ভোর হতেই শোনা যেত ঢেঁকির ধাপুর ধুপুর শব্দ আর গান। সুখ দুঃখের গল্পের সাথে অন্তরের কথা সুতায় গেঁথে গান বলত আর ঢেঁকিতে পাড় দিত গ্রাম-বাংলার নারীরা। যান্ত্রিকতার ভিড়ে সেই চিরচেনা সুরের সাথে মন চঞ্চল করা সেই গান আজ শুনতে পাওয়া ভার।মাটি দিয়ে উঁচু ভিটা তৈরি করে দুই পাশে দুইটা বাঁশ পুঁতে বাঁশ দুইটার মাথার ওপর আর একটা বাঁশ রাখা হয় তার ওপর হাত রাখার জন্য। মাটির ভিটা সই করে সামনের দিকে গাব, তাল, কুল জাতীয় গাছের কাঠ দিয়ে সোজা দন্ড তৈরি করে পেছনের অংশ চ্যাপ্টা সামনের অংশ তিনকোণা করে তার নীচে সুরের মতো করে তৈরি। যাকে বলা হয় আংতা বা মুষল। মুষল পড়ে গড়ের ওপর। মাটিতে গর্ত করে ইট, বালু, সিমেন্ট দিয়ে গড় তৈরি করা হয়। গড়ের মধ্যে ধান, চাল বা শস্য দিয়ে ভিটার ওপর দাঁড়িয়ে এক পা দিয়ে ঢেঁকি উঁচু করে ঢেঁকিতে পাড় দেওয়া হয়। ঢেঁকির ওপরে কাপড়ের ছাউনি দিলেই তৈরি হয়ে গেলো ঢেঁকিশালা। শোবার ঘর আধ-ভাঙা হলেও ঢেঁকিশালা খুব পরিপাটি করে তৈরি করত গ্রাম-বাংলার নারীরা।
তাদের এই পরিপাটি কাজ দেখে প্রবাদও প্রচলন আছে-‘আসল ঘরে মুসল নাই ঢেঁকিশালা চাঁদোয়া’, ‘ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে”। অন্তর্জ¡ালা বুঝাতে বলা হয়, বুকে ঢেঁকির পাড় পড়া। সভ্যতার ক্রমান্বয়ে এখন আর ঢেঁকি দেখাই যায় না। এমনকি যে এলাকায় বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি সেই এলাকায়ও ঢেঁকি শিল্প বিলুপ্তপ্রায়। এক সময় দেশের বিভিন্ন জেলায় ঢেঁকি দেখা যেত। গ্রামে প্রায় সব বাড়িতেই ঢেঁকি দেখা যেত। অভাবগ্রস্ত নারীরা জীবিকার তাগিদে ঢেঁকিতে পাড় দিয়ে অর্থ রোজগার করত। মাঝ রাত থেকে সকাল পর্যন্ত ঢেঁকিতে পাড় দিত। ভোর বেলায় গ্রামের মানুষের ঘুম ভাঙত ঢেঁকির ক্যাচ ক্যাচ শব্দে। গ্রামের বিত্তবানরা ঐতিহ্য হিসাবে তাদের বাড়িতে ঢেঁকি রাখত। নতুন ধান উঠার পর ধান থেকে চাল, চিড়া বা চালের গুঁড়া তৈরি করতে গ্রামের অভাবগ্রস্ত নারীরা বিত্তবানদের বাড়িতে ঢেঁকি পাড় দিয়ে সের প্রতি টাকা পেত। আর শীত আসলে তো কথাই নেই। যেন চালের গুঁড়া করার ধুম লেগেছে। দুই জন নারী ঢেঁকিতে পাড়দিত একজন এলে দিত। এলে দেওয়া বলতে যখন ঢেঁকির আংতা গড়ের মধ্যে পরে তখন চালের গুঁড়াতে চাপ লেগে চাল ভাঙতে শুরু করে। তারপর ঢেঁকি উঁচু করে করে মাঝে মাঝে হাত দিয়ে নাড়াচাড়া করতে হয়। এই নাড়াচাড়া করাকে এলে দেওয়া বুঝায়।
আর একজন সেই চালের গুঁড়া ছাকনি নিয়ে ছাকে। চারজন নারী ঢেঁকিতে কাজ করে। চাল গুঁড়া হয়ে যাবার পর সেই চালের গুঁড়া দিয়ে পিঠা, পায়েস, ফিরনিসহ শীতের হরেক রকমের মজার পিঠা তৈরি করত। পিঠা আর পায়েসের সেই মনভোলানো সুঘ্রাণ পড়শি বাড়ি চলে যেত। বিকেল হলে ঢেঁকিশালায় বধূদের মেলা বসত। একে অন্যকে ঢেঁকিপাড় দিয়ে সহযোগিতা করত। এতে করে পাড়াপড়শিদের মধ্য সুসম্পর্কও ছিল। একজনের অভাব আর একজন দেখত। অন্যর ঢেঁকিতে ধান ভেনে চিড়াকুটে বা চালের গুঁড়া করে দিয়ে অভাব পূরণ করার পথ ছিল। শুধু অভাব পূরণ না ঢেঁকি ছাটা চালের গুঁড়া চিকিৎসা বিজ্ঞানেও বলে শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। ঢেঁকি ছাটা চালকে বলে ব্রাউন রাইস। ব্রাউন রাইসে আছে স্টার্চ ও ফাইবার। যা ভিটামিন বি, ভিটামিন ই ম্যাঙ্গানিজ ও সেলেনিয়াম সমৃদ্ধ। কিন্তু যুগের আধুনিকায়নে যন্ত্রের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে ঢেঁকি শিল্প। মেশিনেই ধান ভানা সহ চালের গুঁড়া করা হয়। গ্রামের অভাবগ্রস্ত নারীরা এখন ঢেঁকিতে কাজের চাহিদা না থাকায় অন্যর বাড়ি কাজ করে কেউ-বা অভাবের সাথেই দিন কাটায়। প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চলেও কয়েক গ্রাম ঘুরে ঢেঁকি শিল্পের দেখা পাওয়া ভার।
যন্ত্রবিপ্লবের যুগে নিজেরাই হারাতে বসেছি সেই প্রাচীন ঐতিহ্য ঢেঁকি। কয়েক গ্রাম ঘুরেও শুনতে পাওয়া যায় না ঢেঁকির ঢেঁক ঢেঁকানি শব্দ। জনসচেতনতা সৃষ্টি না করলে আমাদের কাছ থেকে একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যাবে ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকিশিল্প।
সাবিত্রী সাহা : শিক্ষক ।