শিশু সংগঠন খেলাঘর শিশুদের আধিকার ও মানসিক বিকাশে কাজ করে যাচ্ছে বহু বছর ধরেই। শিশুদের জন্য নিরাপদ দেশ গড়তে ও শিশুর নিরাপত্তার জন্য খেলাঘরের ভ‚মিকা অনেক। আবার শিশুর স্বাস্থ্য ও শিশু শিক্ষা নিয়ে খেলাঘরের পাশাপাশি আরো অনেক সংগঠন কাজ করে যাচ্ছে। সবার চেতনায় একটা জিনিস কাজ করে যে, আজকের শিশুই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। আর খেলাঘর বলে, ‘আজকের শিশুই আগামীর বাংলাদেশ’। নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন নিয়ে তারা সবাই কাজ করে যাচ্ছে।
আমরা যে যে কাজই করি না কেন, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সবাই শিশুদের নিরাপদ, নিরাপত্তা, মেধা, খেলাধুলা, নাটক, গান, নাচ অথবা তার প্রতিভা অনুযায়ী সেই শিশুকে আগামীর মানুষ করে গড়ে তোলার কাজ করে থাকি। আর এই সংগঠনের সাথে যারা কাজ করে, তারা সবাই যার যার পকেটের টাকা খরচ করেই এটা করে ও নিজের কাজের সময়ের মধ্যে থেকে একটু সময় বের করে, ঐ কোমলমতি শিশুদের বিকশিত করার জন্য ব্যয় করে, যা এই যুগের ব্যবস্থা অনুযায়ী নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো অবস্থা। আমি নিজেও খেলাঘরের একজন কর্মী হিসেবে খুবই গর্ব বোধ করি। শিশুদের কাছাকাছি থাকাটা আমার জন্য একটা সৌভাগ্যের দরজা খুলে দিয়েছে এই খেলাঘর। কিন্তু দুঃখ লাগে তখন ,যখন দেখি শিশুর বাবা-মা আজ হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে, শিশুর ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক কথা বলেন। তাদের নিরাপত্তা ও খেলাধুলা করার মতো স্থানের খুবই অভাব। শিশুর খেলার উপযোগী মাঠগুলো যখন ধ্বংস করে, সেখানে ইমারত বানানোর পরিকল্পনা করা হয়, তখন হৃদয়ে রক্ত ক্ষরণ হয়। আবার যখন সেই মাঠ ধ্বংসের বিরুদ্ধে কেউ সামনে এসে দাঁড়ায়, আর তাকে হাজতে যেতে হয়, তখন মনে হয় কেন আমাদের মতো মানুষগুলো এখনো বেঁচে আছে। কয়দিন আগেই দেখলাম ঢাকায় তেঁতুলতলা খেলার মাঠ দখল করে থানা ভবন নির্মাণের জন্য কাজ শুরু করেছে সরকারি গোষ্ঠী। আর সেখানে শিশুদের ও তার পিতা মাতার মুখের দিকে তাকিয়ে সেটার প্রতিবাদ করেছিল একজন শিশু শুভাকাক্সক্ষী ও তার কিশোর ছেলে। যে মাঠে শিশুরা খেলত, গল্প করত বন্ধুদের সাথে। বয়স্ক মানুষগুলো বন্দী জীবন থেকে একটু খোলা নিশ্বাস নেওয়ার জন্য, যেখানে একটু ঘোরাঘুরী করত। যেখানে সামাজিক অনুষ্ঠান হতো। মৃতের জানাজা হতো। ঈদের নামাজও নাকি হতো সেখানে। আজ সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী সেখানে হবে নাকি আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য থানা। আইন শৃংখলা বাহিনী তাদের ধরে নিয়ে সেখান কার থানায় আটকে রাখে প্রায় ১৩ ঘণ্টা। সেই মা ও তার সন্তানকে অন্য সকল মা ও সন্তানদের জন্য ১৩ ঘণ্টা হাজতবাস করতে হলো। লজ্জা আমাদের রাখার জায়গা নেই। তাদের উপর অভিযোগ এই যে তারা সরকারি কাজে বাধা দিয়েছে। কেন ভাই সেখানেই থানা তৈরি করতে হবে। সরকারের কি জায়গার এতই অভাব হয়ে গেছে যে ,তাদের হাত থেকে খেলার মাঠেরও কোনো নিস্তার নেই। সারা দেশসহ সেই থানার সামনে প্রতিবাদের ঝড় উঠলে, মুচলেকা দিয়ে তবেই তাদের ছেড়েছে আমাদের প্রশাসন।
