প্রথমেই ‘কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০২০’ পাস করায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কুড়িগ্রামবাসীর পক্ষ থেকে প্রাণঢালা শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। বন্যাপ্রবণ ও দারিদ্র্যপীড়িত জেলা কুড়িগ্রাম। কৃষি প্রধান এ অঞ্চলকে এগিয়ে নিতে মুজিব বর্ষের শ্রেষ্ঠ উপহার কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। এর স্থান নির্বাচনে কুড়িগ্রাম জেলার ঐতিহাসিক স্থান উলিপুরের ধরণীবাড়ি ইউনিয়নের ‘মুন্সিবাড়ি’ স্থানটি বিভিন্ন কারণে উপযুক্ত।
১. মুন্সিবাড়ি ছিল কাশিম বাজার এস্টেট পরগণার সদর দপ্তর, এস্টেটের রাজধানীও বলা চলে। বাহারবন্দ জমিদারীর প্রশাসন কেন্দ্র। এ পরগণার আয়তন ছিল ৫২০ বর্গমাইল। বার্ষিক কৃষি খাজনা ছিল ৯৫,৭৮১ টাকা। বাড়িটি ১৮ শতকে ৩৯ একর জমির ওপর নির্মিত। এখানে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হওয়ার উপযুক্ত স্থান। এ ক্ষেত্রে সরকারের বিভিন্ন দিক দিয়ে সাশ্রয় হবে। জমি ক্রয় বা অধিগ্রহণের প্রয়োজন হবে না। শুধুমাত্র ৩৯ একর জমি উদ্ধার করলেই যথেষ্ট।
এর আগে এই জমিদার ও তাঁর জমিদারি সম্পর্কে একটু জেনে নেয়া যাক। যদিও জমিদাদের জমিদারী অনেক আগে চলে গিয়েছে, কিন্তু লোক মুখে তাদের সম্পর্কে রয়েছে অনেক বিরূপ মন্তব্য। কিন্তু জমিদারের এমন একজন ছিলেন যিনি স্রোতের বিপরীত। তাঁর কাজ কিংবা শাসনে কখনই বা কোনোদিন জমিদারী মনোভাব ফুটে ওঠেনি, তিনি বনোয়ারী মুন্সী। তাঁর জমিদারি এলাকা কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর এলাকায়। বনোয়ারী মুন্সীর কোনো ছেলে ছিল না, ছিল শুধু দুটো মেয়ে। তাদের বিয়ে দেওয়া হয়েছিল কলকাতায় কোনো এক জমিদারের ছেলেদের সঙ্গে। জমিদারের একমাত্র স্ত্রী কর্তি রাণী। তিনি এলাকায় দানশীল নারী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। বনোয়ারী মুন্সী প্রজাদের সঙ্গে অনেক সুন্দর ব্যবহার করতেন, জোর দিয়ে কখনই খাজনা আদায় করেননি, তাই এখনও তাঁর বিরুদ্ধে কেউ কোন কথা বলে না, এখনও লোক মুখে তাঁর সুনাম শোনা যায়, যখন তাঁর জমিদারি চলে যায়, তখনও রয়ে যায় তাঁর প্রচুর সম্পত্তি। কিন্তু তাঁর কোনো ছেলে না থাকার কারণে অনিশ্চয়তা তৈরি হয় কে তাঁর অবর্তমানে এই সম্পত্তি দেখাশুনার ভার নিবে। তাই তিনি হিন্দুু হয়েও মুসলমানের একটি ছেলেকে পালন করেছিলেন। তার নাম ছিল ফজল মিয়া। জমিদার দেশ ভাগের অনেক আগেই মারা যান, তিনি মারা যাওযার পর তাঁর এই বিশাল সম্পত্তির ভার তার স্ত্রীর ওপর এসে পড়ে। কিন্তু তিনিও মারা যান দেশ ভাগের পর পর। তারা যখন সবাই মারা যান, তখন সেই সম্পত্তি মালিক হিসাবে কেউই ছিল না। এদিকে মালিক না থাকার কারণে, স্থানীয় জনগণ নিজেদের সুবিধামতো জমিদারের সম্পত্তি দখল করে নিয়ে নেয়। শুরু হয় গায়ের জোরে ভোগ দখল—বাংলাদেশ সরকারের ভূমি অফিস সেটাকে নিলামে তুলে মালিকানা হস্তান্তর করে। কিন্তু সেই মালিকানা হস্তান্তরে নিয়ে চলে অনেক নাটক, সংঘটিত হয় বহুমুখি সংঘর্ষ, গণ্ডগোল।
