশ্য জীব, যারা বাঁচে একশ’ দশ ডিগ্রি সেলসিয়াস ফুটন্ত জলের চেয়েও বেশি তাপ মাত্রায়। আছে ব্যাকটেরিয়া ছত্রাকের এমন সমাহার, যারা বাঁচে মাটির দু-মাইল নিচে পাথুরে স্তরে। অথবা ধরুন, সমুদ্রের নিচে ভূত্বকের ফাঁটল বরারবর। যেখানে ফুটে বেরুচ্ছে পৃথিবীর আগুন।
-এ সব কথা কেন বলছেন বুঝতে পারছি না, যেখানে আপনি অক্সিজেনের দাম পরিশোধ করার জন্য একজন সাহায্য প্রার্থী খুঁজে ফিরছেন।
-বলছি এ জন্য যে, মানুষ জাতি আমরা নিজেদের পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব বলে দাবি করি, কিন্তু সহন ক্ষমতার দিক দিয়ে ঐ সমস্ত প্রাণীরাও আমাদের চেয়েও কত প্রায়র।
-ঐ যে র্যাড বিকিরণ বললেন, এই র্যাডটা কী?
-র্যাড হলো তড়িৎ চুম্বকীয় বিকীরণ। যার একশ’ মাত্রা কোনো মানুষের ওপর সাত দিন পড়লেই, তার মৃত্যু হতে পারে।
-ছাত্রজীবনে আপনি কী বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করেছেন?
-আমি ছিলাম সাহিত্যের ছাত্র। এ সব ব্যাপার জেনেছি, আমার আব্বার কাছ থেকে। আব্বা ছিলেন, পরমাণু কেন্দ্রের একজন অনারারী রিচার্সার।
-অনারারী কেস?
-সম্পত্তি দেখে শুনে, তারপর তো আর প্রথাগত চাকুরি করার সময় পেতেন না। তাই শখের বশে যখন মন চাইত, কর্মস্থলে গিয়ে একবার ঢু মেরে আসতেন।
এখন চলছে, করোানার মহামারি। কুয়াশার মতো চারিদিকে বিছিয়ে আছে মৃত্যুর ফাঁদ। প্রতিদিন হানাদারের মতো এগিয়ে আসছে, অলৌকিক ডাকঘরের নিষ্ঠুর হরকরা।
বয়েস হয়েছে—শরীর সব সময় এতই ক্লান্ত লাগে যে, বালিশে মাথা রাখলেই মনে হয় যেন অর্ধ-সমাধিস্থ হয়ে যাই।
-এর মাঝে আপনি কি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন?
-হ্যা। তারপর থেকেই তো সব সময় এমন মনে হয়।
-কী হয়েছিল আপনার?
-কী আবার? সবার আজকাল যা হয়। ফুসফুস খেকো করোনা।
-আচ্ছা আপনি তো বললেন, অমুক হ-তমুক হ-কিন্তু কেউ বলে না মানুষ হ। আপনি কি মনে করেন অদ্যাবধি আপনি একজন মানুষ হয়ে উঠতে পারেননি?
-না পারিনি। কারণ মানুষ হতে হলে, প্রথমে গুণী হতে হয়। গুণ একটি ছাতা শব্দ। এর নিচে জমা হয়ে থাকে অনেকগুলো সমার্থক শব্দ।
-যেমন?
-যেমন সহনশীল, সংযমী, দক্ষ, সহমর্মী, দয়ালু, জ্ঞানী, পরোপেকারী, সংবেদী, নমনীয়, কমনীয় এবং অবশ্যই শিক্ষিত। এই সবগুলোর সমাহার থাকলেই একজন দু-পেয়ে জীবকে পারফেক্ট মানুষ বলা যেতে পারে।
-বাব্বাহ্! এত বিষয়ের ওপর একসাথে একজন মানুষ কি আয়ত্ব আনতে পারে?
