তালেবকে চিনি আজ প্রায় ত্রিশ বছর। আমাদের এলাকায়ই থাকে, চেয়ারম্যান সাহেবের বস্তিতে এক কামরার বাসায় বউ আর বুড়ো মাকে নিয়ে থাকে। নিঃসন্তান তাই কিছুটা খাপছাড়া জীবন ওর। গর্ত খুঁড়াখুঁড়ি করে সংসার চালাতে পারে না। প্রায়ই দেখা যায় এর ওর কাছ থেকে চেয়েচিন্তে চাল, ডাল নিয়ে অন্নসংস্থান করছে। আমার বাসা থেকে তালেবের বস্তি কাছেই তাই আমার বাসা থেকেই তুলনামূলক বেশি সাহায্য করা হয়। সে যাইহোক, এসব কথা অপ্রাসঙ্গিক। আসল কথায় আসি। তালেবের জীবন খুবই ঘটনাবহুল। তার মতে জগতের আসল রহস্য লুকানো আছে মাটির নিচে। আর তাই যারা মাটি খুঁড়াখুঁড়ির কাজ করে তাদের কাছেই আছে জগৎ-সংসারের আসল রহস্যের সন্ধান! ওর মতে একেক জায়গার মাটির একেক রকম ভাষা, মাটি নাকি জাত খোদকের সাথে কথা বলে। তালেবের দাদা ওকে সুরুক মন্ত্র শিখিয়ে গেছেন। ওর মতে দুনিয়ায় এমন বারোটা সুরুক আছে যা দুনিয়ার সাথে পাতালের সংযোগস্থল। উল্লেখ্য যে সুরুক মানে গর্ত। তালেবের দাবি সে একটার সন্ধান পেয়েছে। উপযুক্ত সময়ে আমাকে দেখাবে।
তালেবের কথায় আমি তেমন একটা দ্বিমত করি না কারণ তাতে করে ওর কাছ থেকে শোনা খুব ইন্টারেস্টিং গল্পগুলো থেকে বঞ্চিত হওয়ার একটা বিরাট চান্স থাকে। তালেব অবিশ্বাসীদের ওর গল্প শোনায় না! এখন যে ঘটনার কথা বলবো তা আশির দশকের কথা। সেসময় কারেন্ট যেত না, মাঝে মাঝে আসতো! এর মাঝেই চলতো বিদ্যুৎ বিভাগের অভিযান। ওরা প্রায়ই এসে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে যেত। তালেবের বস্তির উপর খড়গ পড়তো সবার আগে। ও প্রায়ই আমার বারান্দায় শুতে আসতো কাথা বালিশ নিয়ে। শখ করে সেখনে একটা সিলিং ফ্যান লাগিয়েছিলাম! আর এটাই যে ওর কারণে-অকারণে আমার বারান্দায় ঘুমাতে আসাকে ত্বরান্বিত করত এতে আমার কোনো সন্দেহ ছিল না। তালেব নিজেও সেটা বুঝেও না বোঝার ভান করতো, আসলে ওর প্রতি আমার প্রচ্ছন্ন স্নেহের ব্যাপারটা ও আঁচ করতে পেরেছিল; তাছাড়া ও আমার পরিবাবের খুব কাছের মানুষ। ওর যখন কাজ থাকে না তখন আমার বাজার করা থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ-পানির বিল দেয়া সবই ও করে। তালেবের বৌ আমার বাসার মহিলাদের সাথে রান্নাঘরে কাজ করে। এখন বর্ষাকাল, তালেবের হাতে কাজ নেই। পৌরসভার খোড়াখুড়ির কাজ শুরু হতে কয়েকমাস বাকি আছে তাই তালেবের বেকার সময় চলছে। সারাদিন আমার পিছে পিছে ঘুরঘুর করে। এই সময়ে আমাকে খুশি করাই যেন ওর একমাত্র কাজ।
যাইহোক গল্পে চলে আসি। গল্প বললে ভুল বলা হবে। তালেবকে নিয়ে আমার জীবনে ঘটে যাওয়া এক ভয়ানক ঘটনা এটা। আগেই বলে নেই এটা নির্দিষ্ট কিছু সময়ের অভিজ্ঞতা মাত্র। কোনো বিস্তারিত ব্যাখ্যা বা সমাধান নেই। আর এই ঘটনার সাথে আমি নিজেও ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে পড়েছিলাম। এই ঘটনা কখন যে আমার নিজের জীবনের ঘটনা হয়ে গেছে তা বুঝতেই পারিনি।
