জাহানারা ইমাম
‘একাত্তরের দিনগুলি’ গ্রন্থটি জাহানারা ইমাম (৩ মে ১৯২৯-২৬ জুন ১৯৯৪) রচিত দিনলিপি। এটি প্রাত্যহিক জীবনের সহজ-সরল ভাষায় রচিত। বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন ১৯৭১ স্বাধীনতার সময়কালের ইতিহাস এ দিনলিপির মূল বিষয়বস্তু। দিনলিপিটি বই আকারে প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮৬ সালের ফেব্রæয়ারিতে।
একটি পারিবারিক ঘটনা পরিক্রমার মধ্য দিয়ে দিনলিপিটি শুরু হয় এবং ধীরে ধীরে তা প্রবেশ করে ইতিহাসের আলোকোজ্জ্বল পরিক্রমায়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ঢাকা শহরের অবস্থা ও গেরিলা তৎপরতার বাস্তব চিত্র এতে উঠে এসেছে। বইটিতে তাঁর সন্তান রুমী অন্যতম প্রধান চরিত্র হিসেবে দেখা দেয়।
পহেলা মার্চ, ১৯৭১ থেকেই দিনলিপিটির শুরু। শুরুর বাক্যে আমরা যাঁকে পাই-রুমী এরপর পুরো গ্রন্থেই রুমী জীবন্ত থাকেন, যেমন আছেন এখনও এবং থাকবেন অনন্তকাল।
জাহানারা ইমাম ছিলেন একাধারে লেখিকা, কথাসাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ এবং একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নেত্রী। একাত্তরে তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র শফি ইমাম রুমী দেশের মুক্তিসংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেফতার ও নির্যাতনে শহিদ হন। বিজয় লাভের পর রুমীর বন্ধুরা রুমীর মা জাহানারা ইমামকে সকল মুক্তিযোদ্ধার মা হিসেবে বরণ করে নেন।
‘একাত্তরের দিনগুলি’ আমাদের পথপ্রদর্শক, আমাদের অনুপ্রেরণার অখÐ আকাশ।
Ñবিভাগীয় সম্পাদক
৬ মার্চ শনিবার
ছ’টাÑদুটো হরতাল চলছেই।
শরীফ আর রুমী আজ সকালে হাঁটতে হাঁটতে বøাড ব্যাঙ্কে গিয়ে রক্ত দিয়ে এল।
আমি আর জামী বাদ গেলাম যথাক্রমে অ্যানিমিক ও ছোট বলে।
গতকালকার আলোচনার পর থেকে কিটি কেমন যেন চুপ মেরে গেছে।
শরীফরাও রক্ত দিতে যাবার আগে, সে যেরকম মুখ করে ওদের দিকে তাকিয়েছিল, তাতে মনে হল, সেও বোধ হয় রক্ত দিতে যেতে চাইছে। কিন্তু কপাল ভালো, শেষ পর্যন্ত কিটি মুখ খুলল না।
আমার বেশ খারাপ লাগছে কিটির কথা ভেবে। এখানে আসার দিন পনের পর থেকেই ও আমাকে আম্মা বলা শুরু করেছে। মাস দেড়েক পর থেকে শরীফকেও আব্বা বলছে। ও আমাদের পরিবারে মিশে যেতে চায়, সব ব্যাপারে অংশ নিতে চায়। কিন্তু ওর সোনালি চুল, নীল চোখ রাস্তায় লোকজনের মুখে ভ্রƒকুটি এনে দেয়। পাড়ার লোকেরাও এখন আর ভালো চোখে দেখে না ওকে। বাসায় মেহমান এসেও ওকে দেখে কেমন যেন অস্বস্তিতে পড়ে যায়। আমরা যখন সকলে মিলে গলা ফাটিয়ে তর্ক, আলাপ-আলোচনায় মেতে উঠি, তখন কিটি এসে দাঁড়ালে আমরা থমকে যাই। মাতৃভাষায় যত কথা কলকল করে বলতে পারি, ইংরেজিতে তত ফ্লো আসে না। ফলে আলাপ হোঁচট খায়। তাতে ও সন্দেহ করে ওকে দেখে আমরা কথা চাপাচ্ছি! আমরা বাংলায় আলাপ চালিয়ে রাখলে সব কথা বুঝতে পারে না। তখন উল্টো মাইন্ড করে। ভারি এক ফাটা বাঁশের মধ্যে পড়েছি যেন!
আজ দুপুর একটা পাঁচ মিনিটে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। শরীফ সাড়ে বারোটার মধ্যে গোসল সেরে রেডিÑপ্রেসিডেন্ট কি বলেন, তা শোনার জন্য সকলেই চনমন করছি। এক তারিখের ঘোষণায় তো লঙ্কাকাÐ বেঁধে গেছে, এখন আবার কি বলেন, তা নিয়ে আমাদের মধ্যে জল্পনা-কল্পনার অন্ত নেই। আগামীকাল রেসকোর্সে গণজমায়েতে শেখ কি বলবেন, তা নিয়েও লোকজনের জল্পনা-কল্পনার অবধি নেই। এক তারিখে হোটেল পূর্বাণীতে তিনি বলেছিলেন, বাংলার মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার অর্জনের কর্মসূচী ঘোষণা তিনি সাত তারিখে দেবেন। কিন্তু এ ক’দিনে ঘটনা তো অন্য খাতে বইছে। এত মিছিল, মিটিং, প্রতিবাদ, কারফিউ ভঙ্গ, গুলিতে শয়ে শয়ে লোক নিহতÑএর প্রেক্ষিতে শেখ আগামীকাল কি ঘোষণা দেবেন? কেউ বলছে, উনি আগামীকাল স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন। কেউ বলছে, দূর তা কি করে হবে? উনি নির্বাচনে জিতে গণপ্রতিনিধি, মেজরিটি পার্টির লিডার, উনি দাবির জোরে সরকার গঠন করবেন, স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করবেন। এখন স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে সেটা তো রাষ্ট্রদ্রোহিতার পর্যায়ে পড়বে। কেউ বলছে, আগামীকালের মিটিংয়ের ব্যাপারে ভয় পেয়ে ইয়াহিয়া আজ ভাষণ দিচ্ছে।
ভাষণ শুনে সবাই ক্ষুদ্ধ এবং উত্তেজিত। আমি হেসে শরীফকে বললাম, ‘তুমি কি আশা করেছিলে? ইয়াহিয়া ‘এসো বধূ আধ-আঁচরে বসো’ বলে মুজিবকে ডেকে সরকার গঠন করতে বলবে?’
‘না, অতটা আশা না করলেও ওরকম কর্কশ গলার ধমক-ধামকও আশা করিনি। যতো দোষ নন্দঘোষ বলে উনি যেভাবে আমাদের গালাগালি করলেন, সেটা মোটেই আমাদের পাপ্য নয়। বর্তমান পরিস্থিতির জন্য উনিই তো দায়ী।’
‘যাই বলো, ভয় পেয়েছে কিন্তু। দেখলে না ২৫ মার্চ অধিবেশন বসার ঘোষণা দিল?’ রুমী চটা গলায় বলে উঠল আর সামরিক বাহিনী দিয়ে আমাদের শায়েস্তা করার হুমকি দিল যে? সেটা কি?’
এইসব কচাকচি করতে করতে দুপুরের খাওয়া শেষ হল। শরীফ ও রুমীকে বাইরে যাবার জন্য তৈরি হতে দেখে বললাম,
‘কোথায় যাচ্ছ?’
