করোনাভাইরাস মহামারির কারণে গত মার্চে থেকে দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। মে-জুন থেকে অনলাইনে শিক্ষার্থীদের ক্লাস কার্যক্রম শুরু করেছে অনেক স্কুল ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকার বাইরের অনেক শহরেই অনলাইন শিক্ষাদান কর্মসূচি চালু করেছে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তবে সরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের চেয়ে বেসরকারি স্কুলগুলো বিশেষ করে ইংরেজি মিডিয়াম বা উভয় মাধ্যমের পরিচিত স্কুলগুলোও ব্যাপকভাবে অনলাইন পাঠদান চলছে। সরকারি স্কুলগুলোতে অনলাইনের চেয়ে বেশি জোর দেয়া হচ্ছে সংসদ টিভির মাধ্যমে স্কুলের সিলেবাস অনুযায়ী পাঠদান প্রক্রিয়াকে।
বর্তমানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়াশোনা করছে। শিক্ষার্থীদের ক্ষতি কিছুটা হলেও কমিয়ে আনতে ধীরে ধীরে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) পরামর্শক্রমে কিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে ক্লাস নেওয়া শুরু হয়েছে। যদিও নানা বাস্তবতায় দেশের সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো পুরোদমে অনলাইন ক্লাস কার্যক্রম চালু করা সম্ভব হয়নি। ফলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরা কার্যত এ সুযোগ থেকে বঞ্চিতই থেকে যাচ্ছে।
অনভ্যস্ততার কারণে অনলাইন ক্লাস শুরু হওয়ার পর থেকে অনেক শিক্ষকই ক্লাসে শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত করতে কিছু প্রতিক‚লতা এবং শিক্ষার্থীরাও অনেক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। আর এসব নিয়েই এই প্রতিবেদন।
করোনা পরবর্তী সময়েও অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চালু থাকবে
ডা. দীপু মনি, শিক্ষামন্ত্রী
চলমান বৈশ্বিক করোনা মহামারির কারণে দীর্ঘদিন ধরে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। শিক্ষা কার্যক্রমকে চালিয়ে নিতে আমরা অনলাইন ক্লাস চালু করেছি। কিন্তু, এ ব্যবস্থায় অনেক শিক্ষার্থীর পক্ষে ইন্টারনেটের ব্যয় বহন করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই, শিক্ষার্থীদের জন্য বিনামূল্যে ইন্টারনেট প্রদান অথবা স্বল্পমূল্যে ইন্টারনেট প্যাকেজ দেওয়া যায় কি-না সে বিষয়ে মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলোর সঙ্গে আলোচনা চলছে। দ্রুত এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। করোনা পরবর্তী সময়েও অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চালু থাকবে।
প্রয়োজনে মেগা প্রজেক্টগুলোর গতি কমিয়ে হলেও শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে
রাশেদা কে চৌধুরী, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও নির্বাহী পরিচালক,
গণসাক্ষরতা অভিযানের শিক্ষাখাতে বরাদ্দ খরচে স্বচ্ছতা আনতে বরাদ্দের মূল্যায়ন করতে হবে। উচ্চ শিক্ষাকে অবশ্যই উৎসাহিত করতে হবে। এই বাজেটে শিক্ষার্থী ও কর্মজীবীদের প্রয়োজনীয়তার কোনো প্রতিফলন পড়েনি। মনে হচ্ছে, দেশে মার্চ মাসে কোভিড-১৯-এর সংক্রমণ শুরু হওয়ার আগেই বাজেটটি প্রস্তুত করা হয়েছে। প্রয়োজনে মেগা প্রজেক্টগুলোর গতি কমিয়ে হলেও শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে।