সেদিন কী বার ছিল আমার মনে নেই। সকাল থেকেই প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে। আমার বাসায় কিছু মেরামতের কাজ থাকায় একটু আগেভাগেই দোকান বন্ধ করে হার্ডওয়্যারের দোকানের উদ্দ্যেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। বেশ খানিকটা তার, স্ক্রুু আর রং কিনে আমি বাড়ির পথ ধরলাম। আমার বাসা আর দোকানের মাঝে তেমন দূরত্ব নেই কিন্তু এই বৃষ্টি কাঁদার ভেতর হাঁটতে ইচ্ছা করছে না। আমিনবাজার থেকে মিরপুর এলাকায় তখন রাস্তার অবস্থা বেশ খারাপ ছিল। আমি অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও কোনো রিক্সা পেলাম না। অগত্যা হাঁটাকেই একমাত্র নিয়তি মেনে নিয়ে হাতের ব্যাগটা মাথায় দিয়েই এগোতে লাগলাম। তখন বিকেল প্রায় বিদায়ের পথে। বৃষ্টিটাও কেমন যেন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। রাস্তায় তেমন লোকজনও নেই। আমার মনে হলো কেউ যেন আমাকে মিহি স্বরে বারকয়েক ডাকলো! আমি পাশের একটা ঝাকড়া পাকুড় গাছের নিচে দাঁড়ালাম। আমার উৎসুক দৃষ্টি চারদিকে সেই ডাকের উৎস খুঁজতে তখন ব্যস্ত ঠিক সেই সময় আবার সেই ডাক শুনতে পেলাম। এবার আমি বেশ ভয় পেয়ে গেলাম। পাশ দিয়ে পরপর দুটো ট্রাক বিকট শব্দ করে চলে গেল। একবার মনে হলো হাত দেখিয়ে থামাই কিন্তু সেটা আর করতে পারলাম না। বৃষ্টি মনে হয় আরেকটু জোরে শুরু হয়েছে। ভেজার হাত থেকে বাঁচতে একটু ভেতরের দিকে সরে যেতেই সেই ডাকের উৎস খুঁজে পেলাম। রাস্তা থেকে কিছুটা নিচে একটা পঁচা ডোবার ভেতর থেকে শুধু মাথা বের করে আমাকে ডাকছে তালেব। প্রচণ্ড দুর্গন্ধময় সেই ডোবায় কোনো মানুষের পক্ষে নামা সম্ভব কিনা আমার জানা নেই। কিন্তু ও ওখানে কি করছে। আমি চিৎকার করে ওকে ডাক দিলাম কিন্তু ও আমার দিকে ভাবলেশহীনভাবে তাকিয়ে কিছু একটা বলেই আবার ডুব দিল। দৃশ্যটা এতটাই অতিপ্রাকৃত যে আমি আর নিতে পারলাম না। জ্ঞান হারালাম।
যখন জ্ঞান ফিরলো তখন প্রচণ্ড জ্বরে আমার গা পুড়ে যাচ্ছিল। আমার পাশের দোকানি রহমান ভাই পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আমাকে ঝোঁপের কাছে উপুড় হয়ে পড়ে থাকতে দেখে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। আমার সারা শরীর নাকি ডোবার পঁচা পানিতে মাখামাখি ছিল! আমি ভেবেই পেলাম না কীভাবে সেটা সম্ভব, আমি তো ডোবায় নামিনি, তবে! এই ঘটনার পর থেকে তালেবের সাথে আমার সম্পর্ক আর আগের মতো ছিল না। ও আর আসতো না তেমন। ওর বউয়ের কাছ থেকে শুনলাম যে ও সারাদিন শুধু ঘুমায় আর কাজও ছেড়ে দিয়েছে। সংসারে একেবারেই অচলাবস্থা। একটা জিনিস আমাকে খুব ভাবালো সেটা হচ্ছে ও নাকি প্রতিরাতে কোথাও যায় কিন্তু ফিরে এসে কিছুই বলে না। আর নামাজ সে একেবারেই ছেড়ে দিয়েছে। কথাও বলা প্রায় ছেড়ে দিয়েছে। তালেব খুব ধার্মিক মানুষ ছিল, ও নামাজ ছেড়ে দিয়েছে এটা আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারলাম না। প্রচণ্ড এক অন্যায় কৌতূহল আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে বিষয়টা জানার জন্য। এছাড়াও একটা দায়িত্ববোধ তো আছেই। আমি ঠিক করে ফেললাম একদিন ওর পিছুপিছু যাব আর দেখবো ঘটনা কি।