‘অফিসে।’
‘অফিসে? আজ না শনিবার, হাফ?’
রুমী হেসে উঠে বলল, ‘আম্মা ভুলে গেছ, এখন না বিকেলে অফিস-কাচারি চলছে?’
আমি বিমূঢ় হয়ে বললাম, ‘তাতে কি? হাফের দিন হাফ থাকবে না?’
‘নিশ্চয় থাকবে। হাফ ছুটিটা সকালেই হয়ে গেছে, এখন হাফ অফিস। দেখছ না, এখন উলট-পুরাণের যুগ চলছে।’
‘তাই বটে। কিন্তু তুই কোথায় যাচ্ছিস?’
‘আমি? আমিও অফিসে যাচ্ছি। ও আম্মা, তুমি কি ভুলে গেছ আমি আব্বুর অফিসে ড্রয়িং করতে যাই? তাছাড়া এখন যে বেবী চাচার সঙ্গে কাজ করি?’
ভুলেই গেছিলাম বটে! রুমী গত বছর আই.এস.সি পরীক্ষা দেবার পর থেকে শরীফের অফিসে টুকটাক ড্রয়িংয়ের কাজ করে। রেজাল্ট বেরোবার পর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হয়েছে গত বছর অক্টোবর; কিন্তু তখনই কলেজ থেকে বলে দেওয়া হয়েছিল ক্লাস শুরু হবে একাত্তরের মার্চ থেকে। তাই বসে না থেকে শরীফের অফিসের কাজটা চালিয়ে যাচ্ছে। সেটাও তার সব সময় করতে ভালো লাগে না। তাই বিভাগীয় প্রধানের বিশেষ অনুমতি নিয়ে সে বিশ^বিদ্যালয়ে ইকনমিকস বিভাগে ক্লাসও করে। এখন তো মার্চে এই তোলপাড় ব্যাপার। পড়াশোনা এতদিন শিকেয় তোলা ছিল, এবার টংয়ে উঠল।
বাংলা একাডেমিতে আজ শিল্পীদের জরুরী সভা আড়াইটেয়। যদিও আমি শিল্পী বা সাহিত্যিক নই, কিন্তু ঢাকায় সেই ১৯৪৯ সাল থেকে আছি বলে বেশির ভাগ শিল্পী-সাহিত্যিকদের সঙ্গেই ব্যক্তিগত পরিচয় ও আলাপ আছে তাই শিল্প ও সাহিত্য-বিষয়ক সভা, সমিতি, সেমিনার, আন্দোলন ইত্যাদিতে দর্শক ও পর্যবেক্ষকের ভ‚মিকায় সব সময়ই গিয়ে থাকি।
কিন্তু আজও বাধা পড়ল। বাবাকে ওঠানোর ভার জামীর ওপর দিয়ে তিনটের দিকে বেরোব ভেবেছিলাম। কিন্তু বাবা হঠাৎ পৌনে তিনটেয় জেগে ডাক দিলেন, ‘মাগো, একটু শোন তো।’
কি ব্যাপার?
‘মনে হচ্ছে খাটটা দুলছে।’
বুজলাম। বøাড প্রেসার বেড়েছে। বøাড প্রেসার বাড়লেই ওর মনে হয় খাট, দেয়াল, ছাদ সব দুলছে। রুমীর ওপর রাগ হল। কাল রাতে রুমী অনেকক্ষণ ধরে বাবাকে দেশের পরিস্থিতি বুঝিয়েছে। অন্ধ মানুষ, বয়স প্রায় নব্বই, হাই বøাড প্রেসারের জন্য সব সময় ধরে ধরে সব করাতে হয়। তাঁর ওপর সামান্য মানসিক চাঞ্চল্য হলেই আর রক্ষা নেই। প্রেসার একেবারে দশতলায় উঠে বসে থাকে। তাকে বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের এই মরণপণ আন্দোলনের সাতকাহন না শোনালেই নয়? প্রতিবেশী ডাক্তার, এ. কে. খানও নেই ঢাকায় রাজশাহীতে পোস্টেড। তার অবর্তমানে কখনো ডা. নুরুল ইসলাম, কখনো ডা. রব দেখেন বাবাকে। কিন্তু এখন ওঁদের বিশ্রামের সময়। পাঁচটার আগে ডাকা ঠিক হবে না। তাই ফোন করে শরীফকেই তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে আসতে বললাম।
পাঁচটার পর ডা. নুরুল ইসলামকে ফোন করলাম। উনি বাড়ি নেই। সৌভাগ্যবশত ডা. রবকে পেয়ে গেলাম। উনি বললেন, ‘এখন তো ভাই আমার গাড়িটা নেই। রুমীকে পাঠিয়ে দিতে পারেন আমাকে নিয়ে যাবার জন্য?’
অতীতে রুমী বহুবার ওঁকে গাড়ি করে নিয়ে এসেছে।
রুমীকে গাড়ি নিয়ে যাবার জন্য বলতেই সে বলল, এখন তো রাস্তায় গাড়ি নেয়া যাবে না। এখন যে ওই রাস্তা দিয়ে মিছিল যাবে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি।
তাইতো। ডাঃ রবের বাড়ি মিরপুরের মেইন রোডের ওপর। গত কদিন ধরে রোজই সন্ধ্যায় সব মিছিল ওই রাস্তা দিয়ে গিয়ে শেষ হয় বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনে।
৭ মার্চ রবিবার ১৯৭১
আজ বিকেলে রমনা রেসের মাঠে গণজমায়েত। গত কদিন থেকে শহরের সবখানে, সবার মধ্যে এই জনসভা নিয়ে তুমুল জল্পনা-কল্পনা, বাকবিতÐা, তর্ক-বিতর্ক। সবাই উত্তেজনায়, আগ্রহে, উৎকণ্ঠায়, আশঙ্কায় টগবগ করছে। আমি যদিও মিটিংয়ে যাব না, বাসায় বসে রেডিওতে বক্তৃতার রিলে শুনব, তবু আমাকেও এই উত্তেজনার জ¦রে ধরেছে।
এর মধ্যে সুবহান আমাকে জ¦ালিয়ে মারল। আজ তাড়াতাড়ি রান্না সারতে বলেছিলাম। শরীফ বলেছে বারোটার মধ্যে খাওয়া সেরে একটু বিশ্রাম নেবে। ঠিক দেড়টাতে রওনা দেবে, নইলে কাছাকাছি দাঁড়াবারও জায়গা পাবে না। আর সুবহান হতচ্ছাড়াটা এগারোটার সময় গোশত পুড়িয়ে ফেলল। বারেককে দিয়েছিলাম রুমী জামীদের সার্ট ইস্ত্রি করতে। সুবহান চুলোয় গোশত রেখে বারেকের সঙ্গে ইস্ত্রি করাতে মেতেছে। তিনিও আজ শেখের বক্তৃতা শুনতে যাবেন, তাই তাঁর নিজের প্যান্ট সার্ট ইস্ত্রি তদারকিতে যখন মগ্ন, তখন গোশত গেছে পুড়ে। কি যে করি ওকে নিয়ে। তাড়াতাড়ি ডিমের অমলেট করে ডাল-ভাজিসহ ভাত দিলাম শরীফদের।
এতবড় কাÐ করে, এত বকা খেয়েও সুবহানের কোনো ভ্রƒক্ষেপ নেই। রান্নাঘরে সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখে প্যান্ট-সার্ট পরে তিনি শরীফদের সঙ্গে চললেন শেখের বক্তৃতা শুনতে।
আজ বারেকও গেছে ওদের সঙ্গে। এর আগে কোনো মিটিংয়ে যেতে দিইনি ওকে। আজকে না দিলে বড় অন্যায় হবে।
কিটির ঘরে গিয়ে ওর বারো ব্যান্ডের দামী রেডিওটা চেয়ে নিয়ে উপরে গেলাম। ওকে আসতে বললাম আমার ঘরে। বাবা দুপুরের খাওয়ার পরে শুয়ে ঘুমাচ্ছেন। আমি রেডিওটা নিয়ে আয়েশ করে বিছানায় শুলাম। একটু পরে কিটিও এল। রেডিও অন করে রেখেই দু’জনে শুয়ে শুয়ে গল্প করতে লাগলাম।
রেডিওতে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটা শোনা গেল। আমরা কথা বন্ধ করে উৎকর্ণ হয়ে রইলাম। ওমা! তারপর আর শব্দ নেই। কি ব্যাপার? শব্দ নেই তো নেই-ই। কারেন্ট গেল? বাতির সুইচ টিপে দেখলাম কারেন্ট আছে। রেডিওটা খারাপ হল? নব ঘুড়িয়ে দেখলাম অন্য স্টেশন ধরছে। তাহলে?
