‘‘স্ত্রী সাহায্য না করিলে কারো বাপের ক্ষমতা নেই রাজনীতি করে।’’ এই বক্তব্য যাঁর, ২০১৭ সালের ২ রা অক্টোবর তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তিনি আজ আমাদের মধ্যে নেই অথচ তার কথা আমাদের অন্তরে আছে ও থাকবে ।
১৯২০ সালে তৎকালীন ভারতের নদীয়া জেলা, বর্তমান কুষ্টিয়া জেলার কালিদাসপুর গ্রামে, পিতা হাউস উদ্দীন ও মাতা জহুরা বেগমের ঘর আলো করে এসেছিলেন এই ক্ষণজন্মা মানুষ কমরেড জসিম উদ্দীন মন্ডল। হয়ত আরো ভাই বোন ছিল তার কিন্তু কারোই স্মরণ সভা হয়ত হয় না ।
তার বাবা রেলে চাকরি করতেন। সেই সুবাদে অনেক স্থানের অনেক শ্রেণী পেশার মানুষের সাথে মেসার সুযোগ তৈরি হয়েছিল তার। কোলকাতা, রানাঘাট, নারকেলডাঙা, শিয়ালদা, সিরাজগঞ্জ, পাবর্তীপুর, ঈশ্বরদীসহ আরো অনেক স্থানে তিনি থেকেছেন অনেক বছর।
মাত্র ১৩/১৪ বছর বয়সেই বিভিন্ন সময়ে লাল পতাকার মিছিলে যোগ দিতেন তিনি। ১৯৪০ সালে শিয়ালদাতেই মাসিক ১৫ টাকা মাইনেতে রেলে চাকরিতে যোগদান করেন আর সেই সমেয়ে তিনি লাল পতাকার সক্রিয় কর্মী হিসেবেও পরিচিতি পান তার কর্মকা-ের জন্য। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলোনসহ সকল আন্দোলনেই তার ভূমিকা ছিল প্রখর রোদের মতো। ১৯৪০ সালেই তিনি ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টির সদস্য পদ লাভ করেন।
১৯৪১/১৯৪২ সালে তিনি তার কর্মে প্রোমোশন পান। তার পরে তিনি তার শ্রমিক সংগঠনের কাজে আরো ভালো করে মনোনিবেশ করেন। শ্রমিক আন্দোলনে তিনি জ্যোতি বসুর সহকর্মী ছিলেন এবং ১৯৪৬ সালে তিনি জ্যোতি বসুর নির্বচিনী কার্যক্রমের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। ১৯৪২ সালেই তিনি জাহানারা খাতুন মরিয়মের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। কমরেড মরিয়ম তার রাজনৈতিক জীবনে বিপুল উৎসাহ যুগিয়েছিলেন। তাই তো তিনি বলেছিলেন স্ত্রী সাহায্য না করিলে কারো বাপের ক্ষমতা নেই রাজনীতি করে।
তিনি দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে সৈনিক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। তার কাঁধে লেখা ছিল আই ই অর্থাৎ ইন্ডিয়ান ইঞ্জিনিয়ার্স। সেই সময় কামান আর বারুদের গাড়িগুলো নিরাপদে পৌঁছে দিতেন তার গন্তব্যে। ১৯৪০ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত তিনি নানাভাবে সাহায্য করেছেন, তা তার ইতিহাস দেখলেই দেখা যায়। ১৯৪৭ সালে তিনি দেশ বিভাগের পরে পাবর্তীপুরে, আর তার বাবা মা ঈশ্বরদীতে চলে আসেন।
১৯৪৯ সালে ক্ষুদ স্টাইকের অপরাধে তিনিসহ ৬ জন নেতার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হয় এবং তিনি গ্রেফতার হন ও চাকরিচ্যুত হন। ১৯৫৪ সালে তিনি মুক্তি পান। কিছু দিনের মধেই নিরাপত্তা আইনে আবার তাকে গ্রফতার করা হয়। তিনি বিভিন্ন সময়ে রাজশাহী, ঢাকা ও কোলকাতার জেলে আটক ছিলেন। ১৯৫৬ সালে তিনি আবার মুক্তি পান। ১৯৬২ সালে তিনি আবার গ্রেফতার হন। ১৯৬৪ সালে মুক্তি পান। এইভাবে তিনি ১৭ বছর জেল খেটেছেন শুধু গণমানুষের প্রকৃত মুক্তির জন্য।