শিক্ষার্থীদের সহায়তায় সরকারি, বেরসকারি এমনকি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানও ভ‚মিকা রাখতে পারে
অধ্যাপক ড. মিলান পাগন, উপাচার্য, আইইউবি।
করোনা পরিস্থিতিতে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চালু করতে আমাদের দ্রæত প্রস্তুতি নিতে হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) অনলাইনে শিক্ষায় আমাদের উৎসাহিত করেছে। এখানে বিপুল প্রতিক‚লতা রয়েছে তবে এতে বিশ্ববিদ্যালয়েরও যেমন অনেক কিছু করার আছে, শিক্ষার্থীদের সহায়তায় সরকারি, বেরসকারি এমনকি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানও ভ‚মিকা রাখতে পারে। শিক্ষার্থীদের অনলাইন সংযোগ ও তা থেকে সুবিধা নেয়ার ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকেও অবকাঠামোগত ভ‚মিকা পুরোপুরি পালন করতে হবে।
এই পরিস্থিতিতে বাবা-মাকে তাদের সন্তানদের পাশে থাকতে হবে। সন্তানদের লেখাপড়ায় উৎসাহিত করতে হবে, যাতে তারা অনলাইন কোর্স থেকে বাদ পড়ে না যান। অর্থাৎ এ মুহূর্তে বাবা-মা যা করতে পারেন, তা হলোÑসন্তানদের পাশে থাকা ও তাদের উৎসাহিত করা। নীতিনির্ধারকদের প্রতি আমার পরামর্শ ও অনুরোধ শিক্ষার্থীরা যাতে অনলাইন ক্লাসে অংশ নিতে পারেন সরকারের উচিত সেই অবকাঠামো তৈরিতে সহযোগিতা করা।
এই সময়ে শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষাঋণ কার্যক্রম চালু করতে হবে
জাহিদুল করিম
শিক্ষক, ম্যানেজমেন্ট স্টাডিস বিভাগ, জাবি।
বিশ্বব্যাপী মহামারি করোনার কারণে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম সকল মহলে গুরুত্ব পেয়েছে। কিন্তু অনেকেই মনে করছেনÑআমাদের দেশের দুর্বল ইন্টারনেট সেবা, বিদ্যুৎ সমস্যা এবং অনলাইন শিক্ষা সহায়ক অনেক ধরনের শিক্ষা উপকরণের স্বল্পতা রয়েছে। আবার অনেক ছাত্র-ছাত্রী দরিদ্র জনগোষ্ঠি থেকে এসেছে, তারা কীভাবে এই অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিবে। এই ক্ষেত্রে শিক্ষকদের চাইতে শিক্ষার্থীদের সীমাবদ্ধতা বেশি রয়েছে। এখন অনেকেই অনলাইন শিক্ষার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছেন এবং সময়ের সাথে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে।
অনেক শিক্ষার্থী বলছে আমাদের শুধু প্রয়োজন একটি কম্পিউটার বা স্মার্ট ফোন এবং ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ। এই দুটি সুবিধা পেলে শতকরা ৯৫ ভাগ শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাসে অংশ নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এজন্য দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষাঋণ কার্যক্রম চালু করতে হবে। এখনই এই ধরনের সুযোগ তৈরি করা দরকার।
অনলাইন ক্লাসের সুযোগ পিছিয়ে আছে প্রান্তিক শিক্ষার্থীরা
দেশের প্রত্যন্ত ও প্রান্তিক অঞ্চলে বসবসাকারী শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে ইউটিউব চ্যানেলকেই বেশি ব্যবহার করছেন। সরকারি পোর্টাল শিক্ষক বাতায়নের মাধ্যমে তাদের আগে থেকে রেকর্ড করা কনটেন্ট ইউটিউবে দেয়া হয় এবং শিক্ষার্থীদেরও জানিয়ে দেয়া হয়।