-সে জন্যই তো বলি, মানুষ হওয়া এত সহজ না।
-তা আপিনি তো এখন সুস্থ আছেন।
-হ্যা, আল্লাহর রহমতে তা আছি।
-তা হলে মনে বল আর স্থিরতা আনুন। যে ক’দিন বাঁচবেন, প্রফুল্ল মনেই বাঁচুন। আপনি সুখী থাকলে, আপনার পরিবারও আনন্দে ধাকবে।
-হ্যা তা তো সত্য কথাই বলেছেন ভাই। মরতে তো ভয় পাই না। তবে সব সময় এই দুশ্চিন্তায় থাকি যে, আমার মৃত্যুর পর আমার বিশাল সম্পত্তি আমার অধোঃপুরুষরা নষ্ট করে ফেলবে না তো? উদ্বৃত্ত সম্পদ ভালো কাজে ব্যবহার করবে তো?
-সেই চিন্তা ওপরওয়ালার হাতেই ছেড়ে দিন। আপনার জীবনে আপনি জ্ঞান ও সততার যে চর্চা করেছেন, তার বিনিময়ে সৃষ্টিকর্তা তাদের নিশ্চয়ই ভালো রাখবেন।
এবার বলুন, অক্সিজেনের দাম পরিশোধ করার জন্য যে মানুষ খুঁজে ফিরছেন, এর রহস্যটা কী?
আমার এই প্রশ্নে থমকে গেলন নিজাম। ওনার ঠোঁট কাঁপলো, নাক হাস-ফাঁস করলো। উনি কাঁদবেন বুঝতে পেরে, আমি ওনার ডান হাতের পাঞ্জাখানা চেপে ধরলাম। উনি তা ওনার বা হাত দিয়ে চেপে ধরে কেঁদে পড়লেন। টানা দুই মিনিট কেঁদে, চোখ মুছে নিজাম বললেন, করোনা হয়েছিল পর, টানা আঠেরো দিন হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম—প্রাইভেট হাসপাতালে। ওরা প্লাস্টিক সার্ভিস দিয়ে আমাকে সুস্থ করে তুললো ঠিকই…।
-প্লাস্টিক সার্ভিস মানে?
-প্লাস্টিক সার্ভিস মানে, কাজের সময় মুখে বেদানা রঙের হাসি, আর অন্তরে কাঞ্চনমুদ্রার হাহাকার।
-আচ্ছা…। তারপর বলুন।
-সুস্থ হলাম ঠিকই, কিন্তু হাতে বিল এলে তা দেখে যেন আবার অসুস্থ হয়ে পড়লাম। এ যেন তেমন—এক কিডনি পঁচা রোগী হাসপাতাল হতে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছিল-বিল পে কাউন্টারে গেলে তাকে অসম্ভব বড়ো অঙ্কের একটা বিল দেয়া হলো। তা দেখে লোকটি বিলের ডাবল অঙ্কের টাকা লিখে একটা চেক দিলো। এর কারণ জিজ্ঞেস করলে লোকটি বলল, তোমাদের বিলের পরিমাণ দেখে, আমার ভালো কিডনিটাও এই মাত্র পঁচে গেল। এটারও তো চিকিৎসা করতে হবে!!
আঠেরো দিনে আমার বিল ধরেছিল ওরা—সাত লাখ তেপান্ন হাজার টাকা। তার মধ্যে অক্সিজেনের বিলই ছিল, সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা। বিলের বিভিন্ন আইটেমগুলোর পাশে যে অংক লেখা ছিল, তা থেকে যেন একটা চামাড়ি চামাড়ি গন্ধ উঠে আসছিল। সে কেন?
-প্রতিটি অঙ্কই ছিল, হাস্যকর ধরনের অতিরিক্ত। যখন বাড়ি যাবার জন্য তৈরি হলাম, তখন বার বার বুক নিংরে কান্না উঠে আসছিল।
-কেন?