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললাম, ‘চল ছাদে যাই তো।’
দু’জনে ছাদে গেলাম। পুবদিকে সোজাসুজি মাপলে মাত্র আধ মাইল দূরে রেসের ময়দান। নানা রকম শ্লোগানের অস্পষ্ট আওয়াজ আসছে। আকাশে চক্কর দিচ্ছে হেলিকপ্টার। হেলিকপ্টার কেন? কি ব্যাপার?
ব্যাপার সব জানা গেল শরীফরা মিটিং থেকে ফেরার পর।
কলিং বেলের শব্দ শুনে ছুটে গিয়ে দরজা খুুলতেই রুমী দুই হাত তুলে নাটকীয় ভঙ্গিতে ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বলতে বলতে ঘরে ঢুকল। দেখি, ফখরুদ্দিনও এসেছেন। ফখরুদ্দিনÑসংক্ষেপে ফকির, শরীফের স্কুল জীবনের বন্ধু। তার পেশা ব্যবসা আর নেশা রাজনীতি, যদিও কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য তিনি নন। তবে রাজনৈতিক অঙ্গনের খবরাখবরে তার চেয়ে ওয়াকিবহাল আমাদের জানার মধ্যে আর নেই।
সোফায় ধপ করে বসে পড়ে ফকির বললেন, ‘ভাবী, চা খাওয়ান। এক সঙ্গে তিন কাপÑগলা শুকিয়ে কাঠ।’
‘চেহারাও তো শুকিয়ে কাঠ। কি করে বেড়ান আজকাল? খান না নাকি?’
শরীফ মুচকি হেসে বলল, ‘নেতাদের লেজ ধরে দৌড়োদৌড়ির চোটে ওর নাওয়া-খাওয়ার ফুসরত নেই। সুযোগ পেয়েই শরীফ ফকিরের পেছনে লাগে। আমি সুবহানকে চায়ের হুকুম দিয়ে সোফায় বসলাম, ‘ওসব লেগ-পুলিং এখন রাখ। মিটিংয়ের কথা বল। রেডিও বন্ধ হয়ে রয়েছে কেন? আকাশে হেলিকপ্টার দেখলাম যেন।’
রুমী বলল, ‘হেলিকপ্টার তো পয়লা তারিখের পল্টন জনসভাতেও ছিল। ওরা বোধহয় গার্ড অব অনার দেওয়ার রেওয়াজ করেছে।’
সবাই হেসে উঠল। কিটি রেডিও হাতে গুটিগুটি এসে দাঁড়ালো, মৃদুকণ্ঠে বলল, ‘রেডিও এখনো চুপ।’
আমি বললাম, ‘কিটি, এখানে এসে বস। আজ তোমার বাংলা বোঝার পরীক্ষা নেব। এখানে বসে আমাদের বাংলায় কথাবার্তা শোন, তারপর পুরোটা বলতে হবে। রেডিওটা খোলাই থাক।’
কিটি হেসে সহজ হল, সোফায় এসে বসল। আমরা বাঁচলামÑ এখন কলকল করে মাতৃভাষায় আলাপ না করলে প্রাণে শান্তি হবে না।
রেসকোর্স মাঠের জনসভায় লোক হয়েছিল প্রায় তিরিশ লাখের মতো। কত দূর-দূরান্তর থেকে যে লোক এসেছিল মিছিল করে লাঠি আর রড ঘারে করেÑতার আর লেখাজোখা নেই। টঙ্গী, জয়দেবপুর, ডেমরাÑএসব জায়গা থেকে তো বটেই, চব্বিশ ঘণ্টার পায়ে হাঁটা পথ পেরিয়ে ঘোড়াশাল থেকেও বিরাট মিছিল এসেছিল গামছায় চিড়ে-গুড় বেঁধে। অন্ধ ছেলেদের মিছিল করে মিটিংয়ে যাওয়ার কথা শুনে হতবাক হয়ে গেলাম। বহু মহিলা, ছাত্রী মিছিল করে মাঠে গিয়েছিল শেখের বক্তৃতা শুনতে।
‘কিন্তু শেখ নিরাশ করেছেন সবাইকে।’ রুমীর একথায় সবচেয়ে প্রতিবাদ করে উঠলেন ফকির, ‘তোমার মাথা গরম, চ্যাংড়া ছেলেরা কি যে বল নাÑভেবেচিন্তেÑশেখ যা করেছেন, একদম ঠিক করেছেন।’
সেটি পুরনো বাকবিতÐাÑযা গত কয়েকদিন ধরে সর্বত্রই শুনছি। একদল চায় শেখ স্বাধীনতার ঘোষণা দিনÑআরেক দল বলছে তাহলে সেটা রাষ্ট্রদ্রোহিতা হবে। বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হবে।
রুমী তার স্বভাবসিদ্ধ মৃদু গলাতেই দৃঢ়তা এনে প্রতিবাদ করল, ‘আপনারা দেয়ালের লিখন পড়তে অপারগ। দেখেননি আজ মিটিংয়ে কত লাখ লোক স্বাধীন বাংলার পতাকা হাতে নিয়ে এসেছিল? জনগন এখন স্বাধীনতাই চায়, এটা তাদের প্রাণের কথা। নইলে মাত্র এই ছদিনের কর্মকাÐের মধ্যে সবাই সবখানে স্বাধীন বাংলার ঐ রকম ম্যাপ লাগানো পতাকা সেলাই করার মত একটা জটিল কাজ, অন্যসব কাজ ফেলে করে সেটা আবার বাতাসে নাড়াতে নাড়াতে প্রকাশ্য দিবালোকে মিছিল করে যায়?’