সঠিক তত্ত্বাবধান আর পরিচর্যার অভাবে জমি-জমা দখল করে নিয়েছে এলাকার কতিপয় প্রভাবশালী ব্যক্তি। তাই জমিগুলো উদ্ধার করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের জায়গার কোনো সংকট হবে না। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুন্সিবাড়িটি মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প ভেবে পাক বাহিনী আক্রমণ চালিয়ে এর ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। বর্তমানে মুন্সিবাড়িতে ইউনিয়ন ভূমি অফিস, ইসলামিক মিশন, মসজিদ ও ইবতিদায়ী মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত। বাকী অংশ পরিত্যক্ত ও অনেকের দখলভুক্ত। তাই বাড়িটি উদ্ধার করে কাজে লাগানোর এখনই সময়।
২. মুন্সিবাড়ি জোতদারের মালিক ‘মহারানী স্বর্ণময়ী’ ১৮৮৬ সালে একটি উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। যেটি উলিপুর এম এস (মহারাণী স্বর্ণময়ী) স্কুল নামে পরিচিত। এর পাশাপাশি মুন্সিবাড়িতে একটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলে এ অঞ্চলে উন্নয়নের নব দিগন্তের দ্বার উন্মোচন হবে।
দ্বিতীয়ত, কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবক শ্রী নরেন্দ্রনাথ দেব এই উলিপুরেরই সন্তান। ১৯৭৮ সালে পা চালিত নলকূপ আবিষ্কার করে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। তাঁর আবিষ্কৃত পাম্প শ্রীলংকা, নেপাল, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ও ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়। তাঁর এ আবিস্কারে আমেরিকা তাকে ‘সার্টিফিকেট অব মেরিট’ প্রদান করেন। উলিপুরে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলে গবেষণামূলক নব নব প্রযুক্তি এলাকাকে আরও উজ্জীবিত করবে।
৩. ৭১ সালে উলিপুরের মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে একটি কোম্পানি গঠিত হয়। ফলে ব্রহ্মপুত্রের পূর্বাঞ্চল হয় মুক্তাঞ্চল। তাঁদের দমন করতে পাক বাহিনী আক্রমণ চালায়। মুক্তিযোদ্ধা কোম্পানি পাক বাহিনীর কনভয়ের ওপর পাল্টা হামলা করলে হানাদার বাহিনী হাতিয়া, ধরণীবাড়ি ও আশেপাশের ৭ শত লোককে হত্যা করে, পাক- হানাদের সাথে সম্মুখযুদ্ধে আমার মামা আব্দুল নওয়াব মিয়াসহ অনেকে নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁদের রক্ত সিক্ত মাটিতে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করলে শহীদদের ঋণ কিছুটা হলেও শোধ হবে।
৪. উলিপুরের সাথে সারাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থ্যা চমৎকার। সড়ক পথ, রেলপথ ও নৌপথ সবই বিদ্যমান। উলিপুর সংলগ্ন চিলমারী নৌবন্দর সচল হলে যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও সহজ ও উন্নত হবে। এক সময় ভারতের কুচবিহার, আসাম, মেঘালয়, চীন, মায়ানমার থেকে আসা পণ্যবাহী জাহাজ, পাইকার আর ব্যবসায়ীদের আনা-গোনায় মুখর থাকত বন্দরটি।
বন্যা প্রবণ ও দারিদ্র্য পীড়িত এলাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় হলে শিক্ষা, কৃষি উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান তৈরিতে একটি মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে। সবদিক বিবেচনায় কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়টি ঐতিহাসিক স্থান উলিপুরের ধরণীবাড়ি ইউনিয়নের মুন্সিবাড়িতে প্রতিষ্ঠিত হোক !
● নাহিদ বাবু, তরুণ লেখক।