-আমাকে কাঁদতে দেখে এক সিস্টার বলল, আপনি তো এখন সম্পূর্ণ সুস্থ নানা। এবার বাড়িও ফিরে যাবেন। তবে আবার কাঁদছেন কেন? আমি চোখ মুছে বললাম, তোমরা আমাকে আঠেরো দিনে যে অক্সিজেন দিয়েছ, তার দাম ধরেছো সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা। এখন ভাবছি, সেই হিসেবে আমার জীবনের সত্তর বছর বয়েস পর্যন্ত আল্লাহ্ আমাকে নিশ্বাাস নেয়ার জন্য যে পরিমাণ অক্সিজেন দিয়েছেন, তার দাম না জানি কত হতে পারে। সেই দাম পরিশোধ করার টাকা কি আমার আছে? সেই দুশ্চিন্তাই বারবার কান্না আসছিল।
শেষে বাড়ি এসে ভাবলাম, সত্তর বছরের অক্সিজেনের মূল্য তো আমার কাছে নেই। তবে যা আছে, তা দিয়ে কিছুটা হলেও তো আল্লাহ্র দয়ার দেনা পরিশোধের চেষ্টা করতে পারি। সেই ভেবেই যেখানে যাই, আল্লাহ্ বান্দাদের খুঁজে বেড়াই, যদি সেই দামের কিছুটা দিয়ে তাদের কোনো উপকার করতে পারি…।
২
পাশেই একটা পার্ক মতো জায়গা ছিল। আমি ভদ্রলোককে নিয়ে সেখানে ঢুকে, একটা সিমেন্টর বেঞ্চে বসি। তারপর বলি, হ্যা এবার বলুন আপনার অক্সিজেনের কাহিনী। তার আগে আপনার নাম-ঠিকানা-সাকিন কী বলুন।
উনি বলেন, আমার নাম নিজামউদ্দিন প্রামাণিক। লক্ষ্মীবাজারে যে প্রামাণিক ভিলা আছে, ওটাই আমার সাকিন। দেশের বাড়ি কুমিল্লায়। তিন পুরুষ ধরে ঢাকায় থাকি। পূর্ব পুরুষের উত্তারাধিকারী হিসেবে, অঢেল বৈভবের মালিক আমি। আমার ধন সম্পত্তি-স্থাবর-অস্থাবর মিলিয় যা আছে, তাতে বলতে গেলে ঢাকা শহরের ছোট্ট একটা অংশই আমার।
-আপনার আব্বার নাম কী ছিল?
-আব্বার নাম ছিল সিরাজউদ্দিন প্রমাণিক।
এবার আাশে পাশে তাকিয়ে নিজামুদ্দিন বললেন, চারিদিকে একটু তাকিয়ে দেখুন, শুধু নির্মাণ আর নির্মাণ। সব কংক্রিটের নির্মাণ। কংক্রিট নির্মাণ এখন উন্নয়নের সমার্থক হয়ে উঠেছে। উন্নয়ন আর শপিং প্লাজাও এখন সমার্থক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। উন্নয়ন শব্দটাই এখন এতো উজ্জ্বল যে, কাদের জন্য এই উন্নয়ন, সেই প্রশ্নটির দিকে বেশিক্ষণ দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রাখা যাচ্ছে না।
-প্রথমে আপনার আব্বার কথা বললেন, তারপর বলছেন শহরের উন্নয়নের কথা। এ দুটো বিষয়ের মধ্যে সাযুজ্যটা কোথায়?
-প্রথমে আমার আব্বার কথা বললাম এই জন্য যে, আমি আমার আব্বার মতো হতে পারিনি। সেটা আমার সারা জীবনের একটা আক্ষেপ। আব্বার মতো যদি হতে পারতাম, তা হলে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার বাহানাটা হয়ত মানাতো। আমি তো এই পৃথিবীতে একজন পাপী মানুষ। এটাই আমার একটা দুঃখ। আর শহরের উন্নতীর কথা বললাম এই জন্য যে, মানুষ নিজেকে নিয়ে কত বিভোর হয়ে আছে। নিজের সুখ সমৃদ্ধি আর উন্নতির জন্য কত কিছু করছে। প্যারালালে অসহায় মানুষের জন্য সময় ও সমাজ কী করছে? যারা এ সব করছে, তারা একবারও ভাবে না, এত শপিং কমপ্লেক্স না বানিয়ে, গরীব ও পেশাহীন মানুুষের জন্য আয়-রোজগারের কোনো পথ সৃষ্টি করলে, কতই না ভালো হতো।
-আপনি তো বিশাল বৈভবের মালিক। আপনি নিশ্চয় কিছু করছেন, অসহায় মানুষদের জন্য।
-করছি যতটুকু পারছি। তবে সবাই মিলে করলে, এ দেশের দরিদ্র রেখাই ঘুঁচে যেত। এই যে দেখুন, বা পাশে কারা যেন একটা মাল্টিস্টোরি হাসপাতাল বানিয়ে রেখেছেপ্রাইভেট হাসপাতাল। প্রাইভেট হাসপাতাল ও ডায়াগোনোস্টিক সেন্টারগুলো, এ যুগের রক্তচোষার আইকন।
-সে কেমন?