তর্কের গন্ধ পেলে তর্কবাগীশ ফকির সর্বদাই চাঙ্গা, তিনি বললেন, ‘তুমিও দেখছি চার খলিফার দলের।’
রুমী বলল, ‘আমি কোনো দলভুক্ত নই, কোনো রাজনৈতিক দলের ¯েøাগান বয়ে বেড়াই না। কিন্তু আমি সাধারণ বুদ্ধিসম্পন্ন, মান-অপমান জ্ঞানসম্পন্ন একজন সচেতন মানুষ। আমার মনে হচ্ছে শেখ আজ অনায়াসে ঢাকা দখল করার মস্ত সুযোগ হারালেন।’
আমি বাধা দিয়ে বলে উঠলাম, ‘এই সুদূরপ্রসারী তর্ক শুরু করার আগে আমি তোমাদের কাছ থেকে শুনতে চাই ছোট্ট একটা খবর। শেখের বক্তৃতা রিলে করা হবে বলে সারা দিন রেডিওতে অ্যানাউন্স করেও শেষ পর্যন্ত রিলে করা হল না কেন? কেনই বা রেডিও একদম ডেডস্টপ? এইটে শোনার পর আমি রান্না ঘরে যাব। তখন তোমরা মনের সুখে সারারাত কচকচ কোরো।’
‘শেখের বক্তৃতা রিলে করার জন্য বেতার-কর্মীরা তো তৈরিই ছিল। শেষ মুহূর্তে মার্শাল ল অথরিটি বক্তৃতা রিলে করতে দিল না। ব্যস, অমনি রেডিও স্টেশনের সমস্ত কর্মীরা হাত গুটিয়ে বসল। শেখের বক্তৃতা রিলে করতে না দিলে অন্য কোনো প্রোগ্রামই যাবে না। তাই রেডিও এরকম চুপ।’
জামী এতক্ষণ একটাও কথা বলেনি, এখন হঠাৎ বলে উঠল, ‘জান মা, আজ বিকেলের প্লেনে টিক্কা খান ঢাকায় এসেছে গভর্নর হিসাবে।’
এক সপ্তাহ, দুইবার গভর্নর বদল। এক তারিখে ভাইস এডমিরাল এস.এম. আহসানকে বদলে লেফটেন্যান্ট জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খানকে দেওয়া হয়েছিল, এখন আবার ছ’দিনের মাথায় তাকে সরিয়ে লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানকে আনা হল। কি এর আলামত?
আজ রাতে রেডিও আর গলাই খুলল না।
৮ মার্চ সোমবার ১৯৭১
গতকাল সন্ধ্যার পর রেডিও স্টেশনের লনে কারা যেন বোমা ছুঁড়েছে।
কাল রাতে রেডিও বন্ধ থাকার পর আজ সকাল থেকে আবার চালু হয়েছে। সকাল সাড়ে আটটায় শেখ মুজিবের বক্তৃতা প্রচারিত হল।
শরিফের খালাতো ভাই আনোয়ার সকালে ফোন করে জানাল, গত পরশু তার মেজ মেয়ে ইমন আগুনে পুড়ে গেছে। তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তিনতলা নিউ কেবিনে রাখা হয়েছে।
বিকেলে মেডিক্যালে গেলাম ইমনকে দেখতে। কপাল ভালো খুব বেশি পোড়েনি। মুখটা বেঁচে গেছে। কেবিনে টুনটুনি আপা, ছবি আপা, ডলি আপার খালা এবং আরো অনেকের সঙ্গে দেখা হল। এরা সবাই ইমনকে দেখতে এসেছেন। কিন্তু ইমনের প্রতি মিনিট পাঁচেক মনোযোগ দেয়ার পরই সবাই মশগুল হয়ে গেলেন শেখের গতকালের বক্তৃতার আলোচনায়। তবে রক্ষা, এঁরা কেউ স্বাধীনতা-স্বাধিকারের তর্কের দিকে গেলেন না। এঁরা লোকমুখে এবং রেডিওতে শোনা বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠে উচ্চারিত বক্তৃতা লোকজনকে কি রকম সম্মোহিত এবং উদ্বুদ্ধ করেছেÑসে কথাই বলে গেলেন।
আজ আশুরা। হোসেনী দালান থেকে মহরমের মিছিল বেরিয়ে এতক্ষণে আজিমপুর গোরস্থানের রাস্তায় গিয়ে উঠেছে মনে হয়। আজিমপুর কলোনির এক নম্বর বিল্ডিংয়ের সামনের রাস্তা দিয়ে মহরমের মিছিল গোরস্থানে যায়, এই রাস্তার ওপরই মহরমের মেলা বসে। প্রতি বছর আমরা মেলাই যাই বাচ্চাদের নিয়ে। বাচ্চারা তাদের মনোমত খেলনা কেনে, আমরা বঁটি, দা, বেলনুপিঁড়ি ইত্যাদি গেরস্থালির জিনিস কিনি।
কিন্তু এ বছর ছেলেদেরও মিছিল বা মেলা দেখতে যাওয়ার ইচ্ছে নেই, আমাদের তো নেই-ই। গত এক সপ্তাহ ধরে বাংলার ঘরে ঘরেই কারবালার ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। কত মা ফাতেমার বুকের মানিক, কত বিবি সখিনার নওজোয়ান স্বামী পথে-প্রান্তরে গুলি খেয়ে ঢলে পড়ছেÑবাংলার ঘরে ঘরে এখন প্রতিদিনই আশুরার হাহাকার, মর্সিয়ার মাতম। কিন্তু কবি যে বলেছেন, ‘ত্যাগ চাই, মর্সিয়া, ক্রন্দন চাহি না’, তাই বুঝি বাংলার দুর্দান্ত দামাল ছেলেরা ‘ত্যাগ চাই’ বলে ঘরের নিশ্চিন্ত আরাম ছেড়ে পথে-প্রান্তরে বেরিয়ে পড়েছে। গত সন্ধ্যায় বায়তুল মোকাররম থেকে এমন লম্বা মশাল মিছিল বেরিয়েছিল যে বলবার নয়। আমরা দেখি নিÑ রুমী, ফকির, শরীফÑএরা তর্কের কচকচির মধ্যে পড়ে রাত এগারোটা করে ফেলেছিল। খবরটা জানা গেল আমার বান্ধবী রোকেয়ার টেলিফোনে। ওদের বাড়ি ধানমন্ডি আট নম্বর মেইন রোডের ওপর। ওদের বাড়ির সামনের মিরপুর রোড দিয়েই সব মিছিল বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে যায়। রোকেয়া বলল, ‘জানিস, মশাল মিছিল দেখে আমরাও রাস্তায় নেমে যেতে ইচ্ছা করছিল।’
১০ মার্চ বুধবার ১৯৭১
স্বাধিকার-স্বাধীনতা নিয়ে চেয়ারে বসে বাক-বিতÐার লড়াই চলছেই। সাতদিন বাইরে বাইরে ঘুরে, রুমী এখন দেখি, কদিন বাড়িতেই বন্ধু-বান্ধব নিয়ে খাবার টেবিল গুলজার করে রাখছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এতে আমার আর সুবহানের খাটনি বেশি হয় বটেÑদফায় দফায় চা-নাশতার সাপ্লাই দেয়া চাট্টিখানি কথা নয়। কিন্তু আমার প্রাণটা থাকে ঠাÐা। হৈহল্লা, বাড়িঘর লÐভÐÑযা করছে করুক, অন্তত চোখের সামনে তো রয়েছে। রুমী বাইরে গেলেই আমার প্রাণটা যেন হাতে কাঁপতে থাকে। জীবন আর মৃত্যুর মাঝখানে একটা গুলির ব্যবধান মাত্র, কখন আচমকা কোনদিক থেকে তীক্ষè শিসে ছুটে আসে, কে বলতে পারে!