আজ সেই দিন, আমি আমার বাসার ছাদে বিকেল থেকেই ঘাপটি মেরে পড়ে আছি আর তালেবের বাড়ির দিকে নজর রাখছি। মাগরিবের নামাজের সময় হয়ে গেল। আমি সেখানেই নামাজ পড়লাম। এদিকে আকাশের অবস্থাও তেমন ভালো না। যেকোন মুহূর্তে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামতে পারে। ঠিক এশার আজানের আগ দিয়ে আমি তালেবকে দেখলাম ঘর থেকে বের হয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে খুব দ্রুত হেঁটে বড়ো রাস্তার দিকে চলে যেতে। আমি কালবিলম্ব না করে খুব দ্রুত নেমে গেলাম। প্রায় দৌড়ে অনেকটা এসে আমি তালেবকে দেখতে পেলাম। আমি যথাসম্ভব নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে ওর পিছু নিলাম। কিছুদূর যেতেই এশার আজান শুরু হয়ে গেল। ঠিক সেই সময় আমি তালেবের মাঝে কিছু পরিবর্তন লক্ষ করলাম। ও কেমন যেন সটান সোজা হয়ে দাঁড়ালো আর দুকানে হাত চেপে মাটিতে পড়ে ছটফট শুরু করলো! আমি ভীষণ অবাক হয়ে এগিয়ে গেলাম। তখন এশার আজান হচ্ছে তাই রাস্তায় মসজিদগামী মুসুল্লিদের আনাগোনা শুরু হয়েছে। তালেবকে ঘিরে একটা ছোটোখাটো জটলা তৈরি হয়েছে। আমি যাওয়ামাত্র তালেব কাতরানো বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালো আর বিদ্যুৎ বেগে ভিড় ছিটকে দৌড়ে চলে গেল! আমি খেয়াল করলাম ঠিক আজান শেষ হবার সাথে-সাথেই তালেব উঠে দাঁড়িয়ে দৌড়ে পালালো। আমি দেরি না করে ওর বাসার দিকে রওনা দিলাম কিন্তু মসজিদের বড়ো হুজুর আমাকে ডাক দিলেন। উনি আমাকে কিছু না বলে বসতে বললেন। আমার দিকে প্রায় দুই মিনিট তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে মসজিদের ভেতরে উনার খাস কামরায় চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে ফিরে এলেন হাতে এক টুকরো মলিন কাগজ আর কালো সুতোয় বাধা একটা তাবিজ নিয়ে। উনি আমার কাছে আসতেই ঠিক আমার পেছনে একটা হুটোপুটির আওয়াজ পেলাম। বড়ো হুজুরের রুমের দরজাটা নিজে নিজেই ধরাস করে খুলে গেল! কিন্তু কোনো লোকজন দেখতে পেলাম না। আমি ভয়ে বড়ো হুজুরের দিকে এগিয়ে এলাম। উনার সাথে আমাদের পারিবারিক সম্পর্ক রয়েছে। উনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন আর কোনো ভয় নেই। আমাকে নিয়মিত নামাজ পড়তে বললেন আর সেই তাবিজটা আমার গলায় পরিয়ে দিলেন। কোনো অবস্থাতেই সেটা খুলে ফেলতে বারেবারে নিষেধ করে দিলেন। আর সেই কাগজটা আমার বাড়ির মেইন গেইটের কোথাও নিরাপদে রেখে দিতে বললেন। আমি উনার সাথেই নামাজ পড়ে যেভাবে যেভাবে উনি কাজগুলো করতে বলেছেন সেভাবেই সব করলাম।
পরদিন সকাল থেকেই মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হলো। সেই বৃষ্টি কিছুটা হালকা হয়ে আসলো বিকেল নাগাদ। সারাদিন ঘরে বন্দি থেকে শরীর ভালো লাগছিল না। রাত নটা নাগাদ রাতের খাবার খেয়ে গায়ের উপর কাথা চড়িয়ে শুয়ে পড়লাম। আমার মাথার কাছের জানালা গলে বরফ শীতল পানির ঝাপটা এসে সব ভিজিয়ে দিচ্ছিল। আমি উঠে জানালাটা লাগানোর জন্য বাইরে তাকাতেই দেখলাম আমার উঠানের মাঝে কেউ একজন