কে জিতেছে আর কে হেরেছে সেটা বড়ো কথা নয়। তবে হার জিতের খেলায় সাময়িক হলেও আমরাই জিতেছি। তবে তা কতদিনের জন্য সেটা একটা বিষয়। শিশুদের একঘেঁয়ে জীবন তাদের মস্তিষ্কের বিকার তৈরি করে ও তাদের বিপথে নিয়ে যায়। মেধা বিকাশের বিঘœ ঘটায়। এটা সত্য কথা। আর শিশুদের মেধা বিকাশের বাধা মানেই তো কলম ছেড়ে কৌশলে অস্ত্র হাতে তুলে দেওয়া। আজ যারা হবে এই দেশের ভবিষ্যৎ, আর তারা হেলমেট মাথায় দিয়ে ছুরি হাতে তুলে নিয়েছে। যেখানে কলমের কালিতে সাদা কাগজ রঙিন হওয়ার কথা ছিল, সেখানে অন্যের রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে আমাদের স্বপ্নগুলো। ছিনতাই ডাকাতি, খুন, ধর্ষণসহ জঘন্য কাজে নিয়োজিত হচ্ছে আজকের শিশুরাই। খেলার মাঠ ধ্বংস করা মানেই তো তাদেরকে কৌশলে ঐ কাজে উদ্বুদ্ধ করা ছাড়া আর কিছু বলে আমার মনে হয় না। ছুরি দিয়ে কুপিয়ে সংবাদ কর্মীকে মেরে ফেলা সোনার ছেলেরা হয়ত দেশের মধ্যে নিরাপদেই আছে বা থাকবে কিন্তু তাদের ধরতে কষ্ট পায় আমাদের প্রশাসন অথচ যারা ঐ শিশুগুলো যেন ভালো মানুষ হয়ে আগামীর বাংলাদেশ হতে পারে, সেই ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে কাজ করে যাচ্ছে, তাদেরকে কোনো কারণ ছাড়াই সরকারি কাজে বাধা বলে হাজতে পুরে দিচ্ছে। এটা আমাদের জন্য খুবই লজ্জা। আসলে কে কাকে জবাব দেবে। অথবা কে কার কাছ থেকে জবাব নেবে।
লজ্জা পেলাম আমি আবারও, যখন পত্রিকার পাতায় দেখলামÑআমাদের আইন শৃংখলা বাহিনীর উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের বেশ কয়েক জনকে আমেরিকা প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা বিষয়ে সেখানকার অর্থাৎ মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বক্তব্য শুনে। তিনি সাবলীল ভাবে বলেই ফেললেন, জবাবদিহি নিশ্চিত করা না হলে, পূর্বের সেই আইন শৃংখলা বাহিনীর উপরের নিশেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের কোনো সুযোগ নেই। আবার বললেন আগামী নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্র কারো পক্ষ নেবে না। তবে কি তারা এর আগে কারো পক্ষ নিয়েছিল। প্রশ্ন থাকতেই পারে। আসলে হতাশা আর অবক্ষয়ে আমরা পুরোই নিমজ্জিত হয়ে গেছি। শুধু নাকটুকু বের করে কোনমতে বেঁচে থাকার জন্য শ্বাস নিতে চেষ্টা করছি মাত্র। আজ নতুন থানা স্থাপন করে আপরাধ দমনের কথা বলছি বা চেষ্টা করছি। অথচ শিশু অধিকারকেই কৌশলে গুঁড়িয়ে দিচ্ছি আমরা নিজেরাই। আজ বড়ো বড়ো ভবনে স্কুল কলেজে, কোনো প্রতিষ্ঠানে বা কারখানায় আগুন নেভানোর জন্য ব্যবস্থা রাখতে নির্দেশ দিচ্ছি অথচ মানুষের হৃদয়কে দুঃশাসনের আগুনে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করতে দ্বিধা বোধ করছি না। আরো বেশি লজ্জা পেলাম যখন পত্রিকায় দেখলাম দুই কার্টুন বন্ধুর গল্প। এক বন্ধু হেলমেট পরে ছুরি হাতে বলছে আমরা কোপাবো, আর দোষ হবে ওদের। কেননা আমরা এখন হেলমেট পলিটিক্স করি। এখনই সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। আমাদের দেশের আর একটা খেলার মাঠও যেন আর নতুন করে ধ্বংস করা না হয়, আমি বাংলাদেশের সকল শিশু সংগঠনের পক্ষে এই দাবি রাখছি মাননীয় সরকার প্রধানের কাছে। অসুন শিশুর ভবিষ্যৎ নিয়ে একটু ভাবি। কেননা আমি/আপনিও একদিন ওদের মতোই শিশু ছিলাম।
অলোক মজুমদার : চিকিৎসক ও লেখক;
বিশেষ প্রতিনিধি সাপ্তাহিক সময়ের বিবর্তন।