‘সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ।’ জামীর করার কিছু নেই। রুমীর চেয়ে সাড়ে তিন বছরের ছোট হওয়ার অপরাধে তার মিটিং-মিছিলে যাওয়ারও অনুমতি নেই। রুমীদের আলাপ আলোচনায় সর্বক্ষণ তাল দেবার মতো বয়স-বিদ্যা কিছুই এখনো হয়নি। তাছাড়া রুমীর বেশির ভাগ বন্ধু রুমীর চেয়ে বয়সে দু’তিন বছরের বড়। পড়েও তার চেয়ে দু’তিন ক্লাস ওপরে। রুমীদের আলাপ-আলোচনার পরিধির মধ্যে পড়ে কার্ল মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, মাও সেতুং। এসবের মধ্যে জামী দাঁত ফোটাতে পারে না। কেবল চেগুয়েভাবার কথা উঠলে সে লফিয়ে এসে বসে।
জামীর বন্ধুদের মধ্যে একমাত্র টাট্টুকেই দেখি বেশিরভাগ আসতেÑযদিও সে থাকে সব থেকে দূরেÑগুলশানে। অন্য বন্ধুদের পাত্তা নেইÑনিশ্চয় তাদের মায়েরা বেরোতে দেয় না। টাট্টুর একটা সুবিধা আছে, তার বাবা-মা আমাদের পারিবারিক বন্ধু। কাজেই টাট্টু এ বাড়িতে আসবার আবদার ধরলে তার বাবা-মা, তাকে গাড়ি দিয়ে পাঠিয়ে দিতে বাধ্য হন। এদিক থেকেও একই কাহিনী। জামী আবদার ধরলে আমরা তাকে গাড়ি করে গুলশানে পাঠিয়ে দিতে বাধ্য হই। টাট্টু-জামীর ভাবখানা এই মিটিং-মিছিলে যখন যেতে দেবেই না, অন্তত দু’বন্ধুতে মেলামেশা করতে দাও!
ছেলেÑছোকরারা স্বাধীনতা-স্বাধিকারের তর্কে একমতে আসতে পারছে না, ওদিকে আমি বছরের বৃদ্ধ ভাসানী গতকালকার পল্টন ময়দান মিটিংয়ে স্বাধীনতার দাবি ঘোষণা করে বসে আছেন। গতকাল বিকেল তিনটেয় পল্টন ময়দানে ‘স্বাধীন বাংলা আন্দোলন সমন্বয় কমিটির উদ্যোগে যে জনসভা হয়, তাতে সভাপতি ছিলেন মওলানা ভাসানী। তিনি বলেন: বর্তমান সরকার যদি ২৫ মার্চের মধ্যে আপসে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা না দেয়, তাহলে ‘৫২ সালের মত মুজিবের সঙ্গে একযোগে বাংলার মুক্তিসংগ্রাম শুরু করব।’
ভাসানীর বক্তৃতার একটি কথা আমার মনে খুব দাগ কেটেছে। তিনি বলেছেন, ‘পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার চেয়ে বাংলার নায়ক হওয়া অনেক বেশি গৌরবের।’ মহাকবি মিল্টন-এর অমর মহাকাব্য ‘প্যারাডাইজ লস্ট’-এর সেই বিখ্যাত পঙ্ক্তি মনে পড়লÑইট ইজ বেটার টু রেইন ইন হেল দ্যাম সার্ভ ইন হেভন।’ স্বর্গে গোলামি করার চেয়ে নরকে রাজত্ব করা অনেক ভালো।
ব্যাঙ্কে টাকা তোলার আবার নতুন সময় করা হয়েছেÑনয়টাÑবারোটা। এখন থেকে শেখ মুজিবের নির্দেশে তাজউদ্দিন মাঝে মাঝে খবরের কাগজে বিভিন্ন বিষয়ে নির্দেশ দিতে থাকবেন।
১২ মার্চ শুক্রবার ১৯৭১
কিটিকে নিয়ে মহা ঝামেলায় পড়েছি। তার জন্য এই বুড়ো বয়সে নতুন করে সাধারণ জ্ঞানের বই পড়ে তথ্য যোগাড় করতে হচ্ছে। এত মিটিং, মিছিল, বিক্ষোভ দেখেও সে যেন মেনে নিতে পারছে না পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের এই বিক্ষোভ ন্যায়সঙ্গত, তাদের স্বাধিকারের দাবি ন্যায়সঙ্গত। কিটি বলছে, তোমরা তো খালি মুখেই বলছ, তোমরা বঞ্চিত, পশ্চিম পাকিস্তান তোমাদের প্রতি অন্যায় করছে, তোমাদের টাকা দিয়ে নিজেদের পেট ভরাচ্ছে। কিন্তু এ অভিযোগের সমর্থনে ফ্যাক্টস কই? ফিগারস কই? কোন কোন খাতে তোমার বঞ্চিত শোষিত, তার স্ট্যাটিসটিকস দেখাও।
শোনো কথা! শোষণ, বঞ্চনার পরিসংখ্যান আমি মুখস্ত করে রেখেছি নাকি? কিন্তু কিটিকে তো আর বলতে পারি নে, আমার অত মনে নেই, তুমি বইÑকাগজপত্র পড়ে নিজে জেনে নাও। সুতরাং আবার নতুন করে গত চব্বিশ বছরের অর্থনৈতিক বৈষম্য, শোষণ, অবিচারের পরিসংখ্যান ঘাঁটছি। পাইÑপয়সা ধরে হিসাব করে কিটিকে দেখিয়ে দেবÑচাল,আটা,নুন, কাগজ, সোনা থেকে শুরু করে সব খাতে কীভাবে পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানকে শুষে ছিবড়ে করে দিচ্ছে। শেখের নির্বচনী পোস্টার ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন’ খুঁজে বেড়াচ্ছি। ওটা কিটিকে দেখাতে পারলেই আমার কাজ বারো আনা হাসিল হয়। ওতে পাইÑপয়সা ধরে হিসাব করে বড় বড় অক্ষরে লেখা আছে বৈষম্য ও শোষণের সমস্ত তথ্য কিন্তু কারো কাছে যদি এক কপি থেকে থাকে।
১৪ মার্চ রবিবার
বাঙালির স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে ঢাকার কবিÑসাহিত্যিকরা ‘লেখক সংগ্রাম শিবির’ নামে একটি কমিটি গঠন করেছেন। আহŸায়ক : হাসান হাফিজুর রহমান। সদস্য : সিকান্দার আবু জাফর, আহমদ শরীফ, শওকত ওসমান, শামসুর রহমান, বদরুদ্দিন উমর, রণেশ দাশগুপ্ত, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, বোরহান উদ্দীন খান জাহাঙ্গীর, রোকনুজ্জামান খান, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, সুফিয়া কামাল, জহির রায়হান, আবদুল গনি হাজারী এবং আরো অনেকে।
কমিটি কয়েকদিন আগেই গঠিত হয়েছে, আজ বিকেল পাঁচটায় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে এর জরুরী সভা অনুষ্ঠিত হল। আহমদ শরীফ স্যার সভাপতি।
বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনে লেখকদের সংগ্রামী ভ‚মিকা সম্পর্কে উদ্দীপনাময় বক্তৃতা করলেন রণেশ দাশগুপ্ত, আলাউদ্দিন আলÑআজাদ, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, হাসান হাফিজুর রহমান, রাবেয়া খাতুন, আহমদ ছফা ও আরো কয়েকজন।
