এ বছর আবহাওয়া অনুক‚লে থাকায় আমন ধানের ফলন ভালো হয়েছে। কৃষকও খুশি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যদি ধানের উপযুক্ত মূল্য নিশ্চিত না হয়, তাহলে কৃষকের হাসি ম্লান হবে। তবে আমরা আশাবাদী, এবার আমন মৌসুমে কৃষকের ধানের উপযুক্ত মূল্য নিশ্চিত করতে সরকারের অভ্যন্তরীণভাবে ধান চাল সংগ্রহের উদ্যোগ কাজে লাগবে। এবছর সরকার আমন ধানের উপযুক্ত মূল্য নিশ্চিত করতে কৃষকের কাছ থেকে প্রতি কেজি ২৬ টাকা দরে ৬ লাখ টন ধান ও প্রতি কেজি ৩৬ টাকা দরে সাড়ে তিন লাখ টন চাল ডিলারদের কাছ থেকে কেনার উদ্যোগ নিয়েছে। ঘোষিত পরিমাণ ধান, চাল কেনার কারণে এবার ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত হবে বলে আমরা আশাবাদী।
আবার এ-ও সত্য, অনেক সময়ই বাড়তি ফলন হলেই এ দেশের কৃষকের কপাল পুড়ে। যেমন গত ক’বছর যাবৎ টানা ধানের দর পতনে কৃষককে ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে। যদিও সরকার কৃষকের ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে প্রতিবছর কম বেশি ধান চাল সংগ্রহ করে। তবুও ধানের ন্যায্যমূল্য থেকে কৃষক বঞ্চিত হয়ে থাকে। মূলত পুরোনো পদ্ধতিতে ধান কেনার কারণে কৃষি বিভাগ কর্তৃক কৃষকের তালিকা প্রণয়ন করতে দীর্ঘসূত্রিতার দরুন ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। বাস্তব এ অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে চলতি আমন মৌসুমে উন্নত প্রযুক্তি ‘অ্যাপের’ মাধ্যমে কৃষকের তালিকা প্রণয়ন করায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আশা করছেন, এ বছর খাদ্য গুদামে ধান বিক্রির সুবিধাভোগী কৃষক ধানের ন্যায্য মূল্য পাবেন। ইতিমধ্যেই দেশের বিভিন্ন স্থানে লটারির মাধ্যমে কৃষকের তালিকা নির্ধারণ করে ধান কেনা শুরু হয়েছে। তবে এ-ও সত্য, কৃষকের তালিকা প্রণয়নে আরো বেশি জোর দিতে হবে। যেন অতি দ্রুততার সাথে কৃষকের তালিকা প্রণয়ন করে খাদ্য বিভাগ জোরের সাথে ধান ক্রয় কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে ন্যূনতম শৈথিলতার দরুন কৃষক ধানের ন্যায্যমূল্য হতে বঞ্চিত হতে পারে। যা কারো কাছেই কোনোভাবেই কাম্য হবে না।
যদিও মোট উৎপাদিত ধানের মধ্যে মাত্র ৩ দশমিক নয় শতাংশ ধান ও চাল সরকার ক্রয় করে থাকে। বাকি ধান চাল বেসরকারিভাবে ক্রয়-বিক্রয় হয়ে থাকে। তবে স্বল্প পরিমাণ ধান-চাল সরকার অভ্যন্তরীণভাবে সংগ্রহ করলেও তার গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ ধানের উৎপাদন খরচ ও কৃষকের লাভ যোগ করে সরকারকেই ধানের প্রকৃত মূল্য নির্ধারণ করে দিতে হয়। যার ওপর নির্ভর করে ধান চালের বাজার মূল্য নির্ধারণ হয়। বিশেষ করে সরকারের কাছে আপদকালিন খাদ্য মজুদ থাকলে ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে অস্বাভাবিক বাজার সৃষ্টি করতে পারে না। বাজারে চালের দাম বৃদ্ধি হলে ভোক্তার কষ্ট বাড়ে, তখন সরকার স্বল্প মূল্যে খোলাবাজারে চাল, আটা বিক্রি করে দাম নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
তবে বর্তমান প্রেক্ষাপট অনেকটাই ভিন্ন। অতিস¤প্রতি চালের বাজার দর একটু বৃদ্ধি পাওয়ায় সাধারণ ভোক্তার কষ্টের কথা বিবেচনায় নিয়ে সরকার ৩০ টাকা কেজিতে খোলাবাজারে চাল বিক্রির উদ্যোগ নিলেও এ উদ্যোগ তেমন কাজে আসেনি। কারণ ৩০ টাকা কেজি দরে মোটা চাল কিনে খাবার ভোক্তা মিলছে না। কেন এ অবস্থা? এর উত্তর দিতে হলে একটু খোলামেলা আলোচনা করা দরকার।