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তি যুদ্ধের সময়ে তিনি কোলকাতা চলে যান। সেখানে বাংলাদেশের মুক্তির জন্য তিনি সংগঠক ও উদ্দীপক হিসেবে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। কৃষক শ্রমিক ও মেহনতী মানুষের সার্বিক মুক্তির লড়াই সংগ্রামের জন্য, এই স্বাধীন বাংলাদেশেও তাকে জেলে থাকতে হয়েছে অথচ পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের অস্তিত্ব কোনোদিন মেনে নিতে পারেননি তিনি। আর তাই তো তার সেøাগান ছিল, ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়, লাখো ইনসান ভুখা হে।
১৯৭৩ সালে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের আমন্ত্রণে সেখানে যান। সেখান থেকে ফিরে এসে তিনি শ্রমিক ও মেহনতী মানুষের মুক্তির জন্য আরো জোড়ালোভাবে কাজে নেমে পড়েন।
১৯৯৩ সালে তিনি বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টি সিপিবি’র প্রেসিডিয়াম সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১২ সালে তিনি বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পাটি সিপিবি’র উপদেষ্টা মনোনীত হন এবং আমৃত্যু তিনি তা পালন করেন। একাধারে তিনি বাংলাদেশ রেল শ্রমিক ইউনিয়ন এবং বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি হিসেবে কাজ করে গেছেন। তিনি বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়নেরও কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা ছিলেন।
পারিবারিক জীবনে তিনি ছিলেন ৫ মেয়ে ও ১ ছেলের পিতা। আর তাদের পরিবারে ছেলে-মেয়েসহ প্রত্যেকেই ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা।
তিনি তার বক্ত্যবের বাণীতে বলেছিলেন, এই দেশর শ্রমিক, এই দেশের কৃষক, এই দেশের মধ্যবিত্ত, একবার এক জায়গায় হয়ে আসেন, আমরা এই পচা সমাজ, এই গলা সমাজ, এই লম্পটের সমাজ, এই লুচ্চার সমাজ, এই বেকারের সমাজকে, আর একবার ভাঙতে চাই। দুই বার ভেঙেছি আমরা, তৃতীয় বার ভাঙবো, এইখানে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবোই।
তিনি তার আরেকটি বানীতে বলেছিলেন, এই পার্টির নাম কমিউনিষ্ট পার্টি। ছোটো লোকের পার্টি, গরীব লোকের পার্টি, দাদ ওয়ালা, পা ফাটা লোকের পার্টি, ছোটো লোক, কুলি, কামার এদের পার্টি। তোমাকেও সেই পার্টি করতেই হইবে। অন্য কোনো পার্টি করে পৃথিবীতে কোনো শালা রেহাই পায়নি।
‘জীবনের রেলগাড়ী’ তার লেখা আত্ম-জীবনীমূলক বই। এই রেলগাড়ির মতোই বয়ে গেছে ৯৫ বছরের জীবনে, মানুষের জীবনকে জানতে ও মানুষের শোষণ মুক্তির সমাজ গড়ার কাজে। তিনি বলতেন আমার সমগ্র জীবন ব্যয় করেছি এই দুনিয়ার সবচেয়ে বড়ো আদর্শের জন্য। মানুষের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছি। মুক্তির কোনো সীমা নেই, সংগ্রামেরও কোনো সীমা নেই।