আমি সাহিত্যিকও নই, বক্তাও নই, আমি পেছনের দিকে চেয়ারে বসে বসে শুনলাম আর ভেতরে ভেতরে উদ্দীপ্ত হলাম। মিটিং শেষে সকলে মিছিল করে বেরোলেন শহীদ মিনারের উদ্দেশে। বাংলা একাডেমি থেকে শহীদ মিনার বেশিদূর নয়। আমার হাঁটুর ব্যথাটাও কয়েকদিন থেকে নেই। সাহস করে আমিও মিছিলে শামিল হলাম।
শিল্পীরাও পিছিয়ে নেই। মার্চের প্রথম থেকেই বেতার, টেলিভিশন, চলচ্চিত্রÑসব মাধ্যমের শিল্পীরাই অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নিয়ে মিটিং, মিছিল, গণসংগীতের অনুষ্ঠান ইত্যাদি করে আসছিলেন। এখন আবার বিভিন্ন শিল্পী সংস্থা থেকে প্রতিনিধি নিয়ে ‘বিক্ষুব্ধ শিল্পী সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করা হয়েছে।
পরিষদের সভাপতি : আলী মনসুর। সম্পাদক : সৈয়দ আবদুল হাদী। কোষাধ্যক্ষ : লায়লা আর্জুমান্দ বানু। সদস্য : মোস্তফা জামান আব্বাসী, জাহেদুর রহিম, ফেরদৌসী রহমান, বশির আহমেদ, খান আতাউর রহমান, বারীন মজুমদার, আলতাফ মাহমুদ, গোলাম মোস্তফা, কামরুল হাসান, অজিত রায়, হাসান ইমাম, কামাল লোহানী জি. এ. মান্নান, আবদুল আহাদ, সমর দাস, গহর জামিল, রাজ্জাক ও আরো অনেকে।
বেতার ও টিভি কেন্দ্রে মিলিটারি কেন মোতায়েন করা হয়েছেÑএই প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন বিক্ষুব্ধ শিল্পী সংগ্রাম পরিষদের সদস্যবৃন্দ।
১৫ মার্চ সোমবার
খেতাব বর্জন শুরু হয়ে গেছে।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন তার ‘হেলালে ইমতিয়াজ’ খেতাব বর্জন করেছেন। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ মুনীর চৌধুরী ‘সিতারাÑইÑইমতিয়াজ’ খেতাব বর্জন করেছেন।
নাটোর হতে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য ডা. শেখ মোবারক হোসেন ‘তমঘা-এ পাকিস্তান’, ফরিদপুরের প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য শেখ মোশারফ হোসেন ‘তমঘা-এ কায়েদে আযম’ খেতাব বর্জন করেছেন।
দৈনিক পাকিস্তান সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিনও তাঁর ‘সিতারাÑইÑখিদমত’ এবং ‘সিতারা-ই-ইমতিয়াজ’ খেতাব বর্জন করেছেন।
আরো কে কে যেন খেতাব বর্জন করেছেন, নামগুলো মনে করতে পারছি না। সমস্ত দেশ স্বাধীনতা আন্দোলনের জোয়ারে টালমাটাল। প্রতিবাদের ঝড় বয়ে যাচ্ছে সর্বত্র। ব্যাপারÑস্যাপার দেখে বিদেশীরাও ভয় পেতে শুরু করেছে। পশ্চিম জার্মানি আর যুক্তরাজ্য সরকার তাদের কিছু কিছু নাগরিককে বাংলাদেশ থেকে সরিয়ে নিতে শুরু করেছে। রুমী জার্মান কালচারাল সেন্টারে জার্মানি ভাষা শিখত। সেই সুবাদে তার এক জার্মান টিচারের বাড়িতে যাওয়াÑআসা ছিল। সেই ম্যাডামের কাছ থেকেই জানা গেল তাঁরা চলে যাচ্ছেন। যাওয়ার আগে ম্যাডাম রুমীকে চা খেতে ডেকেছিলেন তাঁর বাড়িতে। রুমী ফিরে এসে বলল, ‘ওঁর আপাতত ব্যাংককে যাচ্ছেন। তারপর কি হবে, এখনো জানেন না।’
আমি বললাম তাহলে আমাদের গুলশানের বাড়ির ভাড়াটেরাও যাবে নিশ্চয়ই। ’৬৫ সালের পাকÑভারত যুদ্ধের সময় তো সবাই ব্যাংককে চলে গিয়েছিল।
আমাদের ভাড়াটে একজন আমেরিকান। তাঁর বউকে ফোন করলাম। তিনি বললেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র সরকার এখনো তাদের নাগরিকদের সরাবার কথা চিন্তা করেনি। আমরা আপাতত কোথাও যাচ্ছি না। ঢাকাতেই আছি। ও হ্যাঁ, জাতিসংঘের কর্মচারীদেরও কিন্তু এখনো ঢাকা থেকে সরাবার কোন প্লান হয়নি। সুতরাং নিশ্চিন্ত থাকতে পার।’
আমি মনে মনে বললাম, আমাদের আর দুশ্চিন্তার কি আছে? আমরা তো মাটিতেই বসে আছি। তাছাড়া খাবার ভয় আমাদের নেই। যত ভয় তোমাদেরই। ’৬৫ সালের পাকÑভারত যুদ্ধের সময় কীভাবে ব্যাংকক পালিয়েছিলে, তা কি আর মনে নেই? আকাশে আশঙ্কার কালোমেঘ ক্রমেই ঘনীভ‚ত হচ্ছে।
দেশের ঘূর্ণিবিধ্বস্ত এলাকায় সাহায্য দেবার জন্য গম বোঝাই একটা মার্কিন জাহাজ আসছিল, সেটাকে চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙ্গর করতে দেয়া হয়নি। ইসলামাবাদ থেকে জরুরী নির্দেশ দিয়ে করাচি যেতে বলা হয়েছে এই নিয়ে দারুণ হৈচৈ এখানে। ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এ বিষয়ে প্রকৃত তথ্য উদ্ঘাটনের জন্য তদস্ত দাবি করে খবর কাগজে বিবৃতি দিয়েছেন। সরকার কাগজে পাল্টা বিবৃতি দিয়েছে এই বলে যে আদৌ কোনো গমবাহী জাহাজ চট্টগ্রামে আসার কথা ছিল না।
আজিম ভাই কিছুতেই প্লেনের টিকিট পাচ্ছেন না। বেচারী লন্ডন থেকে দেশে বেড়াতে এসেছিলেন মাত্র তিন সপ্তাহের ছুটি নিয়ে। প্লেনের টিকিট না পেয়ে ছুটি এখন চার সপ্তাহ পেরিয়ে যাচ্ছে। দুটো টেলিগ্রাম করেছেন, তারপর ট্রাংকল করেছেন। টেলিফোনে বসের গলার স্বরে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেনÑআর বুঝি চাকরি থাকে না। অথচ পি.আই.এ’র ফ্লাইটে নাকি রোজই শয়ে শয়ে অবাঙালি পশ্চিম পাকিস্তানে যাচ্ছে। খবর কাগজেও এ নিয়ে সংবাদ বেরিয়েছে; কোন বাঙালি প্লেনের টিকিট পাচ্ছে না, অথচ বিপুল সংখ্যক অবাঙালি রোজই প্লেনে করে বাংলাদেশ ছেড়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে ব্যবসায়ীরা। এরা এদের বউ ছেলেমেয়েদের সেই ফেব্রæয়ারি মাস থেকেই পাঠিয়ে দিতে শুরু করেছিল। এখন নিজেরা পালাচ্ছে। এদিকে শয়ে শয়ে সিলেটি বাঙালি লন্ডন থেকে ছুটি কাটাতে এসে আটকা পড়ে গেছে। টিকিট পাচ্ছে না। অথচ পি.আই.এ এদেরকে অন্য এয়ার লাইনসে টিকিট এনডোর্স করে নেবার অনুমতিও দিচ্ছে না।