এ বিষয়ে পটুয়াখালীর একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক নাজমুন নাহার জানান, ‘আমরা অনেকে আমাদের ব্যক্তিগত ইউটিউব চ্যানেলেও কনটেন্টগুলো দেই যাতে শিক্ষার্থীরা সহজে পেতে পারে। অনেকেই সেগুলো দেখে ও সে অনুযায়ী পড়াশোনা করছে এই বন্ধ সময়টাতে।’
শিক্ষক বাতায়নে অন্তত চার লাখ ২৫ হাজার শিক্ষক সংযুক্ত আছেন এবং ইতিমধ্যেই তাদের জমা দেয়া কনটেন্ট আছে আড়াই লাখেরও বেশি। এতে স্কুলের পাশাপাশি মাদ্রাসার শিক্ষকরাও সংযুক্ত থাকায় সারাদেশে এটি স্কুল মাদ্রাসাগুলোর সাথে ভালোভাবেই জড়িত। তবে এর বাইরে গ্রামাঞ্চলের স্কুলগুলোতে ইন্টারনেট বা অনলাইনভিত্তিক শিক্ষাদান ততটা সম্ভবপর হচ্ছে না।
ডিজিটাল প্রযুক্তি সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থী
সরকারি হিসেবে দেশে প্রাথমিক স্কুল আছ ৬৪ হাজার আর অন্যদিকে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে মাধ্যমিক বিদ্যালয় আছে আরও সতের হাজারের মতো। আর কলেজ বা মহাবিদ্যালয় আছে প্রায় আড়াই হাজার। সব মিলিয়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় পাঁচ কোটি। যদিও এর মধ্যে অল্প একটি অংশই এই করোনা পরিস্থিতিতে অনলাইনে শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে আর টিভি দেখার সুযোগ আছে সব মিলিয়ে ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থীর। অর্থাৎ এখনো বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী ডিজিটাল শিক্ষা কার্যক্রমের আওতার বাইরেই রয়ে গেছে।
অনেকেই ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রমের সুযোগ থেকে বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে
মোহাম্মদ ফসিহউল্লাহ, মহাপরিচালক, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর
কারা ইন্টারনেট ও টিভির আওতায় আছে এবং বাসায় কার কোন ধরনের ফোন আছে সে সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। এটি ঠিক যে অনেকেই ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রমের সুযোগ থেকে বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে। তবে এখানে সামর্থ্যের বিষয় জড়িত। তাই আমরা অনেকগুলো বিকল্প নিয়ে কাজ করছি। সারাদেশের সব অভিভাবকদের সাথে এলাকার শিক্ষকদের যোগাযোগ আছে। তাদের মোবাইল নম্বর আছে। শিক্ষকরা কথা বলছেন। তথ্য নিচ্ছেন। অভিভাবকদের মাধ্যমে পড়াশোনার নির্দেশনাও দিচ্ছেন। আবার অনেক শিক্ষক ইউটিউবে আছেন। যদিও ইন্টারনেট এখনো সব জায়গায় নেই। তবে অনেক জায়গাতেই আছে এখন।
টিভি ও ইন্টারনেটের চেয়েও এখনো রেডিও কাভারেজ বেশি আছে এবং সেটিকে কাজে লাগানোর মাধ্যমে অধিক সংখ্যক শিক্ষার্থীকে প্রযুক্তিগত শিক্ষাদান কার্যক্রমের আওতায় আনা যাবে বলে মনে করছি।
ফ্রি ইন্টারনেট সেবা এখন সময়ের দাবি
মো. শফিকুল ইসলাম, শিক্ষক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।