দাঁড়িয়ে কী যেন করছে। আমি আরেকটু ভালো করে তাকাতেই বুঝলাম লোকটা আর কেউ না আমাদের তালেব। আমি দ্রুত নিচে নেমে ওকে ডেকেই চললাম কিন্তু ও শুনছে বলে মনে হচ্ছে না। আষাঢ় মাসের প্রচ- বৃষ্টি হচ্ছে। রাত প্রায় দুটো। এই সময় ও এখানে কী করছে, এই ভাবনাটা আমাকে স্বস্তি দিচ্ছে না। এমনিতেই ওর অস্বাভাবিক কার্যকলাপ বেশ কিছুদিন থেকেই আমার বিশেষ সুবিধার মনে হচ্ছে না তার উপর এত জোরেশোরে ডেকেও জবাব না পাওয়াটা আমার মনে কেমন একটা কু-ডাক দিচ্ছে বারেবারে। আমার বারান্দার আলোটা পুরোপুরি ওর উপর গিয়ে পড়ছে। আমার দিক পেছন ফিরে বসে থাকলেও সে যে কিছু একটা খুব তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছে তা বেশ বুঝতে পারছি। হঠাৎ নাকে একটা পচা গন্ধ এসে লাগলো। গন্ধটা চেনা লাগলেও ঠিক ধরতে পারলাম না। তালেব যেখানটিতে বসে আছে তার দক্ষিণেই আমাদের ছাগলের খোঁয়াড়। চকিতে আমার চোখ সেখানে চলে গেল, যা দেখলাম তা আমার খুব একটা স্বাভাবিক মনে হলো না। খোঁয়াড়ের দরজা হাট করে খোলা! এই ব্যাপারটা মা কোনদিন ভুল করেন না। আজ এই বৃষ্টির রাতে মার এত বড়ো ভুল করার কোনো কারণ নেই। আমার হাতের টর্চটা জ্বলে উঠলো। খোঁয়াড়ের উপর আলো ফেলতেই যা দেখলাম তাতে ভয়ে সিঁটিয়ে গেলাম। খোঁয়াড়ের ভেতর অসংখ্য চোখ জ্বলজ্বল করছে। প্রত্যেকটা চোখে অপরিসীম আতঙ্ক! ওরা তালেবের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা দেখছে। কী আশ্চর্য ছাগলগুলো কোনো শব্দ করছে না কেন! তালেবের খাওয়া মনে হয় ততক্ষণে শেষ হয়েছে। ও ধীরে ধীরে আমার দিকে ফিরছে। আমি খোঁয়াড় থেকে চোখ সরিয়ে তালেবের দিকে তাকালাম। কিন্তু এই তালেবকে তো আমি চিনি না। আমার টর্চের আলো ওর মুখে ফেলতেই ওর চোখজোড়া ধ্বক করে জ্বলে উঠলো। ওর ঠোঁট টকটকে লাল! ওকি পান খেয়েছে? নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করলাম। কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়লো, তালেব পান খায় না। খেলে নাকি ওর মাথা ঘোরে। তবে ওর ঠোঁট এত লাল কেন? এইসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ও আমার কাছে চলে এসেছে খেয়ালই করিনি। আমার কাছে এসে ভাবলেশহীন কণ্ঠে বলে উঠলো,
—ভাইজান কী ভাবছেন পান খাইছি?
—না সেটা ভাবিনি কিন্তু তোমার ঠোঁট এত লাল কেন?
এবার তালেব যা বললো তা শুনতে আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। বৃষ্টি আগের চেয়ে জোরে শুরু হয়েছে। তালেবের চুলগুলো কাকভেজা হয়ে ওর কপালে লেপ্টে আছে। উদভ্রার মতো চাহুনি নিয়ে তালেব আমার দিকে এগিয়ে আসছে। উঠোনে টর্চের আলো ফেলতেই আমি দেখলাম কালো কিছু একটা পড়ে আছে। প্রচণ্ড বৃষ্টির কারণে আলো ভালো করে ফেলতে পারছি না। ছাতায় কুলোচ্ছে না, টর্চটাও ভিজে যাচ্ছে। তালেব আর কাছে আসছে না, সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। উঠোনের লালচে পানি দেখে আমি তালেব কে বললাম,
রকিরে আজ তোর কি হলো? তুই তো পান খাস না। আজ এই ঝুম বৃষ্টির মাঝে তোর আবার পান খাবার ভূত মাথায় উঠলো কীভাবে?
