জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মেরু অঞ্চলে বরফ গলার ঘটনা সম্পর্কে অনেকেই আমরা জানি। কিন্তু ভাসমান বরফের নীচে ঠিক কী ঘটছে, তা অনুসন্ধান করতে গিয়ে গবেষকরা এবার বরফের নতুন এক স্তর আবিষ্কার করেছেন।
উত্তর মেরু অঞ্চলের শীতকাল মানেই মাসের পর মাস ধরে একটানা অন্ধকার অবস্থা। সূর্যের মুখ দেখার উপায় নেই। তার ওপর উত্তর মেরুকে ঘিরে শীতকাল সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান এখনো খুবই সীমিত। অথচ পৃথিবীর জলবায়ুর ওপর এই অঞ্চলের গভীর প্রভাব রয়েছে।
কয়েক দশক ধরে সেখানে বরফের পরিমাণ কমে চলেছে। জলবায়ু পরিবর্তন ছাড়া সেখানে আর কী ঘটছে, সে বিষয়ে এখনো খুব কম জানা গেছে। সমুদ্রবিজ্ঞানীদের অনুসন্ধানের মূল বিষয় ছিল সমুদ্রের বরফ কীভাবে বদলাচ্ছে? পানির ওপর বরফ কীভাবে বাড়ছে ও গলছে?
শীতকালে মেরু অঞ্চলের অবস্থা নিয়ে গবেষণা করতে হলে সেই বৈরি শীতল পরিবেশে থাকতে হবে। ক্রিস্টিয়ান হাস ও তাঁর সহকর্মী নিয়ে গড়া গবেষকদল সেটাই করেছে। অক্টোবর মাস থেকে ‘পোলার স্টার’ নামের জাহাজ উত্তর মেরু সাগরে বরফের মধ্যে ভেসে বেড়িয়েছে। মাসের পর মাস ধরে শীতের অন্ধকারে জাহাজটি বিচরণ করেছে। উত্তর মেরু অঞ্চলে এত বড়ো অভিযান এর আগে কখনো চালানো হয়নি।
বরফের নীচে সমুদ্রের পানির ওপর রোবট পাতলা বরফের স্তর দিয়ে তৈরি চকমকে মেঘ খুঁজে পেয়েছে
ক্রিস্টিয়ান হাস, সামুদ্রিক পদার্থবিদ, আলফ্রেড ভেগেনার ইনস্টিটিউট, জার্মানী।
উত্তর মেরু অঞ্চলের শীতকাল গুরুত্বপূর্ণ এক পর্যায়। শীতকালে বরফ জমে এবং গ্রীষ্মকালেও তা টিকে থাকে। গ্রীষ্মকাল এবং সেইসঙ্গে গোটা জলবায়ু প্রণালীর ওপর বরফের যথেষ্ট প্রভাব থাকে।
বাতাসে মাইনাস ৩০ থেকে মাইনাস ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও কম তাপমাত্রার অনুভ‚তি থাকলে কাজ করা খুব কঠিন ও বিপজ্জনক। কারণ তখন গোটা শরীর ঢেকে রাখতে হয়। কেন সেই বরফ সঙ্কুচিত হচ্ছে, সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছি আমরা। আমরা বরফের মধ্যে গর্ত খুঁড়ে নমুনা নিয়েছি, তাপমাত্রা ও বরফের গতিবিধি পরিমাপ করেছি। বরফ কেটে পাতলা চাকতি তৈরি করেছি।
নতুন আবিষ্কার নয়, নির্ভরযোগ্য তথ্য সংগ্রহ করাই ছিল এই অভিযানের উদ্দেশ্য। বরফের নিখুঁত জীবনী রচনার চেষ্টা করেছি। কিন্তু এ সবের মধ্যে নতুন আবিষ্কারও সম্ভব হয়েছে। ডুবুরি রোবট সেই সাফল্যের দাবিদার। বরফের নীচে সমুদ্রের পানির ওপর রোবট পাতলা বরফের স্তর দিয়ে তৈরি চকমকে মেঘ খুঁজে পেয়েছে। এই প্লেটলেট আইস মানুষের হাতের মতো বড়ো পাতলা বরফের স্তর, যেগুলি নানাভাবে ভাসমান বরফের নীচে লেগে থাকে। সাবমেরিন যখন অনেক সময় ধরে অন্ধকারে হেডলাইট জ্বালিয়ে দূর থেকে আলো ফেলে, তখন সেই বরফ চকমক করতে থাকে। কাছে গেলে বোঝা যায়, সেগুলি আসলে বরফের ক্রিস্টাল বা স্ফটিক।
সে কারণে শুধু ক্ষুদ্র জীব ও সামুদ্রিক উদ্ভিদ নয়, সেখানে জু প্ল্যাংকটন অর্থাৎ ক্রিলের মতো ক্ষুদ্র চিংড়ি জাতীয় প্রাণীও দেখা যায়। এমন অ্যাম্ফিপড জাতীয় প্রাণী অ্যালজির খোঁজে প্লেটলেট আইসের মধ্য দিয়ে চলে যাচ্ছে, এমনটাও আমরা লক্ষ করেছি। সেই আবরণ এমন প্রাণীগুলিকে পোলার কড মাছের মতো বড়ো প্রাণীর হামলা থেকেও রক্ষা করে।
দক্ষিণ মেরু অঞ্চলে আগেই পানির নীচে এমন চকমকে বরফের স্তর দেখা গিয়েছিল। উত্তর মেরু অঞ্চলে গবেষকরা প্রথমবার প্লেটলেট আইসের খোঁজ পেলেন। ভসমান বরফের নীচে সমুদ্রের পানির তাপমাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় কম, অর্থাৎ হিমাঙ্কের নীচে হলেই এমন বরফ সৃষ্টি হতে পারে। কন্ডেনসেশন পয়েন্ট পেলেই পানি সঙ্গে সঙ্গে জমে গিয়ে প্লেটলেট আইস হয়ে ওঠে। গবেষকরা যে দড়ি ও পরিমাপের যন্ত্র পানিতে ডুবিয়েছেন, সেগুলির গায়েও প্লেটলেট আইস সৃষ্টি হয়েছে। প্লেটলেটগুলির মাঝে অনেক ফাঁকা অংশ রয়েছে। অর্থাৎ গোটা স্তর ছিদ্রে ভরা থাকে।
মেরু অঞ্চলের এমন ‘নতুন আবিষ্কার’ সম্পর্কে আরও বিস্তৃত গবেষণার দাবি রাখে।
ফিচার ডেস্ক