ছোট্ট জসিম একদিন তার মায়ের কাছে জানতে চাইলেন যে, তোমার কেন নতুন কাপড় নেই। আর তার মা তাকে বলেছিলেন, এমন কপাল শুধু ধনীদেরই হয়। গরীবদের জন্য এমন কপাল বানানো হয় না। বালক জসিম সেদিন মনে ব্যথা পেয়েছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন এ কেমন কপাল? যে বানায় সেই বা এমন কেন? এই কপাল আর কপাল বানানো ওয়ালা দুইজনই তার পছন্দ হয়নি। হয়ত তখনই প্রতিবাদের আগুন তার মধ্যে জ্বলে উঠেছিল ।
ত্রিকালদর্শী প্রবাদ প্রতীম এই নেতা, ব্রিটিশ রাজ খেদাও আন্দোলন, সামাজিক বৈষম্যের বিষয়ে লড়াই, মুক্তিযুদ্ধে অবদান, স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, রেল শ্রমিক তথা দেশের শ্রমিক আন্দোলনের প্রবাদ প্রতীম এই নেতাকে, এই পৃথিবীর মুক্তিকামি মানুষ সারা জীবন শ্রদ্ধায় স্মরণে রাখবে।
তার নিজের কোনো বাড়ি নেই। সরকারের বন্দোবস্ত নেওয়া একখ- জায়গায় তিনি বাস করতেন। তার বাড়ির পাশেই নিজ উদ্যোগে ১৯৯৬ সালে পশ্চিম টেংরী প্রাথমিক বিদ্যালয় নামে একটা বিদ্যালয় গড়ে তোলেন। যা পরবর্তিতে সরকারিকরণ হয়েছে। আমার দাবি এই স্কুলটি “কমরেড জসিম উদ্দিন মন্ডল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়” করা হোক।
ন্যায্যাতা, সচ্ছতা, পবিত্রতা, বিশুদ্ধতা, সুন্দরের প্রত্যাশা সবই ছিল তার মধ্যে। যোগাযোগ বন্ধন, ধৈর্য, ভার বহনের মানসিকতা, ক্লেশ বা দুঃখ সহ্য করার ক্ষমতা, নিজের শত অভাবের মধ্যেও অন্যের পাশে দাঁড়ানো, সর্বোপরি বিশুদ্ধ সমাজ বিনির্মানের চেতনা নিয়ে জীবনের ৯৫ টা বছর বিলিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলতেন কমিউনিষ্ট পার্টি গরীব মানুষের পার্টি, যারা উৎপাদন করে তাদের পার্টি, উৎপাদক মানুষগুলোই এই পৃথিবীর সত্যিকারের মালিক।
এই জীবনে তিনি অনেক গুণী মানুষের সান্নিধ্যে যেতে পেরেছিলেন। খুব কাছ থেকে যাদের দেখা পেয়েছেন তাদের মধ্যে, মহাত্মা গান্ধী, জহল্লাল নেহেরু, আবুল কালাম আজাদ, কমরেড আব্দুল হালিম, কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য, পিসি জোসি, ইলা মিত্র, জোতি বসু, কমরেড খোকা রায়, ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত, রনেশ দাস গুপ্ত, বীরেন দাস গুপ্ত, কমরেড ফরহাদ, আ. হক, কমরেড মুজাফফর আহমেদ, সত্যেন সেন, সহিদুল্লা কায়সার, নগেন দা, কমরেড অমূল্য লাহিড়ী, প্রীতিলতা, মনি সিংহ, কবি কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখ।
সেলিনা বানু, মাদার বক্স, মোক্তার আতাউর রহমান-সহ আরো অনেকেই তাকে জেলে থাকা অবস্থায় পারিবরিক সহযোগিতা করেছেন বলে জানা যায়। তার অসুস্থাবস্থায় যারা তার সুস্থতার বিষয়ে নিরলস শ্রম ও সেবা দিয়ে এসেছে তাদের মধ্যে, কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, কমরেড অনিরুদ্ধ দাশ অঞ্জন, কমরেড আবদুল্লাহ ক্বাফী রতন, অধ্যাপক ডা. ফজলুর রহমান, ডা. লেলিন চৌধুরী, কমরেড আব্দুর রাজ্জাক, কমরেড আহসান হাবিব, কমরেড জুয়েল হোসেন সোহাগ, কমরেড বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহ আলম-সহ বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টি সদস্য, শুভাকাঙ্ক্ষী ও পরিবারের সদস্যবৃন্দ।