তালেব কিছু না বলে উঠোনে স্বশব্দে একগাদা থুতু ফেললো। তার পর আমার দিকে মুখটা বাড়িয়ে বিশ্রীভাবে হাসতে হাসতে বলল,
রপান খাইয়া কি করমু? আমার দরকার রক্ত, এইডা রক্ত!
আমি চমকে উঠে দু-হাত পিছিয়ে গেলাম। ওর ফেলা থুতুর দিকে ভালো করে দেখতেই আমি বুঝলাম, থিকথিকে লাল তরলটা রক্তের দলা ছাড়া আর কিছুই না। আমার গা গুলিয়ে উঠলো। হাত থেকে ছাতা আর টর্চটা পড়ে গেল। টর্চটা নিচে পড়েও কিছুক্ষণ জ্বলেছিল আর আমি দেখলাম যে কালো যে জিনিসটা পড়ে আছে সেটা আসলে আধখাওয়া মৃত ছাগল! এবার আর আমি নিজেকে সামলাতে পারলাম না। পেটে হাত দিয়ে বমি করা শুরু করে দিলাম। এর মানে খোঁয়াড়ে থাকা ছাগলগুলো নিষ্পলক চোখে এই দৃশ্যই দেখছিল! কিন্তু প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধে গিয়ে ওরা কোনো শব্দ না করে কীভাবে ছিল? এই প্রশ্নের কোনো উত্তর আমি পেলাম না। কখন মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলাম টেরই পাইনি। কোনোমতে উঠে দাঁড়ালাম। বৃষ্টির শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। টর্চ ততক্ষণে নিভে গেছে আর বারান্দা থেকেও কোনো আলো আসছে না। এর মানে লোডশেডিং! আমি বুঝতে পারছিলাম না কি করবো। ঠিক তখন চারিদিক আলো করে প্রচণ্ডভাবে বাজ পড়লো। সেই আলোতে আমি যা দেখলাম তা কোনোদিন ভুলবো না। এত অতিপ্রাকৃত কোনো দৃশ্য কেউ কখনও দেখেছে বলে আমার জানা নেই। দেখলাম আমার চারপাশে খোঁয়াড়ের সবকটা ছাগল দাঁড়িয়ে আছে। আলো পড়ায় তাদের চোখ ধ্বক করে জ্বলে উঠলো। ওরা কখন যে নিঃশব্দে আমাকে ঘিরে ফেলেছে টেরই পাইনি। ততক্ষণে চারপাশ আবার কালির মতো অন্ধকারে ডুব দিয়েছে। আমি বুঝতে পারছিলাম যে এক প্রচণ্ড অশুভ চক্রের মাঝে ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছি। আমি আর এক মুহূর্ত দেরি না করে উল্টো ঘুরে দৌড়ে বাসার ভেতর ঢুকে কলাপ্সিবল গেট টেনে দিলাম। আমার চোখ ততক্ষণে অন্ধকারে খানিকটা সয়ে এসেছে। দ্রুত হাতে গেটে তালা লাগিয়ে ফেললাম। ছাগলগুলো প্রচণ্ড আক্রোশে গেটের উপর একে একে আছড়ে পড়তে লাগলো! ততক্ষণে আমার বাসার আর সবাই জেগে উঠেছে। কারেন্ট চলে আসায় কলাপসিবল গেটের লাইটটা জ্বলে উঠলো। আমার মা ছাগলের এই আচরণ কোনোভাবেই মেনে নিতে পারলেন না। মূর্ছা গেলেন। ছাগলগুলোর মাথা ফেটে রক্ত বের হচ্ছে। বেশ কয়েকটার শিং মট করে ভেঙে গেল কিন্তু এসবে তাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। মরিয়া হয়ে তারা আমার কাছে আসতে চাইছে। এক অতিপ্রাকৃত বন্য, আদিম জিঘাংসা তাদের চোখে মুখে ফুটে উঠেছে। এক পর্যায়ে ছাগলগুলো লোহার গেট প্রাণপণে কামড়াতে শুরু করলো। একসময় মসজিদ থেকে ফজরের আজান শুরু হয় আর ছাগলগুলো তাদের আস্ফালন বন্ধ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। দিনের আলো ভালো করে ফুটতেই আমি বাইরে বের হলাম। প্রতিটি ছাগল মৃত অবস্থায় এখানে সেখানে পড়ে থাকতে দেখলাম। আরেকটা বড়ো ক্ষতি হয়েছিল, আমার মা কেমন যেন অপ্রকৃতস্থ হয়ে গিয়েছিলেন সেদিনের পর থেকে। অনেক ডাক্তার কবিরাজ দেখিয়েছি কিন্তু কিছুই হয়নি।