বর্তমানে আমাদের দেশেও স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। স্কুল বা কলেজ পর্যায়ে টেলিভিশন মাধ্যমে ক্লাস হচ্ছে। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ফেইসবুক, গুগল অ্যাপ, জুম এবং অন্যান্য মাধ্যমে পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যথারীতি শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনেক আগে থেকে অনলাইন ক্লাস নেওয়া শুরু করেছিল। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বেশ পরে এসে অনলাইন ক্লাস শুরু করে, সরকারের নির্দেশনা পাওয়ার পর। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা ভর্তি হয় তারা অধিকাংশ সচ্ছল পরিবারের। তাদের ইন্টারনেট সুবিধাসহ অনলাইন শিক্ষার অন্যান্য সরঞ্জামের অভাব নেই বললেই চলে। তবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের অনেক সমস্যা রয়েছে। যেমনÑঅনেকের ইন্টারনেট এবং ল্যাপটপ, স্মার্টফোন নেই। যার কারণে আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের এক প্রকারের চ্যালেঞ্জ নিয়ে অনলাইন শিক্ষার কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হয়।
সরকার বা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে নিউ নরমাল পরিস্থিতি মোকাবিলায় অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম নির্বিঘœ করতে অসচ্ছল শিক্ষার্থীদেরকে ফ্রি ইন্টারনেট সুবিধা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে যুগান্তকারী পদক্ষেপ। ফ্রি ইন্টারনেট সেবা এখন সময়ের দাবি। যেসব শিক্ষার্থীর আর্থিক সমস্যা রয়েছে তাদেরকে শনাক্ত করে জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর অনুযায়ী ঐসব শিক্ষার্থীকে ফ্রি ইন্টারনেট দিতে পারলে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম অনেক বেশি কার্যকর হতে পারে।
অনলাইন ক্লাস কার্যক্রম সচল হওয়ায় শিক্ষার্থীরা একটি দীর্ঘমেয়াদি সেশনজটে পড়া থেকে রক্ষা পেল
লায়লা ফেরদৌসী, শিক্ষক, গ্রিন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ
এখন প্রায় সকল সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন ক্লাস চালু আছে। বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সাধারণত কোনো সরকারি অনুদান বা সহায়তা পায় না। নন-প্রফিট অরগানাইজেশান হিসেবে শিক্ষার্থীদের প্রদেয় বেতন দিয়ে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য ব্যয় মিটিয়ে থাকে।
সেমিস্টার সিস্টেমে বিষয়টি এমন হয়ে দাঁড়ায়, মিড বা ফাইনাল পরীক্ষা না হলে এবং নতুন করে শিক্ষার্থী ভর্তি না হলে তাদের আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা প্রদান করার সামর্থ্য হারাবে, অনেকে চাকরিচ্যুত হবেন। অনলাইন ক্লাস কার্যক্রম সচল হওয়ায় শিক্ষার্থীরা একটি দীর্ঘমেয়াদি সেশনজটে পড়া থেকে রক্ষা পেল। সর্বোপরি দেশের উচ্চশিক্ষায় স্থিতিশীল পরিস্থিতি বজায় থাকল।
বাংলাদেশে স্বল্পতার মধ্যেও চালু হওয়া অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম আমাদের মতো শিক্ষক এবং ছাত্র-ছাত্রীদের দেখিয়ে দিয়েছে যে, আমরা স্মার্টফোনটি শুধু সামাজিক যোগাযোগ হিসেবে ব্যবহার না করে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবেও ব্যবহার করতে পারি। দেশের দূরদুরান্তে বসে ও শুধুমাত্র স্মার্টফোন ব্যবহার করে সব বিষয়ের ক্লাস করা সম্ভব।
মহামারির এই সংকটে শিক্ষার্থীরাই হয়ত সবচেয়ে সংকট ও দুশ্চিন্তার মধ্যে দিন পার করছে তাদের পড়ালেখা, ভবিষ্যত জীবন নিয়ে। এ ক্ষেত্রে সেই হতাশা-আশঙ্কা অভিভাবকদের পাশাপাশি তাদরেও কম নয়।