আজ বিকেলের প্লেনে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঢাকা এসে নেমেছেন।
১৬ মার্চ মঙ্গলবার
রুমীকে নিয়ে বড্ডো উদ্বেগে আছি। কয়েকটা দিন বাড়িতে বসে বন্ধুবান্ধব নিয়ে প্রচুর মোগলাই পরোটা ধ্বংস করে, তর্কÑবিতর্ক মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত ঝালাপালা করে, এখন আবার বাইরে দৌড়োদৌড়ি শুরু করেছে। কোথায় যাচ্ছে, কি করছে, কখন খাচ্ছে, কি নাÑখেয়েই থাকছে, কিছুরই তাল পাচ্ছি না। আজ ওদের ড্রেসিংরুম পরিষ্কার করতে গিয়ে ওয়ার্ডরোব খুলে নিচে জুতোর সারের পেছনে হঠাৎ আবিষ্কার করলামÑইয়া মোটা ধ্যাবড়া দুটো হামানদিস্তা। অনেক আগে আমার ছোটবেলায় দাদীকে হামানদিস্তায় পান ছেঁচে খেতে দেখেছি। কিন্তু সে হামানদিস্তা দেখতে বেশ সৌকর্যমÐিত ছিল। আর এ হামানদিস্তা দুটো যেমন আকাট, তেমনি ধ্যাবড়া। দু’দুটো হামানদিস্তা ওয়ার্ডরোবের ভেতরে লুকানো? কি হবে এ দিয়ে? রুমী বাড়ি ছিল না। জামী কাঁচুমাচু মুখে স্বীকার করলÑবোমা পটকা বানানোর কাজে হামানদিস্তা একটি অত্যাবশ্যকীয় উপকরণ বটে। বোমাÑপটকা? কি গুঁড়ো করবি হামানদিস্তায়? মালমশলা কই? জামী দুই ঠোঁটÑটেপা আড়ষ্ট মুখে আঙ্গুল তুলে দেখাল, আলনার তলায় ঝোলানো কাপড়ের আড়ালে কয়েকটা প্লাস্টিকের ব্যাগÑপেট মোটা, সুতলি দিয়ে মুখ বাঁধা।
আমি কাঁপতে কাঁপতে নিজের ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। কি করি? কি বলি? সারা দেশ স্বাধীনতার দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠেছে ; ঢাকায়, রাজশাহীতে, চট্টগ্রামেÑসবখানে এই দাবি তুলে শান্তিপ্রিয় বাঙালিরা আজ মরিয়া হয়ে লাঠি, সড়কি যা পাচ্ছে, তাই হাতে নিয়ে ছুটে যাচ্ছে গুলির সামনে। ঘরে ঘরে নিজের হাতে বোমা, পটকা, মলোটভ ককটেল বানিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে প্রতিপক্ষের ওপর। এই রকম সময়ে আমার ছেলেকে আমি কি চাইব ঘরে আটকে রাখতে? আমি কি চাইব সে শুধু বন্ধুবান্ধব নিয়ে জাঁকিয়ে বসে, স্বাধীনতার দাবি-দাওয়ার প্রশ্নে তর্কÑবিতর্ক, চুলচেরা বিশ্লেষণ নিয়ে মত্ত থাকুক?
রুমী কখন বাড়ি ফিরেছে, টের পাইনি। ফিরেই নিশ্চয় জামীর কাছে সব শুনেছে। আমার ঘরে এসে সুইচ টিপে বাতি জে¦লে খুব শান্তস্বরে বলল, ‘আম্মা, তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।’
আমিও উঠে বসে বললাম, ‘তোমার সঙ্গে আমারও কিছু কথা আছে।’
রুমী খাটে এসে বসল আমার সামনে। আমি বললাম, ‘ছোটবেলা থেকে তোমাকে এই শিক্ষা দিয়েছিÑএমন কাজ কখনো করবে না যা আমাদের কাছে লুকোতে হবে। শিখিয়েছিÑযদি কখনো কোন বিষয়ে আমাদের মতের সঙ্গে তোমার মত না মেলে, তাহলে আগে আমাদেরকে বুঝিয়ে তোমার মতে ফেরাবে, তারপর সেই কাজটা করবে।’
রুমী তার স্বভাবসিদ্ধ মৃদু গলাতে বলল, ‘আমি লুকিয়ে কিছু করছি না আম্মা। আব্বু সব জানে, আব্বুই আমাকে বেবী চাচার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছে। তোমাকে তো আগেই বলেছি, আমি বেবী চাচার সঙ্গে কাজ করি। তবে কি কাজ করি, বিস্তারিত বলা নিশেধ আছে।’
আমি রুমীকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললাম, ‘আমার খুব ভয় করছে রুমী।’
রুমী একটুক্ষণ চুপ করে থেকে গম্ভীর গলায় বলল, ‘ভয় করার স্টেজে আমরা আর নেই মা। আমাদের আর পিছনে হাঁটার কোনো উপায় সেই।’
‘তুই যা-ই বলিস রুমী, দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। আজই তো কেবল মুজিবÑইয়াহিয়া বৈঠক শুরু হল। ফয়সালা একটা নিশ্চয় হবে।’
রুমীর মুখে কিরকম একটা হাসি ফুটে উঠল, কি যেন বলতে গেল সে, তার আগেই সিঁড়ির মুখ থেকে জামী চেঁচিয়ে ডাকল, ‘মা ভাইয়া, শিগগির এস, খবর শুরু হয়ে গেছে। টিভিতে শেখ মুজিবকে দেখাচ্ছে।’
হুড়মুড়িয়ে উঠে নিচে ছুটলাম। খবর খানিকটা হয়ে গেছে। শেখ মুজিবের গাড়িটা প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে বেরিয়ে আসছে। সাদা ধবধবে গাড়িতে পতপত করে উড়ছে কালো পতাকা। দেখে প্রাণটা যেন জুড়িয়ে গেল। প্রতিবাদের কালো পতাকা উঁচিয়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনায় গিয়েছেন শেখ মুজিব। এর আগে কোনোদিনও পাকিস্তান সরকার বাঙালির প্রতিবাদের এই কালো পতাকা স্বীকার করে নেয়নি। এবার সেটাও সম্ভব হয়েছে।
১৭ মার্চ বুধবার ১৯৭১
সকালে চায়ের টেবিলে সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়েছে খবর কাগজের ওপর। পরিস্থিতি ও চাহিদার গুরুত্ব বুঝে মাসের ২-৩ তারিখ থেকেই তিন চারটে কাগজ রাখছিÑযাতে বাড়ির সকলেই একই সঙ্গে সুখী থাকতে পারে।
সবার নজর মুজিবÑইয়াহিয়ার বৈঠকের খবরটার দিকে। খবর অবশ্য বিশেষ কিছু নেই। তাঁরা রুদ্ধদ্বার কক্ষে আড়াই ঘণ্টাকাল আলোচনা করেছেন। বাইরে বেরিয়ে এসে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শেখ শুধু বলেছেন, তাঁরা দেশের রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা কেবল শুরু করেছেন। আলোচনা চলতে থাকবে, কারণ সমস্যা যা, দু’তিন মিনিটে তার সমাধান সম্ভব নয়।
আজ বুধবার সকাল দশটায় আবার বসছেন তাঁরা।
রুমী হঠাৎ মুখ তুলে বলল, ‘আম্মা, এই খবরটা দেখেছ?’
‘কোনটা?’