তালেবের সাথে ঘটা এটাই আমার শেষ ঘটনা। শেষ বলছি এই কারণে যে এর পর তালেব আর কখনো আমার কাছে আসেনি। সে বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে সেটাও জানা যায়নি কারণ কেউ আর কোনদিন তাকে দেখেনি। শুধু তালেব না। ওর মা আর বউকেও কেউ কোনোদিন দেখেনি। জ্বলজ্যান্ত তিনজন মানুষ যেন একেবারে কর্পূরের মতোই উবে গেছে। থানা পুলিশ করা হয়েছে কিন্তু কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। তবে আমি কিন্তু মুক্তি পাইনি। প্রায় প্রতিরাতেই আমি বিভিন্নরকম দুঃস্বপ্ন দেখা শুরু করলাম। একটা স্বপ্ন প্রায়ই দেখতাম যে তালেব আর ওর মা, বউ আমার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে আর মুক্তি চাইছে। কিসের মুক্তি আর কেনই বা চাচ্ছে তা আমি বুঝতে পারতাম না। একটা সময় আমি আর নিতে পারতাম না। আমি না ঘুমিয়ে রাত জাগা শুরু করলাম। আমার শরীর ভীষণ রকমের খারাপ হয়ে গেল। আমি যখন বাসায় থাকতাম না তখন অচেনা বিভিন্ন লোক এসে আমার খোঁজ করতো। তারা কেউ মেইন গেইটের ভেতরে ঢুকতো না, বাইরে থেকে অদ্ভুত গলায় ডাকতো। আমি নেই শুনে চলে যেত। আমার জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠলো। একদিন আমার বাসার সাহায্যকারী মজনু আমাকে না জানিয়ে একজনের পিছুপিছু গিয়ে দেখলো লোকটা সে পাকুর গাছের পেছনের ডোবায় নেমে অদৃশ্য হয়ে গেল। রাতে ও যখন আমাকে কথাটা বললো তখন অস্বাভাবিক ভয়ের একটা শীতল স্রোত আমার পিঠ বেয়ে নেমে গেল। এটাও বুঝলাম যে মজনু কত বড়ো বিপদের হাত থেকে রেহাই পেয়েছে নিজের অজান্তেই!
পরদিনই আমি বড়ো হুজুরের কাছে গেলাম আর সবকিছু শুনে উনি আমাকে সেই ডোবাটার পানি সেচে ফেলতে বললেন। তালেবের কাছথেকে শোনা সেই বারোটা সুরুকের কথা উনাকে বললে উনি চুপ করে থাকলেন আর বললেন,
—দুনিয়ার সবকিছু তো আমার জানা নাই বাবা। হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। তুমি বরং আগে পানি সরানোর ব্যবস্থা কর। যেদিন করবা আমাকে সাথে নিয়ে যেও।
উনার শরীর খুব খারাপ তাই আমি বেশি কথা না বলে উনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম। আসার আগে উনি আমাকে সাবধানে থাকতে বললেন আর তাবিজটা কোনো অবস্থাতেই কাছ ছাড়া করতে নিষেধ করলেন।