তুলনামূলক এখন সাধারণ মানুষের ক্রয় সক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় মোটা চালের ভোক্তা নেই বললেই চলে। নিম্ন আয়ের মানুষ থেকে শুরু করে সবাই ছোটেন চিকন চালের বাজারে। সবাই এখন চিকন চালের ভাত খেতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। ফলে চিকন চালের ভোক্তার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থাৎ যে হারে চিকন চালের ভোক্তার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, সে হারে চিকন ধানের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়নি। ফলে চিকন চালের বাজার দর বেড়েছে কেজি প্রতি সর্বমোট ৫/৬ টাকা পর্যন্ত। পক্ষান্তরে সরকারের খাদ্য গুদামে মজুদ থাকা মোটা চাল ত্রিশ টাকা কেজিতে সরকার বিক্রি করলেও সে চাল কেউ আর কেনেন না। ফলে খোলাবাজারে মোটা চাল আর বিক্রিও হয় না। অথচ এমন এক সময় ছিল যখন দু-বেলা দু-মুঠো মোটা ভাত হলেই যথেষ্ট ছিল। এখন আর সে সময় নেই। এখন চাল হতে হবে চিকন, ঝর ঝরে এবং মরা দানামুক্ত। ফলে স্বয়ংক্রিয় চালকলগুলোর আধিপত্যও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যারা চিকন চালের বাজার এখন নিয়ন্ত্রণ করে। এ কারণে সরকারকেও বাস্তব অবস্থার ওপর সঠিক ও সময়োচিত পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।
সরকার মূলত অভ্যন্তরীণভাবে মোটা চাল সংগ্রহ করে থাকে। আর চিকন চাল মিল মালিকরা প্রস্তুত করে খোলাবাজারে বিপণন করে। সে চালের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকে না। চিকন চালের দাম বাড়লে খাদ্যমন্ত্রী মিল মালিকদের ও আড়তদারদের ডেকে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য অনুরোধ করেন। অনেক সময়ই অনুরোধ কাজে আসে না। ফলে ভোক্তার কষ্ট বাড়ে। এ ক্ষেত্রে চিকন চালের বাজার সরকারকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে অভ্যন্তরীণ সংগ্রহের সময় চিকন চাল সংগ্রহ করতে হবে। এ জন্য মোটা চালের সংগ্রহ মূল্যের চেয়ে যৌক্তিক পর্যায়ে চিকন চালের মূল্য বৃদ্ধি করে চিকন চাল সংগ্রহ করতে হবে। অর্থাৎ মোটা ও চিকন দুই ধরনের চালের আলাদা আলাদা মূল্য নির্ধারণ করে যদি চাল সংগ্রহ করা যায়, তাহলে চিকন চালের বাজার দর কখনও বৃদ্ধি পেলে খোলা বাজারে চিকন চাল সরকার বিক্রি করতে পারবে। তখন আর ব্যবসায়ীরা ইচ্ছা করলেও চিকন চালের দর অস্বাভাবিকভাবে বাড়াতে পারবে না।
এখন দেশে মোটা ধানের চাষাবাদ বেশি হয়। যদি চিকন চাল সরকার অভ্যন্তরীণভাবে সংগ্রহ করে তাহলে চাষীরা মোটা ধানের চাষাবাদ কমিয়ে দেবে। যদিও এখন বিভিন্নভাবে মোটা ধান চাষাবাদে চাষীদের নিরুৎসাহিত করতে নানাভাবে প্রচার প্রচারণা চালানো হচ্ছে। এতে তেমন কাজ হচ্ছে না। নীতিমালা প্রণয়ন করে চিকন ধানের উৎপাদন বৃদ্ধির কৌশল নিলে মোটা ধানের চেয়ে চিকন ধানের চাষাবাদ বৃদ্ধি পাবে। চাষীরা চিকন ধান চাষাবাদ করে যদি উপযুক্ত মূল্য পান, তাহলে সবাই চিকন ধান উৎপাদনের দিকেই নজর দেবেন। এজন্য সরকারকে চিকন ধানের উৎপাদন বৃদ্ধিতে বিশেষভাবে প্রণোদনা দিলে চিকন ধানের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। তখন আর চিকন চালের সংকট হবে না, দামও বাড়বে না অর্থাৎ চাহিদার ভিত্তিতে উৎপাদন বৃদ্ধির কৌশল অবলম্বনের কোনো বিকল্প এখন সামনে নেই।
ভোক্তার চাহিদা অনুযায়ী চিকন ধান উৎপাদনে যেমন নজর বাড়াতে হবে, তেমনি মোটা চালের পাশাপাশি চিকন চালও সরকারকে অভ্যন্তরীণভাবে সংগ্রহ করে আপৎকালীন মজুদ গড়ে তুলতে হবে। ভুললে চলবে না, ভোক্তার চাহিদার ভিত্তিতে উৎপাদন ও উৎপাদিত চিকন ধান থেকে প্রস্তুতকৃত চালের সরবরাহ বৃদ্ধি করতে না পারলে ভোক্তার কষ্ট বাড়বে। আর ভোক্তার কষ্ট লাঘব করতে হলে চিকন ধানের উৎপাদন বৃদ্ধির বিকল্প নেই। তাহলে সা¤প্রতিক সময় চিকন চালের মূল্য যেভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে তার রোধ করা অনেকাংশেই সম্ভব হবে।
আব্দুল হাই রঞ্জু : প্রাবন্ধিক।