তিনি বলেছেন, যারা এই সমাজের অবহেলিত মানুষের জন্য জীবন দিয়ে কাজ করে গেছেন তাদের মধ্যে, মাষ্টার দা সূর্যসেন, ক্ষুদিরাম, রানী মা ইলা মিত্র, সত্যেন দা, রনেশ দা, তাজুল, হাতেম আলী খান, জ্ঞান চক্রবর্তী, খোকা রায়, রবি নিয়োগী, জিতেন ঘোষ, মুকুল সেন, নলীনি দাস, বারীন দত্ত, অনঙ্গ সেন, রতন সেন, মনি সিংহ, অনিল মুখার্জি, নেপাল নাগ, জোৎনা নিয়োগী, হেনা দাস, প্রীতিলতা ,কল্পনা দত্ত, নীলা নাগ, জোৎনা নিয়োগী, অনিমা সিং, আশু ভরদ্দাজ, প্রশাদ রায়, রহমান মাষ্টার, সোমনাথ লাহেড়ী, ব্যারিস্টার লথিপ, রমেন মিত্র, ভবানী সেন, কমরেড সাহাবুদ্দীন, রহমান মিস্ত্রী, গোলাপ, মজিবর রহমান বিশ্বাস (ভবঘুরে মজিবর), বারীন দত্ত ,অমল সেন, শিবেন রায়, বিনয় দা, মুনসুর, হাবিব, পাঁচকড়ি, কমরেড আমিনুল ইসলাম বাদশা, রনেশ মৈত্র, নলীনি দাস, মনোরমা বসু মাসীমা, হাতেম আলি খান, বিষ্ণু চক্রবর্তী, শেখ মহম্মদ শহিদুল্লা, সরদার ফজলুল করিম, রবি নিয়োগী, গুরুদাশ তালুকদার, কামাক্ষ্যা রায় চৌধুরী, অচিন্ত বিশ্বাস, মওলানা ভাসানী-সহ আরো অনেকেই আছেন যারা শ্রেণী চেতনার ঊর্দ্ধে, গণমানুষের মুক্তির আন্দোলনের জন্য নিজেদেরকে উৎসর্গ করে ছিলেন, তাদেকে স্মরণ করা ও তাদের চেতনা ধারণ করা আমাদের কর্তব্য।
তিনি জেলখানাতেও চুপ ছিলেন না। বন্দীদের ভালো থাকার জন্য, ভালো খাবারের জন্য, ঘানি ঘোরানো বন্ধ করার জন্য, কারণে-অকারণে শাস্তির বিধান পাল্টানোর জন্য, বন্দিদের জন্য ফ্যামিলি ভাতা চালুসহ অনান্য সুবিধা দেওয়ার জন্য আন্দোলন করে কঠিন শাস্তি পেয়েছেন কিন্তু পিছপা হননি। মাত্র ৬ষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত লেখা পড়া জানা একজন মানুষ, স্ব শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে মার্কসবাদের আলোকে পৃথিবী জয় করেছেন। তিনি বলতেন, গ্রামের আমতলায়, বাঁশতলায়, কাঁঠাল তলায়, হাটে, ঘাটে, মাঠে, গ্রামের মানুষের কাছে, তাদের প্রকৃত মুক্তির বার্তা পৌঁছে দিয়ে, সংগ্রামের মধ্য দিয়ে, তাদের অধিকার তাদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় নিজের জীবন উৎসর্গ করেছি। পেতে নয়, দিতে চাই। ব্রিটিশ দেখলাম, সাধের পাকিস্তান দেখলাম, বাংলাদেশ দেখলাম, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকার দেখলাম। সবাই তো একই, শুধু খোলসটা আলাদা। কোনো পরিবর্তন নেই তাদের মধ্যে। আমার স্বপ্ন সমাজতন্ত্র, আর সমাজতন্ত্র হবেই। তার এই স্বপ্নকে সারা পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষদের মধ্যে চেতনায় রেখে, ২০১৭ সালের ২ রা অক্টোবর, ঢাকার এক হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যগ করেছেন। পরবর্তিতে তাকে ঈশ্বরদী কেন্দ্রীয় গোরস্থানে রাষ্ট্রীয় ও দলীয় সম্মান শেষে সমাহিত করা হয়। আমরা তার জীবনের কর্মকাণ্ডকে সারা জীবন শ্রদ্ধাচিত্তে স্মরণ করবো। আমি সশ্রদ্ধ চিত্তে তাকে সেলুট করি। লাল সালাম কমরেড। লাল সালাম।