রুমী হাতের দৈনিক আজাদ পত্রিকাটা এগিয়ে দিল আমার দিকে। পড়লাম খবরটা। হেডিং হচ্ছে :
জানেন কি?
রাজধানী ঢাকায় বর্তমানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কতজন পদস্থ ব্যক্তি অবস্থান করিতেছেন?
খবরটা সংক্ষেপে হল : প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আবদুল হামিদ, প্রিন্সিপ্যাল স্টাফ অফিসার লে. জেনারেল পীরজাদা, মেজর জেনারেল ওমর এবং আরো ছয়জন ব্রিগেডিয়ার ঢাকা এসেছেন। তবে এ সম্বন্ধে কোন সরকারি সমর্থন পাওয়া যায় নি। কেবল প্রেসিডেন্টের জনসংযোগ অফিসার সাংবাদিকদের প্রশ্নের চাপে পীরজাদা ও ওমরের ঢাকা আসার কথা স্বীকার করেছেন।
রুমী বলল, ‘বুঝলে আম্মা, ব্যাপারটা আমার কছে খুব সুবিধের ঠেকছে না। বন্ধুত্বপূর্ণ আলোচনা করতে এত সেনাপতি, সামন্ত সঙ্গে নিয়ে আসার মানেটা কি?’
আমার বুকটা হঠাৎ কেঁপে উঠল, তবু একটু ধমকের সুরে বললাম, ‘তোরা খালি গুজবের আগে ছুটিস। এ খবরের কোনো ভিত্তি নেই তো। লোকে আগাম আশঙ্কা করে বলছে এ কথা। আলোচনা তো কেবল একদিন হয়েছে, দু’চারটে দিন ধৈর্য ধরে দেখ নাÑনিশ্চয় সব ঠিক হয়ে যাবে।’
‘ঐ আনন্দেই থাকো। তোমার কি রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি বলতে কিছু নেই আম্মা’Ñরুমীর কথায় বাধা পড়ল। কলিং বেল বেজে উঠেছে। জামী তড়াক করে উঠে দরজা খুলেই চেঁচিয়ে বলল, ‘মা, মা, নিয়োগী চাচাÑ’
আমিও চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘আরে তাই নাকি? খুব ভালো দিনে এসেছেন তো। আপনাকে আমার খুব দরকার।’
অজিত নিয়োগী ঘরে ঢুকে হাসিমুখে বললেন, ‘সেইটে জেনেই তো কেমন এসে পড়েছি, দেখুন।’
শরীফ ও আমি উঠে বসার ঘরের দিকে গেলাম। রুমী, জামী নিয়োগী সাহেবকে আদাব দিয়ে দোতলায় উঠে গেল।
আমি বললাম, ‘দাদা, আপনার সঙ্গে আজ আমার কিছু জরুরী কথাবার্তা আছে। বসতে হবে অনেকক্ষণ। আর ঠিক ঠিক জবাব দিতে হবে।’
নিয়োগী দাদা হাসতে হাসতে বললেন, ‘আরে বাপরে। কি এমন সাংঘাতিক কথা জিগ্যেস করবেন? একেবারে ঠিক ঠিক জবাব চাই?’
শরীফ খানিকক্ষণ কথা বলার পর উঠে দাঁড়াল, ‘আমার অফিস আছে,চললাম। আপনারা সাংঘাতিক সওয়াল জবাব করতে থাকুন।’
শরীফ চলে যাওয়ার পর আমি বললাম, ‘আমি খুব স্পষ্ট কখায় দুটো প্রশ্ন করব। ঠিক ঠিক জবাব দেবেন কিন্তু দাদা।’
উনি হাসিমুখে বললেন, ‘এক নম্বর প্রশ্নÑদেশে রক্তস্রোত বয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে কি না। দুই নম্বর প্রশ্নÑআমার কপালে পুত্রশোক আছে কি না।’
প্রশ্ন শুনে নিয়োগী দাদা স্তদ্ধ হয়ে বসে রইলেন। আমি খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে বললাম, ‘কই জবাব দিচ্ছেন না?’
নিয়োগী দাদা একটু হাসলেন, অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়েছেন মনে হল। কেশে গলা পরিষ্কার করে বললেন, ‘এসব বিষয়ে কি নিশ্চিত করে কিছু বলা যায়?’
আমি জোর দিয়ে বললাম,‘কেন যাবে না? আপনি এত বড় অ্যাস্ট্রলজার কত বছর ধরে কত বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করে আসছেন, আপনি কি বলতে চান দেশের বিষয় নিয়ে কিছুই ভাবনাচিন্তা করেন নি?’
‘করেছি বইকি। তবেÑ’
‘তবে-টবে নয়। কি চিন্তাভাবনা করেছেন, বলুন।’
‘রক্তস্রোতের সম্ভাবনা খুবই ছিল। পাকিস্তান হল মকর রাশির অন্তর্গত দেশ। মকর রাশিতে এ সময়ে আছে রাহু ও শত্রæ। আর পাশাপাশি দ্বাদশ ঘরে ধনুতে অবস্থান করছে মঙ্গল। রাহু মানে ধ্বংস আর শুক্রের জন্য আগুন আসে। দ্বাদশে মঙ্গল মানেই ধ্বংস। কিন্তু বৃহস্পতি এ সময় বৃশ্চিকে একাদশ ঘরে আছে বলেই ভরসার কথা অল্পের জন্য ভয়াবহ রক্তস্রোতের সম্ভাবনাটা এড়ানো গেছে।’
আমি স্বস্তির নিশ^াস ছেড়ে বললাম,‘আর আমার দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাব?’
নিয়োগী দাদা আবারো অস্বস্তিতে পড়েছেন, বোঝা গেল। বহুক্ষণ চুপ করে জানলার বাইরে তাকিয়ে রইলেন। অনেক্ষণপর ধীরে ধীরে বললেন, ‘রুমীর মঙ্গল খুব প্রবল। জানেন তো মঙ্গল যুদ্ধের রাশি। ওকে একটু সাবধানে রাখবেন।’
আমি গোঁয়ারের মতো বললাম, ‘ওসব সাবধানে রাখার কথা বাদ দিন। আমার কপালে পুত্রশোক আছে কি না তাই বলুন। ওটা থাকলে লখিন্দরের লোহার ঘর বানিয়েও লাভ নাই।
অজিত নিয়োগী অনেকক্ষণ ধরে কি যেন ভাবলেন, তারপর মৃদুস্বরে বললেন, ‘না। আপনার কপালে পুত্রশোক নেই। তবু ওকে সাবধান রাখবেন।’
আমার বুক থেকে পাষাণÑভার নেমে গেল। আমি জ্যোতিষশাস্ত্র, ভবিষ্যদ্বাণীÑএসব কোনো কিছুতেই কোনোদিনও বিশ^াস করিনি। অজিত নিয়োগীর সঙ্গে আমাদের পরিচয়ের সুত্র অদৃষ্ট গণনা বা ভবিষ্যদ্বাণীর নয়, সহিত্যালোচনা ও সামাজিক মেলামেশার। এর মধ্যেই ওঁর কয়েকটা গল্পের বই বাজারে বেরিয়েছে। তবু দেশের এই রকম পরিস্থিতিতে, রুমীর রহস্যময়, উদভ্রান্ত চালচলনে, মনের মধ্যে আত্মবিশ^াসের খুঁটিটা কখন কেমন করে যেন নড়বড়ে হয়ে গেছে। তাই অজিত নিয়োগীর ভবিষ্যদ্বাণীর ক্ষমতার ওপর এখন মনেপ্রাণে নির্ভর করতে চাইছি।