বর্তমান পরিস্থিতির শিক্ষা আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসেবে না দেখে দীর্ঘকালীন অভ্যস্থতায় পরিণত করতে হবে
আনিকা কাশেম
শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ
কোভিড-১৯ এই মুহূর্তে সারা বিশ্বের এক আতঙ্কের নাম। বৈশ্বিক এই মহামারির কারণে মার্চের মাঝামাঝি সময় থেকেই দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। এর কিছুদিন পর থেকেই শুরু হয় অনলাইন ক্লাস।
বড়ো বড়ো শহর কিংবা শহরতলিতে অনলাইন ক্লাস করা তেমন অসুবিধাজনক নয়। তবে সারা দেশের চিত্র কিন্তু এক নয়। আমাদের দেশের গ্রাম কিংবা প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেট সুবিধা সুলভ নয়, গতিও অনেক শ্লথ। তাছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে প্রায় ছয় মাস, কবে খুলবে সেটিও বলা যাচ্ছে না। এই দীর্ঘ সময় ধরে ইন্টারনেটে ক্লাস চালিয়ে যাওয়া বেশ ব্যয়বহুল। শুধুমাত্র ইন্টারনেট সুবিধা না থাকার কারণে কিংবা ইন্টারনেটের ব্যয়বহুলতার কারণে একই ক্লাসের কিছু শিক্ষার্থী ক্লাস করতে পারবে কিছু শিক্ষার্থী ক্লাস না করতে পেরে পিছিয়ে যাবেÑএটা কারোরই কাম্য নয়। তাই এক্ষেত্রে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। যতদূর সম্ভব কম খরচে প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য ইন্টারনেট সেবা নিশ্চিত করতে হবে।
যে বিষয়টি আমাদের কাছে প্রত্যাশিত ছিল না, সেই নতুন পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার বিষয়টি অবশ্যই কঠিন একটি কাজ, তবে বর্তমান পরিস্থিেিত আমাদের ‘নিউ নরম্যাল’ অবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। এসব কিছু দেখে আমরা যা শিখেছি সেগুলোকে আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসেবে না দেখে দীর্ঘকালীন অভ্যস্থতায় পরিণত করতে পারলেই আমরা বৈশ্বিক নিউ নরমালে আমরা নিজেদের শামিল করতে পারব।
অনলাইন ক্লাস কীভাবে আরও সহজ, সুন্দর ও কার্যকরী করা যায় তার দিক-নির্দেশনা সরকার-শিক্ষকমণ্ডলী ও শিক্ষার্থীদের মধ্যকার আলোচনা থেকে উঠে আসতে পারে
মো. আলী আজগর
শিক্ষার্থী, শাবি
বাংলাদেশসহ সারাবিশ্ব এখন কোভিড-১৯ মহামারির সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তবুও এমন পরিস্থিেিত আমাদরে পড়ালেখার কার্যক্রম থেমে নেই। অফলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও, অনলাইনে চলছে তার সদ্ব্যবহার। অনলাইন ক্লাস করার মতো পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা আমাদের নেই বললেই চলে উল্টো এর সীমাবদ্ধতা বিদ্যমানÑপারিবারিক অস্বচ্ছলতা, ইন্টারনেটের নেটওয়ার্ক সমস্যা, বৈদ্যুতিক গোলযোগ, গরীব-মেধাবি ছাত্র-ছাত্রীদের ডিভাইস সমস্যা, অনেক সময় অভিভাবকদের সহযোগিতার অভাব, শিক্ষক এবং আমাদের অনলাইন ক্লাস সম্পর্কে পর্যাপ্ত শিক্ষার অভাব, নেটওয়ার্ক সমস্যার জন্য শিক্ষক এবং আমাদের মধ্যে প্রশ্নের মাধ্যমে শিক্ষার আদান প্রদানের সমস্যা তো রয়েছেই। এমন হাজার সমস্যা অনলাইন ক্লাসকে ঘিরে।