সেদিন রাতেই কেউ আমার নাম ধরে বাহিরে থেকে খুব ডাকাডাকি করতে লাগলো। ঘুম ভেঙে দেখি রাত একটা। আমি কোনোমতে চোখ কচলে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি বড়ো হুজুর! আমার বিস্ময়ের সীমা থাকলো না। আমি সাত-পাঁচ না ভেবেই প্রায় দৌড়ে নিচে নামলাম। আমি কাছে যেতেই বড়ো হুজুর খানিক পিছিয়ে গেলেন। আমি উনার মাঝে তেমন কোনো অসুস্থতার লক্ষ্মণ দেখলাম না। খুব বাজে একটা গন্ধ নাকে এসে লাগলো। বড়ো হুজুর আমাকে তাবিজটার কথা জিজ্ঞেস করে সেটা উনার নিয়ে আসা একটা কাগজের ভেতর ভরে উনাকে দিতে বললেন, কি নাকি কাজ বাকি আছে! এবার আমার ভীষণ খটকা লাগলো। আমি বুঝতে পারছিলাম যে কোনো একটা সাংঘাতিক উল্টো পালটা কিছু ঘটে চলেছে। একে তো এত রাত তার উপর বড়ো হুজুরের যে শারীরিক অবস্থা দেখেছি তাতে উনার পক্ষে একা এতদূর হেঁটে আসা মোটেও সম্ভব না। আমার নীরবতা দেখে বড়ো হুজুর আমাকে ধমকে উঠলেন। আমি অবাক বিস্ময়ে দেখলাম বড়ো হুজুর কেমন যেন বদলে যাচ্ছেন। আমার চোখের সামনে উনি তালেবের অবয়ব ধারণ করলেন কিন্তু উনার দৃষ্টিতে ক্রুর নৃশংসতা! এরপর আমাকে হতবাক করে দিয়ে উনি আবার বদলে নারী অবয়ব ধারণ করলেন, তালেবের মার। এরপর ওর স্ত্রীসহ আরও অচেনা কিছু রূপ ধরে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন কিন্তু কি এক প্রবল ধাক্কায় আমি অনেকটা দূরে ছিটকে পড়লাম। সেই পিশাচটাও দূরে ছিটকে পড়ে ছটফট করতে লাগলো তারপর কালো তরলে পরিণত হয়ে মিলিয়ে গেল। বিকট দুর্গন্ধ আমার নাকে এসে লাগলো। এই দুর্গন্ধ আমার চেনা। সেই পঁচা ডোবার কালো থকথকে পানির গন্ধ। আমার বুকের কাছে কেমন একটা দ্রুত কম্পন টের পেলাম আর উত্তাপ অনুভব করলাম। তাবিজটায় স্পর্শ করেই বুঝলাম সেটাই প্রবলভাবে কাঁপছে আর গরম হয়ে আছে! আমার বাসায় কেউ না থাকায় এত গণ্ডগোলের মাঝেও কেউ এলো না। আমি ক্লান্ত পায়ে উপরে উঠে এলাম। তারপর বিছানায় নিজের ক্লান্ত শরীরটাকে কোনোমতে এলিয়ে দিতেই ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেলাম। এর পর বেশ অনেক দিন আর কোন রকম ঝামেলা হয়নি তবে আমার স্বপ্নে ওরা তিনজন নিয়মিতই আসতো আর মুক্তি চাইতো।
বর্ষাকাল শেষে আমি পৌরসভা থেকে অনেক কষ্টে অনুমতি নিয়ে সেই ডোবার পানি সেচের ব্যবস্থা করলাম। ভোরে বড়ো হুজুরকে জানাতে গিয়েছিলাম কিন্তু মসজিদ থেকে জানতে পারলাম যে ফজরের নামাজের পর থেকে উনাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমি কিছুটা হতাশ হয়ে পড়লাম কিন্তু হাল ছাড়লাম না। অন্য লোকদের নিয়ে যখন সেই ডোবার কাছে গেলাম দেখি বড়ো হুজুর চিন্তিত মুখে একটা পাটির উপর বসে আছেন। দ্রুতই পানি সেচের কাজ শুরু হয়ে গেল। পানি তো নেই শুধু অস্বচ্ছ আর দুর্গন্ধময় ঘন তরল। পানি যতই কমছিল আশেপাশের পরিবেশ ততই ভারি হয়ে যাচ্ছিল। বড়ো হুজুরের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে দেখলাম। আমার মনে হল উনি যেন নিশ্বাস নিতে পারছেন না। পুরো পানি সেচে ফেলার পর বিকট দুর্গন্ধ আসতে লাগলো। হঠাৎই বড়ো হুজুরের চিকারে সম্বিত ফিরে পেলাম। উনি তর্জনী উঁচিয়ে ডোবার পূর্বদিকে একটা গভীর গর্তের দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। সেই