-এই হাসপাতালগুলোতে রোগী বাঁচানোর ব্যবস্থা থাকলেও, রোগীর স্বজনদের সর্বশান্ত করারও পাক্কা ব্যবস্থা আছে। অর্থাৎ মানুষকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে দেয়ার জন্য, এই প্রাইভেট হাসপাতালগুলোর সৃষ্টি হয়েছে। শুধু তাই না, এদের কোনো কোনোটি আবার সরাসরি ডাকাতিও করে।
-সে কেমন?
-ঐ যে শোনেননি—মাঝে মাঝে ভুয়া করোনার রিপোর্ট তৈরি করে, লক্ষ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে, প্রাইভেট হাসপাতালগুলো।
-হ্যা শুনেছি।
-শিক্ষা যেমন একটা ঘোষিত পণ্য—প্রাইভেট হাসপাতালগুলোও এখন তাই। প্রাইভেট সেক্টরে ধনীরা এসে বাঁচে, কিন্তু অন্য সেক্টর হতে ছিটকে আসা গরীব মানুষগুলো প্রাইভেট সেক্টরে এসে কদাচ বাঁচলেও, অর্থনৈতিকভাবে একেবারেই পঙ্গু হয়ে যায়।
-আপনি কি কখনো প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন?
-হ্যা। যখনই অসুস্থ হই, ছেলেরা ধরে নিয়ে প্রাইভেটেই ভর্তি করায়।
এই যে আমরা মানুষ এই পৃথিবীতে, আমরা কত নাজুক-ভঙ্গুর এবং ক্ষণস্থায়ী! একটুতেই হাজারো রোগ বালাই এসে আক্রমণ করে বসে আমাদের। অতি অল্পেতেই মিইয়ে যাই আমরা। তবুও আমরা নিজেদের সৃষ্টির সেরা জীব বলে দাবি করি। অথচ আল্লাহর সৃষ্টি এমন প্রাণীও আছে এই পৃথিবীতে, যারা আমাদেও চেয়েও শত গুণ ঘাতসহী।
-কাদের কথা বলছেন ভাই?
-বলছি আল্লাহর সৃষ্টি অন্যান্য প্রাণীদের কথা। যাদের সহনক্ষমতা কল্পবিজ্ঞানকেও হার মানায়।
-সে কেমন?
–তাদের একত্রে বলা হয়, ‘এক্সিট্রমোফিল’। প্রকৃতির চরম অবস্থাই এদের স্বাভাবিক স্ফূরণের সহায়ক। এদের মধ্যে আছে এমন ব্যাকটেরিয়া, যারা বাঁচে এক লক্ষ র্যাড বিকিরণেও। যেখানে একশ’ র্যাড সাত দিনের মধ্যে মানুষের মৃত্যু ঘটায়। আছে এমন ব্যাকটেরিয়া সাদৃশ্য জীব, যারা বাঁচে একশ’ দশ ডিগ্রি সেলসিয়াস ফুটন্ত জলের চেয়েও বেশি তাপ মাত্রায়। আছে ব্যাকটেরিয়া ছত্রাকের এমন সমাহার, যারা বাঁচে মাটির দু-মাইল নিচে পাথুরে স্তরে। অথবা ধরুন, সমুদ্রের নিচে ভূত্বকের ফাঁটল বরারবর। যেখানে ফুটে বেরুচ্ছে পৃথিবীর আগুন।
-এ সব কথা কেন বলছেন বুঝতে পারছি না, যেখানে আপনি অক্সিজেনের দাম পরিশোধ করার জন্য একজন সাহায্য প্রার্থী খুঁজে ফিরছেন।
-বলছি এ জন্য যে, মানুষ জাতি আমরা নিজেদের পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব বলে দাবি করি, কিন্তু সহন ক্ষমতার দিক দিয়ে ঐ সমস্ত প্রাণীরাও আমাদের চেয়েও কত প্রায়র।
-ঐ যে র্যাড বিকিরণ বললেন, এই র্যাডটা কী?