তবে ইচ্ছে করলেই অনলাইন ক্লাসকে সুদূর প্রসারী করা যেতে পারে। এক্ষত্রে প্রথমেই সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। উল্লেখিত সমস্যাগুলির সঠিক সমাধান বের করতে হবে। শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। অনলাইন ক্লাস কীভাবে আরও সুন্দর ও কার্যকরী করা যায় তার দিক-নির্দেশনা সরকার-শিক্ষকমÐলী ও শিক্ষার্থীদের মধ্যকার আলোচনা থেকে উঠে আসতে পারে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে অভিভাবক এবং শিক্ষকমÐলীকে আরও সহযোগী মনোভাবে সৃষ্টি করতে হবে এবং আমাদেরকে বর্তমানে যেসব সমস্যাগুলোর সম্মখীন হচ্ছি তা নিজেদের আলোপ-আলোচনার মাধ্যমেই দূর করার রাস্তা বের করতে হবে।
স্টুডেন্ট ইন্টারনেট প্যাকেজ চালু করা যেতে পারে
তানজিমুল হাই রাফি
শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ
কোভিড শুরু হওয়ার পর থেকেই ক্যাম্পাস বন্ধ। মার্চ মাসের মাঝামাঝিতে বাসায় চলে আসি। এর কিছুদিন পর জুমে এবং ফেসবুক লাইভে অনলাইন ক্লাস শুরু হয়েছে। প্রথমদিকে অনলাইন ক্লাসে কোনো সমস্যা হত না। কিন্তু আমাদের অনেক ক্লাসমেট গ্রামে নেটওয়ার্কের সমস্যার কথা বলেছে। তাছাড়া ইন্টার্নেট কিনে অনলাইন ক্লাস করাটা এক পর্যায়ে লাগামহীন খরচের মতো হয়ে যাচ্ছিল। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ছাত্রছাত্রীদের ইন্টারনেট খরচ খানিকটা হলেও বহন করা উচিত বলে আমি মনে করি। কিছু ছাত্র ক্লাস করবে বাকিরা করতে পারবে না এমনটা কখনই কাম্য নয়। টেলিকম কোম্পানিগুলোকেও পরিস্থিতি বিবেচনা করে ইন্টারনেটট খরচ কমাতে হবে। আলাদা স্টুডেন্ট ইন্টারনেট প্যাকেজ চালু করা যেতে পারে। উন্নত দেশগুলোতে অনলাইন ক্লাস করার জন্য ডিভাইস পর্যন্ত সরকার থেকে সরবরাহ করা হয়েছে। এতটুকু আমাদের প্রতিটি শিক্ষার্থীর প্রাপ্য।
বাড়ি থেকে এভাবে হয়ত সবসময় পার করা যাবে না। জীবনের প্রয়োজনে বের হতেই হবে। কিন্তু নিউ নর্মাল এই পৃথিবীতে বের হতে গিয়ে সতর্কতা ভুলে গেলে চলবে না। স্বাস্থ্যবিধিগুলো নিজের ভেতর গেঁথে ফেলতে হবে।
কোভিড কবে যাবে কেউ জানে না। তাই হাল না ছেড়ে সতর্ক থাকার কোনো বিকল্প নেই। ক্লাস নেই, আড্ডা নেই, ঘুরতে যাওয়া বন্ধ, সব মিলিয়ে গুমোট এই পরিবেশে ডিপ্রেশন আসা খুবই স্বাভাবিক। তাই নিজেকে উৎফুল্ল রাখার চেষ্টা করতে হবে। সৃষ্টিশীল কাজ, কিংবা নতুন কোনো স্কিল শেখা এসবে সময় ব্যয় করতে হবে।
সার্বিক বিবেচনায় করোনাভাইরাস সংকটে ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা কার্যক্রম সচল রাখার জন্য অনলাইন শিক্ষার বিকল্প নেই। অনলাইন শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সেশনজট কমিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে। এই সংকটময় পরিস্থিতিতে তাদের মেধা ও চিন্তা শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কাজে ব্যস্ত রাখতে হবে। অন্যথায় সমাজের নেতিবাচক বিভিন্ন বিষয়ে তারা বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়বে যা পরে সমাজে অপরাধপ্রবণতা বাড়াতে পারে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে দেশের প্রত্যন্ত ও প্রান্তিক অঞ্চলেও এই শিক্ষাকার্যক্রম যাতে আরও ব্যাপক ও সচল থাকে তারজন্য সরকারকে কার্যকরী ভ‚মিকা নিতে হবে। এটা করতে হবে দ্রুত সময়েই।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ, সাক্ষাৎকার তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করা হয়েছে।
নাজিম উদদীন, বিশেষ প্রতিবেদক