গর্তটার ভেতর থেকে কেমন যেন কুয়াশার মতো কিছু বেরিয়ে আসছে। আর সেখান থেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ আসছে। আমি ভীষণ চমকে উঠলাম কারন এই কান্নার আওয়াজ আমার খুব চেনা। আমি যে দুঃস্বপ্ন দেখতাম সেখানে তালেব, ওর মা আর বউ ঠিক এভাবেই কাঁদতো। আমি বড় হুজুরকে মনের কথাটা বলতে যেতেই উনি আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,
—তুমি কি বলবে আমি জানি। তুমি স্বপ্নে এই কান্নার শব্দ শুনতে তাই না? তুমি এক ভয়ংকর শয়তানের পাল্লায় পড়েছ বাবা। তোমার বাবাও পড়েছিলেন। তাকে আমি বাঁচাতে পারিনি কিন্তু তোমার কিছু আমি হতে দেবো না। আমি আবার ফিরে আসবো।
এটুকু বলে আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই বড় হুজুর সেই ডোবায় নেমে গেলেন। সেই গর্তের কাছে গিয়ে বিড়বিড় করে কি সব আওড়ালেন আর আমার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে গর্তের ভেতর লাফিয়ে পড়লেন। উনার মুখে একটা মৃদুমন্দ হাসি খেলে গেল। আমিসহ অনেক লোক জড়ো হয়েছিল, আমরা সবাই হইহই করে উনাকে ধরতে গেলাম কিন্তু ততক্ষণে বড্ড দেরি হয়ে গেছে। উনি গর্তে তলিয়ে গেছেন। আমরা অনুভব করলাম ডোবার মাটি কেমন যেন কেঁপে উঠলো। সবাই ভয়ে দৌড়ে রাস্তায় উঠে এলাম। ডোবার ভেতরের গর্তটা নিজ থেকেই ভরাট হয়ে গেল আর চারপাশ থেকে পরিষ্কার টলটলে পানি এসে ডোবাটা ভরাট হওয়া শুরু হলো। ততক্ষণে শত শত মানুষ জড়ো হয়েছিল। সবার সামনেই এই অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটেছিল তাই কারোরই অবিশ্বাস করার উপায় ছিলো না। আমি বড়ো হুজুরকে খুঁজতে ডোবায় নামতে অনেককে অনুরোধ করলাম কিন্তু কেউ সাহস করলো না। পৌরসভার সরকারি লোক ছাড়াও শতশত লোকের সামনে ঘটনাটি ঘটায় পুলিশ কোনো জিডি নিলো না। তিন দিনের ভেতর সেই ডোবার পুরোটা পরিষ্কার পানির একটা পুকুরে পরিণত হলো। আমিনবাজার যেতে সেই পুকুরটা এখনও চোখে পড়ে। এখন সেটার চারপাশ বাঁধাই করে দিয়েছে সরকার। সবাই পুকুরটিকে বড়ো হুজুরের পুকুর নামেই চেনে।
আমি মসজিদ কমিটির মাধ্যমে তন্নতন্ন করে খুঁজেও বড়ো হুজুরের কোনো পরিচয়পত্র বা সার্টিফিকেট বা অন্য কোনো কাগজ খুঁজে পেলাম না। এমনকি উনার কক্ষে একটা জিনিসও নেই। পুরো কক্ষ একেবারে খালি। ঘটনাটি পাঁচ কান হতে বেশি সময় লাগলো না। সবাই একবাক্যে স্বীকার কিরে নিল যে বড়ো হুজুর আসলে একজন জ্বীন, মানুষ নন! সবচেয়ে অবাক ব্যাপার এই ছিল যে আমি তালেব, ওর মা আর বউয়েরও কোনো হদিস পাইনি। ওদের আসল বাড়ি বা কোনো স্বজন এমন কাউকেই পাওয়া যায়নি। এর পর থেকে আর কোনোদিন আমি আর কোনো দুঃস্বপ্ন দেখিনি। আরেকটা কথা বলে রাখি তালেবের কাছ থেকে সুরুক মন্ত্রটা আমি শিখে নিয়েছিলাম। আমি মাঝে মাঝেই সেটা মনে মনে আওড়াই-যদি আরও কোনো সুরুকের খোঁজ পেয়ে যাই!