-র্যাড হলো তড়িৎ চুম্বকীয় বিকীরণ। যার একশ’ মাত্রা কোনো মানুষের ওপর সাত দিন পড়লেই, তার মৃত্যু হতে পারে।
-ছাত্রজীবনে আপনি কী বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করেছেন?
-আমি ছিলাম সাহিত্যের ছাত্র। এ সব ব্যাপার জেনেছি, আমার আব্বার কাছ থেকে। আব্বা ছিলেন, পরমাণু কেন্দ্রের একজন অনারারী রিচার্সার।
-অনারারী কেস?
-সম্পত্তি দেখে শুনে, তারপর তো আর প্রথাগত চাকুরি করার সময় পেতেন না। তাই শখের বশে যখন মন চাইত, কর্মস্থলে গিয়ে একবার ঢু মেরে আসতেন।
এখন চলছে, করোানার মহামারি। কুয়াশার মতো চারিদিকে বিছিয়ে আছে মৃত্যুর ফাঁদ। প্রতিদিন হানাদারের মতো এগিয়ে আসছে, অলৌকিক ডাকঘরের নিষ্ঠুর হরকরা।
বয়েস হয়েছে—শরীর সব সময় এতই ক্লান্ত লাগে যে, বালিশে মাথা রাখলেই মনে হয় যেন অর্ধ-সমাধিস্থ হয়ে যাই।
-এর মাঝে আপনি কি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন?
-হ্যা। তারপর থেকেই তো সব সময় এমন মনে হয়।
-কী হয়েছিল আপনার?
-কী আবার? সবার আজকাল যা হয়। ফুসফুস খেকো করোনা।
-আচ্ছা আপনি তো বললেন, অমুক হ-তমুক হ-কিন্তু কেউ বলে না মানুষ হ। আপনি কি মনে করেন অদ্যাবধি আপনি একজন মানুষ হয়ে উঠতে পারেননি?
-না পারিনি। কারণ মানুষ হতে হলে, প্রথমে গুণী হতে হয়। গুণ একটি ছাতা শব্দ। এর নিচে জমা হয়ে থাকে অনেকগুলো সমার্থক শব্দ।
-যেমন?
-যেমন সহনশীল, সংযমী, দক্ষ, সহমর্মী, দয়ালু, জ্ঞানী, পরোপেকারী, সংবেদী, নমনীয়, কমনীয় এবং অবশ্যই শিক্ষিত। এই সবগুলোর সমাহার থাকলেই একজন দু-পেয়ে জীবকে পারফেক্ট মানুষ বলা যেতে পারে।
-বাব্বাহ্! এত বিষয়ের ওপর একসাথে একজন মানুষ কি আয়ত্ব আনতে পারে?
-সে জন্যই তো বলি, মানুষ হওয়া এত সহজ না।
-তা আপিনি তো এখন সুস্থ আছেন।
-হ্যা, আল্লাহর রহমতে তা আছি।
-তা হলে মনে বল আর স্থিরতা আনুন। যে ক’দিন বাঁচবেন, প্রফুল্ল মনেই বাঁচুন। আপনি সুখী থাকলে, আপনার পরিবারও আনন্দে ধাকবে।
-হ্যা তা তো সত্য কথাই বলেছেন ভাই। মরতে তো ভয় পাই না। তবে সব সময় এই দুশ্চিন্তায় থাকি যে, আমার মৃত্যুর পর আমার বিশাল সম্পত্তি আমার অধোঃপুরুষরা নষ্ট করে ফেলবে না তো? উদ্বৃত্ত সম্পদ ভালো কাজে ব্যবহার করবে তো?
-সেই চিন্তা ওপরওয়ালার হাতেই ছেড়ে দিন। আপনার জীবনে আপনি জ্ঞান ও সততার যে চর্চা করেছেন, তার বিনিময়ে সৃষ্টিকর্তা তাদের নিশ্চয়ই ভালো রাখবেন।
এবার বলুন, অক্সিজেনের দাম পরিশোধ করার জন্য যে মানুষ খুঁজে ফিরছেন, এর রহস্যটা কী?
আমার এই প্রশ্নে থমকে গেলন নিজাম। ওনার ঠোঁট কাঁপলো, নাক হাস-ফাঁস করলো। উনি কাঁদবেন বুঝতে পেরে, আমি ওনার ডান হাতের পাঞ্জাখানা চেপে ধরলাম। উনি তা ওনার বা হাত দিয়ে চেপে ধরে কেঁদে পড়লেন। টানা দুই মিনিট কেঁদে, চোখ মুছে নিজাম বললেন, করোনা হয়েছিল পর, টানা আঠেরো দিন হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম—প্রাইভেট হাসপাতালে। ওরা প্লাস্টিক সার্ভিস দিয়ে আমাকে সুস্থ করে তুললো ঠিকই…।
-প্লাস্টিক সার্ভিস মানে?
-প্লাস্টিক সার্ভিস মানে, কাজের সময় মুখে বেদানা রঙের হাসি, আর অন্তরে কাঞ্চনমুদ্রার হাহাকার।
-আচ্ছা…। তারপর বলুন।
-সুস্থ হলাম ঠিকই, কিন্তু হাতে বিল এলে তা দেখে যেন আবার অসুস্থ হয়ে পড়লাম। এ যেন তেমন—এক কিডনি পঁচা রোগী হাসপাতাল হতে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছিল-বিল পে কাউন্টারে গেলে তাকে অসম্ভব বড়ো অঙ্কের একটা বিল দেয়া হলো। তা দেখে লোকটি বিলের ডাবল অঙ্কের টাকা লিখে একটা চেক দিলো। এর কারণ জিজ্ঞেস করলে লোকটি বলল, তোমাদের বিলের পরিমাণ দেখে, আমার ভালো কিডনিটাও এই মাত্র পঁচে গেল। এটারও তো চিকিৎসা করতে হবে!!
আঠেরো দিনে আমার বিল ধরেছিল ওরা—সাত লাখ তেপান্ন হাজার টাকা। তার মধ্যে অক্সিজেনের বিলই ছিল, সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা। বিলের বিভিন্ন আইটেমগুলোর পাশে যে অংক লেখা ছিল, তা থেকে যেন একটা চামাড়ি চামাড়ি গন্ধ উঠে আসছিল। সে কেন?
-প্রতিটি অঙ্কই ছিল, হাস্যকর ধরনের অতিরিক্ত। যখন বাড়ি যাবার জন্য তৈরি হলাম, তখন বার বার বুক নিংরে কান্না উঠে আসছিল।
-কেন?
-আমাকে কাঁদতে দেখে এক সিস্টার বলল, আপনি তো এখন সম্পূর্ণ সুস্থ নানা। এবার বাড়িও ফিরে যাবেন। তবে আবার কাঁদছেন কেন? আমি চোখ মুছে বললাম, তোমরা আমাকে আঠেরো দিনে যে অক্সিজেন দিয়েছ, তার দাম ধরেছো সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা। এখন ভাবছি, সেই হিসেবে আমার জীবনের সত্তর বছর বয়েস পর্যন্ত আল্লাহ্ আমাকে নিশ্বাাস নেয়ার জন্য যে পরিমাণ অক্সিজেন দিয়েছেন, তার দাম না জানি কত হতে পারে। সেই দাম পরিশোধ করার টাকা কি আমার আছে? সেই দুশ্চিন্তাই বারবার কান্না আসছিল।
শেষে বাড়ি এসে ভাবলাম, সত্তর বছরের অক্সিজেনের মূল্য তো আমার কাছে নেই। তবে যা আছে, তা দিয়ে কিছুটা হলেও তো আল্লাহ্ দয়ার দেনা পরিশোধের চেষ্টা করতে পারি। সেই ভেবেই যেখানে যাই, আল্লাহ্ বান্দাদের খুঁজে বেড়াই, যদি সেই দামের কিছুটা দিয়ে তাদের কোনো উপকার করতে পারি…।
● রিংকু সারথি : গল্পকার, কলামিস্ট।
ই-মেইল : rinkusharothi2021@ gmail.com